দিনের পর দিন শিকল দিয়ে আটকে রাখা হত যেন আবার না পালিয়ে যায় ।। সৌরভ আসলাম, সাবেক হেফজখানার ছাত্র
জীবন থেকে নেওয়া
সর্বমোট ২ বছর হাফেজী মাদ্রাসায় পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। আল্লাহ আমাকে তার পবিত্র কুরআন পড়ার তাওফিক দিয়েছেন। এরকম পাশবিক আচরণ আমাদের সময়ে ছিল, এখনও আছে এটা দেখে অবাক হয়েছি। ১২ বছর বয়সে মাদ্রাসায় গিয়েছি ( অনেকেই আরও ছোট বয়সে যায়)। প্রথম প্রথম কয়েকদিন ভালো লেগেছিল। এরপরেই আমার শৈশবের চঞ্চলতা, শিশু মনের ভাবনা গুলোর সাথে মাদ্রাসার পরিবেশের সাথে কেমন যেন অপরিচিত হয়ে যাচ্ছিলো।
হাত থেকে প্লেট পড়ে গিয়ে শব্দ হওয়ার কারণে মার খেয়েছি, ঘুম থেকে উঠতে ২/৩ মিনিট দেরি হওয়ায় মার খেয়েছি, লাইট বন্ধ করার পরে কথা বলার কারণে মার খেয়েছি- এরকম অসংখ্য অযুহাতে ছাত্রদের বেত্রাঘাত করা হয় যার বেশিরভাগই বয়সের বিবেচনায় কোন অপরাধই না।
ভোর সারে তিনটায় উঠে পড়তে বসে ১০ টায় সকালের রুটিন করা মোটা চালের ভাত, আলু ভর্তা আর পাতলা ডাল যেন অমৃত লাগতো।
সারাদিনে ১ ঘণ্টা ঘুমের ফাকে আমি গল্পের বই পরতাম অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে। এর জন্য মার খেয়েছি বেশ কয়েকবার।
সারাদিনে বিকেলে ২ ঘণ্টা মুক্তি পেতাম ।
যেন সারাদিনের জমানো খেলা গুলকে ২ ঘণ্টায় শেষ করতে চাইতাম। বাইরের ছেলেরা আমাদের তেমন খেলায় নিতেন না । আমরা আলাদা জগতের মানুষ হয়তো এর জন্য ।
মাগরিবের নামাজের পর আবার পড়া।
কেও ঝিমাইলে শাস্তি স্বরূপ এক পায়ে দাড় করিয়ে রাখা ।
১১ টায় ঘুম।
যখন আবিষ্কার করতাম আমি আমার মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত আর ভাই বোনদের মত আমি স্বাধীন না । তখন শিশু মন ডুকরে কেঁদে উঠত
সেই কান্নায় থাকতো না শব্দ। তবে বুকের নিঃশ্বাস গুলো অনেক ভারি থাকতো। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হত।
দিনকে দিন আমার চঞ্চলতার যায়গায়
আমি হয়ে যাচ্ছিলাম নিসচুপ।
আমার চোখের সামনে সমবয়সী বন্ধুকে হাত পা বেঁধে পিটিয়েছে বড় হুজুর। অপরাধ? না বলে বাড়ি গিয়েছে বলে।
অথচ জানালা দিয়ে বাজারের মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো ।
যেন ৭ খুন করা কোন দাগি আসামিকে মারা হচ্ছে।
দিনের পর দিন শিকল দিয়ে আটকে রাখা হত যেন আবার না পালিয়ে যায়।
হুজুরদের শরীর টিপে দেওয়ার নামে যৌন নিপীড়ন হবার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার । ( শারীরিক ভাবে না হলেও মানুষিক ভাবে হয়েছি)
যখন ছুটিতে ২/৩ দিনের জন্য বাড়ি আসতাম
সেটা ইদের আনন্দের থেকে কম ছিলনা।
ছুটি শেষে যাবার সময় মনে হত...
আবার আমাকে আমার মনের বিরুদ্ধে বন্দীশালায় পাঠানো হচ্ছে............
মাদ্রাসার সবচেয়ে কম বয়সের ছাত্ররা হেফজখানায় পড়ে। তাদের মনস্তত্ত্বকে বুঝার, তাদের প্রতিভাগুলোকে বিকশিত করার কোন ব্যবস্থাই নাই।
শিশুদের শৈশব কৈশোরের আনন্দ গুলোকে মাটি দিয়ে বাবা মায়ের আদেশঃ হুজুর, "মাংস আপনার আর হাড্ডি আমাদের" শুনতে পাওয়া বাচ্চাটির মনের ভিতরের ভয় আর কষ্ট গুলা যদি বুজতেন, তাহলে সন্তানের ঘারে পা দিয়ে জান্নাতের আশা না করে নিজেরাই ভর্তি হয়ে যাইতেন।
এই অমানবিক ব্যবস্থার কারণেই যারা ভর্তি হয় তাদের ২০-৩০ % হিফজ শেষ করতে পারে, বাকিরা ঝরে যায়।
মাদ্রসাগুলোর উচিৎ নিজ উদ্যোগে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিৎ।
আর অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলবো,
বাচ্চাদের অবশ্যই ধর্মিও শিক্ষা দিতে হবে ।
তাই বলে আপনার মনের আশা পূরণ করতে যেয়ে ম্রিতুর পরে আপ্নাদের জান্নাতের জন্য শিশুটির জীবন করে দিয়েছেন জাহান্নাম। নিজের সুদ,ঘুষ, দুর্নীতি আর আকাম-কুকাম অব্যহত রেখে হাফেজের বাবা-মা হিসেবে জান্নাতে চলে যাবেন এমন ভাবনা থেকে বের হয়ে আসুন। আপনার সন্তানের মনস্তত্ত্ব বুঝার চেষ্টা করুন।
হাফেজী পড়া ফরয কিংবা ওয়াজীব নয়।
লেখকঃ সৌরভ আসলাম, সাবেক হেফজখানার ছাত্র
No comments