Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    ক্লিনিক্যাল লায়ার ।। ছোটগল্প

    মানিব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার ঝকঝকে নোট কুলির হাতে দিয়ে কুলির হাসি দেখে রাগে পিত্ত জ্বলে গেল বশিরের। শুয়রের বাচ্চা বলে গালি দিতে ইচ্ছা করলেও ফিরিয়ে নিল। ওঠার সময় জোর করে ব্যাগ নেবে। আর ইচ্ছেমতো টাকা চাইবে। সদরঘাটের কুলিদের একতার খবর জানে বশির। কোনো কিছু হলে ছিলে খেয়ে ফেলবে ওকে সব কুলি মিলে। ২০৬ নম্বর কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বশির। লঞ্চে ওঠার সময় কেবিন-বয়টা বলল, আপনি দোতলায় যান, স্যার, আমি চাবি নিয়ে আসছি। 




    বিশ মিনিট হয়ে গেছে, এখনো দেখা নেই। মনে মনে একটা গালি দিতে যাবে, এমন সময় দেখা দিল কেবিন-বয় ছোকরা। হাতে লম্বা একটা চাবির রিং টাইপের। তার মাথায় একটা সিঙ্গেল চাবি। বশির সচরাচর এত গালি, বেফাঁস কথা বলা বা ভাবার লোক নয়। কোথাও যাতায়াত করতে গেলে মেজাজটা খিঁচেই থাকে ওর। বয়টি কেবিনের দরজা খোলার পর আগের রাগ অনেকটাই কমে গেল। সুন্দর ছিমছাম সাজানো কেবিনে দুইটা বেড, মধ্যিখানে চলাচলের জায়গার শেষে একটা টেবিল, তার ওপরে অ্যাশট্রে, পানির জগ, গ্লাস। উল্টো দিকে ঘুরে দেখল, একটা ছোট টিভি, তার নিচে একটি ডিভিডি সেট। 

    ঠিক আছে, তুমি যাও তাহলে। কিছু লাগলে তোমাকে কীভাবে পাব?
    লাইট-ফ্যানের সুইচের পাশে বেলসাইনওয়ালা একটা সুইচ দেখিয়ে বয়টি বলল, স্যার, এখানে চাপ দিলেই হবে।

    বশির একটা ওষুধ কোম্পানির এমআর। পুরো নাম মোহাম্মাদ বশির উদ্দিন। মাসে যা আয়, তাতে ঢাকা থেকে বরিশালে যাওয়ার লঞ্চের কেবিনে কথা ভাবতেই পারে না সে। বছরে দুটি করে ট্রেনিং হয় ওদের। তখন ও লঞ্চে ভ্রমণের সুযোগ পায়। অফিসের খরচে কেবিনে যাতায়াত করে। এবার ওর জন্য সিঙ্গেল কেবিন পাওয়া যায়নি বলে ডবল কেবিনই ঠিক করে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লঞ্চযাত্রা উপভোগ করে বশির। এবার প্রশিক্ষণ শেষে খুব সুন্দর একটা চামড়ার ব্যাগ, একটা স্মার্টফোন, একটা শার্ট আর প্যান্টের কাপড় আর পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছে। তাতেই বশির মহা খুশি। জামাকাপড় চেঞ্জ করে একটা ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরে নিল সে। এত আয়েশি জীবনযাপন সে চাইলেও করতে পারে না। বলতে গেলে অভাবেই মাস কাটে। নিজের বিলাসিতা বলতে একটু দামি সিগারেটটাই খায়। আর কোনো বদভ্যাস নেই। প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ধরাতে গিয়ে মনে হলো ভুল হয়ে গেছে। লঞ্চে ওঠার আগে সিগারেট কিনে ওঠা উচিত ছিল। লঞ্চের ক্যান্টিনে যে অস্বাভাবিক দাম চাইবে, তা শুনলেই তো চান্দি গরম হয়ে যাবে। নৌযাত্রার মজাটা নষ্ট হবে। অফিসের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকার তিন হাজার টাকা দিয়েই মা আর এমিলির জন্য কেনাকাটা করেছে বশির। তার পরও যে টাকা আছে, সেটা দিয়ে একটু বেশি দামে সিগারেট কিনতে খুব একটা কষ্ট পাবে না বলে মনে হলো ওর। লঞ্চ ছাড়তে এখনো খানিক বাকি। 





    সিগারেট শেষ করে রিমোট দিয়ে টিভির অন করতেই হিন্দি গান বেজে উঠল। বুঝতে পারল, সেন্ট্রালি যা চালানো হচ্ছে, ওকে তা-ই দেখতে হবে। এখানে দেওয়া ডিভিডি সেট শো মাত্র।
    কেবিনের জানালাটা খুলে দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা শেষ না হলে খোলা যাবে না। খুললে দুর্গন্ধে টেকা মুশকিল হয়ে যাবে। সন্ধ্যার কিছু পর লঞ্চ বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধ এরিয়া ছাড়ার পর বশির তার কেবিনের সামনে রাখা একটা চেয়ারে বসে সিগারেটের প্রয়োজনটা তীব্রভাবে অনুভব করল। একবার ভাবল, গিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসবে। পরে কেবিনে টাকা আনতে গিয়ে কেবিন-বয়ের কথা মনে পড়ল। কিন্তু বেশ কয়েকবার বেল টেপার পরও কারও সাড়া না পেয়ে বশির মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে নিজেই রওনা হলো। একা জার্নি খারাপ লাগে না। তবে সমমনা কাউকে পেলে আলাপ জমাতে মন্দ লাগে না তার। বশির যেমন ভালো বক্তা, তেমনি ভালো শ্রোতাও। তবে কখন ভালো বক্তা হবে আর কখন ভালো শ্রোতা, তা নির্ভর করে সঙ্গীর ওপর। কিন্তু এই লঞ্চে ওর তেমন কেউ মেলার সম্ভাবনা দেখছে না। অন্ধকার হয়ে এসেছে। নদীর মধ্যের মাছ ধরা নৌকাগুলো কুপি জ্বালিয়ে দিয়েছে। লঞ্চের ঢেউয়ে সেই সব নৌকা যখন ওঠানামা করে, দেখতে বেশ লাগে।

    ওর কেবিন দোতলায়। আর লঞ্চের দোকান নিচতলায়। লঞ্চে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়াটা আরেকটা মহাবিরক্তিকর ব্যাপার। ডেকের যাত্রীরা যে যেখানে পারে, শুয়ে থাকে। কখন কার গায়ে পা লাগে, বলা যায়? এর গা বাঁচিয়ে, ওর পা বাঁচিয়ে, বাঁকা হয়ে, লম্বা করে পা ফেলে যাও। শত চেষ্টার পরও যদি কারও গায়ে একটু লেগে যায়, অমনি শুরু করে হাউকাউ।

    নিচতলায় দোকানের সামনে বশির দেখল বেশ ভিড়। টিভিতে শাকিব খান আর অপু বিশ্বাসের মিউজিক ভিডিও চলছে। সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে এক পার্টি, এক পার্টি বেঞ্চে বসে চা-সিগারেট খাচ্ছে। কেউ কেউ বুকে হাত বেঁধে উদ্দেশ্যহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তবে দোকানে কেনাকাটা চলছে বেশ। বশির ভিড় ঠেলে ভুঁড়িওয়ালা দোকানদারের দিকে একটা পাঁচ শ টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল, এক প্যাকেট মার্লবোরো অ্যাডভান্স।

    পান খাওয়া ভুঁড়িওয়ালা দোকানদার ওর হাত থেকে পাঁচ শ টাকার নোটটা ওর চোখের দিকে তাকাতে তাকাতে নিল। তারপর লাইটের দিকে নোটটা ধরে আসল-নকল যাচাই করে বশিরকে বলল, অ্যাডভান্স নাই। লালডা আছে, মামা। দিমু?
    ঠিক আছে, দেন। আর দুই লিটারেরর একটা পানি দিয়েন।
    দোকানদার ওর হাতে খুচরা টাকাগুলো ফেরত দিতে দিতে বলল, মামায় না একটু আগে এক প্যাকেট হলিউড সিগারেট নিলেন?
    কথাটা না বুঝতে পেরে বশির দোকানদারকে পাল্টা প্রশ্ন করল, কী বললেন? বুঝিনি।
    আপনি তো একটু আগে এক প্যাকেট হলিউড সিগারেট আর একটা বড় রুটি নিলেন, আবার মার্লবোরো নিতেছেন। তাই জিজ্ঞেস করলাম আরকি।
    হলিউড সিগারেট? বশির একটু অবাকই হলো। আমি তো হলিউড সিগারেট খাই না। আমি হলিউড সিগারেট নেব কেন?
    দোকানদার তার পাশে বসা কিশোর সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে, মামায় না একটু আগে এক প্যাকেট হলিউড আর একটা বড় বন লইয়া গ্যালো?
    ১৩-১৪ বছরের কিশোরের চোখেও সন্দেহ। সে আমতা আমতা করে বলল, হ, তাই তো মনে অয়, কিন্তু ওই মামায় তো লাল রঙের গেঞ্জি পরা আছিল...ওই যে সেই লোক, ওই তো। বলে কিশোর ছেলেটি বশিরের ডান পাশের পেছনের দিকে আঙুল দিয়ে কাউকে দেখাল। দোকানদার বশির দুজনেই সেদিকে তাকাল। বশির হলদে লাইটের আলোয় দেখতে পেল প্রায় ওর মতোই দেখতে এক লোক দোকানদারকে বলছে, মামা, দুধ-চিনি বেশি দিয়া এক কাপ চা দাও।
    লোকটাকে দেখে বশির একটু অবাকই হলো। লোকটাও বশিরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবল। দোকানদারের সহকারী হেসে বলল, মামারা দুজনই দেখতে এক রকম। মনে অয় যমজ ভাই। খালি ওই পাশের মামার গেঞ্জিটা লাল আর এই মামার গেঞ্জিটা সাদা।
    হে হে, তাই তো দেখতেছি, বলল দোকানদার খয়েরি দাঁত বের করে।
    বশির আর লোকটাÑদুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল। দোকানদার লোকটার হাতে সদ্য বানানো ধূমায়িত চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে কেনাবেচায় মন দিল। বশির চলে যাবে, এমন সময় লোকটা বলল, ভাইজান, এক কাপ চা খেয়ে যান।
    বশির মুচকি হেসে বলল, না, থাক।
    লঞ্চ-ইস্টিমারে একধরনের ধাপ্পাবাজ থাকে। এরা নানা কৌশলে মানুষকে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। এমনকি খুন পর্যন্ত করে ফেলতে পারে। বশির বুঝতে পারছে না বিষয়টা কী। এই লোক যে দেখতে ওর মতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দোকানদারের সাথে এর কোনো যোগাসাজশ নেই তো আবার? কে বলতে পারে! হয়তো পাঁচ শ টাকার নোট দিয়ে এক প্যাকেট দামি সিগারেট কেনায় ওকে মালদার পার্টি ভেবেছে লোকটা। তাই কৌশলে একটা ধান্দা করার চেষ্টা করছে। আবার নিজের কৌতূহল চাপিয়ে রাখতে পারছে না বশির।
    আরে, থাকবে কেন, খান, এক কাপ চা খান। আপনি আর আমি দেখতে প্রায় এক রকম। সেটা মনে রাখার জন্য চলেন একসাথে দুজনে একটু চা খাই। সমস্যা কী?
    কথাটা খারাপ লাগল না বশিরের। ঠিকই তো, নিজের মতো আরেকজনকে দেখতে পারা কয়জনের ভাগ্যে জোটে? 
    বশির একটু হেসে বলল, ঠিক আছে, খাওয়া যায় এক কাপ।
    কিন্তু এই লোকের কোনো বদ মতলব আছে কি না, বোঝা মুশকিল। দেখা গেল আসলে দোকানদার আর এই লোক মিলে বশিরকে আগে থেকে ফলো করছে!
    এই মামা, আরেক কাপ চা দাও ওনারে।

    আমার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। ঢাকায়ই থাকি। আপনি?
    মনে হলো লোকটা গায়ে পড়ে কথা বলার চেষ্টা করছে। এটা বশিরের একদমই পছন্দ নয়। এক রকম দেখতে হলেই কি আর স্বভাব-চরিত্র এক হয়?
    আমার বাড়ি ফরিদপুর। একটা কোম্পানিতে জব করি। আপনাদের বরিশালে পোস্টিং। একবার ইচ্ছা করল বশির জানতে চায় সে পটুয়াখালীর লঞ্চ না উঠে কেন বরিশালের লঞ্চ উঠেছে। পরে মনে হলো, অনেক যাত্রীই লঞ্চ থেকে বরিশালে নেমে সেখান থেকে বাসে করে পটুয়াখালী যায়। তাতে সময় বাঁচে। বরিশাল থেকে লঞ্চে পটুয়াখালী যেতে যে সময় লাগবে, তার তিন ভাগের এক ভাগ সময় লাগবে বাসে করে যেতে।
    বরিশালেই থাকেন ফ্যামিলিসহ? সিগারেটে টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল লোকটা।
    হ্যাঁ। সংক্ষেপে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল বশির।
    বিয়ে করেননি? 

    আরে! বিয়ের খবরও নিচ্ছে। এবার ভেতরে ভেতরে রেগে গেল বশির। কেন, তোর কী দরকার? তুই কি মেয়ের বাপ? না তোর কোন বোন দিবি? তোর এত খবর নেওয়ার দরকার কী?
    বশির না ভাই বলার মধ্যে বিরক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। চা শেষ করে বশির চায়ের দাম দিতে গেলে একটুও আপত্তি করল না লোকটা। বুঝল, একটা বিরক্তিকর গরিবি হালের মানুষ, যা ওর স্বভাব-চরিত্রের সাথে একদমই যায় না। বশিরের মনে আগে একটা ধারণা ছিল যে এক রকম দেখতে হলে বুঝি ভেতরের মানুষটাও এক হয়। চাকরিতে ঢুকে সেই ধারণা প্রথমেই পাল্টে গেছে। ওর বড় মামার মতো দেখতে এক জোনাল ম্যানেজার ছিল, নাম কুদ্দুস। আচার-আচরণ কুকুরের চেয়েও খারাপ।
    হা হা হা, আমি ঢাকার কল্যাণপুরে থাকি। ভাই, আমার আয়-রোজগার কম হলেও বউ-বাচ্চা আছে। 
    এরপর নিজের হলিউডের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, এই জন্য আমি এই হলিউড খাই, আর আপনি মার্লবোরো খেতে পারছেন। বিয়ে করার পর আপনাকেও ব্র্যান্ড পাল্টে নিচে নামতে হতে পারে। হা হা হা।

    এবার রাগে পিত্ত জ্বলে গেল বশিরের। ও কেন কম দামি সিগারেট খায়, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আরে বাবা, তোর কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে কে? এখন মনে হচ্ছে উটকো ঝামেলা। একে তো ঝেড়ে ফেলতেই হবে। 
    চা খাওয়া শেষে বশির ভাবল, এখনই একে ঝেড়ে ফেলার সময়। একটা ছুতো দিয়ে চলে গেলেই হয়। কিন্তু কী একটা কৌতূহল কাজ করছে, সে জন্য ছাড়তেও পারছে না। লোকটা বলছে তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। থাকে ঢাকায়। আর বশিরের বাড়ি ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। পটুয়াখালীতে ওদের কোনো আত্মীয় আছে বলে জীবনেও শোনেনি। কিন্তু এই লোকের সাথে ওর চেহারার এত মিল কীভাবে, তা বশির বুঝে উঠতে পারছে না। অনেক সিনেমায় দেখেছে, যমজ ভাই ছোটবেলায় বিশেষ কারণে আলাদা হয়ে যায়। একসময় একসাথে হয়। এমনটা হয়নি তো? এ রকম নানা কৌতূহল থেকে বশির লোকটাকে ছেড়ে যেমন চলে যেতে পারছে না, আবার লোকটার বিরক্তিকর আচরণও ভালো লাগছে না।

    চলুন আমরা লঞ্চের মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলি। 
    এমন প্রস্তাবে বশির দোনামোনা করতে লাগল। লোকটার বয়স ওর কাছাকাছি। তবে জন্মতারিখটা জানতে পারলে ভালো হতো। সেটা হঠাৎ করে কীভাবে জিজ্ঞেস করে? ইচ্ছা-অনিচ্ছার দোলাচলে দুলতে দুলতে বশির লোকটার সাথে লঞ্চের মাথায় গেল। 
    আপনার কাছে বিষয়টি অদ্ভুত লাগছে না? রেলিংয়ে ভর দিয়ে বশিরের দিকে ফিরে বলল লোকটা।
    কোন বিষয়টা?
    এই যে আমি আর আপনি দেখতে প্রায় একই রকম?
    অদ্ভুত তো লাগছেই আর সে কারণেই তো এখনো আছে। না হলে কখন চলে যেত বশির! কিন্তু কৌতূহল দমিয়ে রেখে বলল, অত বেশি মিল আছে বলে আমার মনে হয় না। কিছু মনে করবেন না, আপনার জন্ম কত সালে?
    এইটি টুর ১৯ ফেব্রুয়ারি।
    এবার বশির অন্তত এতটুকু শিওর হলো যে কোনোভাবেই এই লোকের ওর যমজ ভাই হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, বশিরের জন্ম ৮৪-র ৭ এপ্রিল। যদিও কোনো দিন ওর জন্মদিন পালনের সুযোগ হয়নি, তার পরও সে তার আসল জন্মতারিখটা জানে। এই লোক বশিরের চেয়ে একটু পাতলা। তবে বয়স যে ওর চেয়ে বেশি, তা বোঝা যায়। আচ্ছা, বশির কি লোকটার সাথে থাকবে আরও? না নিজের কেবিনে চলে যাবে, বুঝতে পারছে না। এখনো বশির শিওর হতে পারেনি লোকটা মতলববাজ কি না। দুজন যেহেতু দেখতে এক রকম, সেহেতু বশিরের চেহারার বেচেও সে অনেক কিছু করতে পারে। সেরকম ঘটনাও তো সিনেমা-নাটকেই কত দেখেছে বশির।
    আপনি আমার চেয়ে বয়সে একটু বড়। আমার জন্ম এইটি ফোরের মাঝামাঝি, বলল বশির। 
    কী করেন আপনি? জানতে চাইল লোকটা।
    এই ছোটখাটো একটা চাকরি করি আর কি। নিজের পেশা সম্পর্কে অত ডিটেইল তথ্য দেওয়ার দরকারটা কী? 
    আপনি? আপনি কী করেন? পাল্টা প্রশ্ন করল বশির।
    আমি আছি একটা বিমা কোম্পানিতে।
    ও, সরি, আপনার নামটা জানা হলো না।
    আশিকুজ্জামান। আশিক বলে ডাকতে পারেন। সরি ভাই, গায়ে পড়ে গল্প করছি বলে আপনি আবার মনে মনে রাগ করবেন না তো?
    আরে নাহ! একাই ছিলাম। আপনার সাথে কথাটথা বলে তো আরও সময় কেটে যাচ্ছে। আমার নাম বশির আহমেদ।
    লোকটা সম্পর্কে আগের ধারণা অনেকটা পাল্টেছে বশিরের। একটা দূরত্ব রেখে আলাপ-গল্প করে সময় পার করলে মন্দ কী? বিমা কোম্পানির একটা ছাপোষা কর্মীর আর কী ক্ষতিই-বা করবে লোকটা?
    চলুন, আমার কেবিনের সামনে গিয়ে চেয়ারে বসে আরাম করে গল্প করি। বলেই ফেলল বশির।
    আপনি কেবিন নিয়েছেন নাকি? 
    প্রশ্নটা একটু তাচ্ছিল্যের সাথেই করল আশিকুজ্জামান। 
    গায়ে না মেখে বশির বলল, কোম্পানির খরচে যাতায়াত করছি, ভাই। নিজের কি আর অত টাকাপয়সা আছে যে কেবিনে যাব?

    প্রচুর সিগারেট খায় লোকটা। একটা শেষ হওয়ার অল্প কিছু পরই আরেকটা সিগারেট ধরায়। এই কম দামি সিগারেট একের পর এক কেমনে যে টেনে চলেছে, বোধে আসে না বশিরের। কেবিনের সামনে বসেছে তারা দুজন। বশির খেয়াল করল লোকটার মধ্যে তেমন প্যাঁচ নেই। আগের সেই বিরক্তি ভাবটা নেই বশিরের, তবে বিস্ময়টা রয়েই গেছে। দুজনের চেহারার মধ্যে স্বাস্থ্যগত তফাত সামান্যই। গভীরভাবে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না অতটা। এ লোক যে কথা বলতে এত পছন্দ করে, তা হয়তো পেশাগত কারণেই। অনার্সে ভর্তি হওয়ার বছরখানেক পর মাস ছয়েকের মতো একটা বিমা কোম্পানিতে কাজ করেছিল বশির। কত যে কথা বলতে হয়, তা জানা আছে ওর। কিছু কিছু ক্লায়েন্ট থাকে, যাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় সব বুঝেছে, এখনই বিমা করতে রাজি হয়ে যাবে। কাগজপত্র বের করে প্রিমিয়াম জমা দিতে চাইবে। কিন্তু সব শেষে বলে, আপনি অমুক দিন আবার একটু আসেন।
    বাহ! তাও তো আপনার কোম্পানি আপনাকে লঞ্চের কেবিনে যাতায়াত করায়। আর আমার বিমা কোম্পানি শুধু স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন দেখতে দেখতে এখন অন্ধ হওয়ার পালা, ভাই।

    বশিরের কি কম কষ্ট হয় নাকি? সারাক্ষণ ডাক্তারের পেছনে পড়ে থাকতে হয়। দিনরাত ২৪ ঘণ্টার ধ্যানজ্ঞান থাকে ডাক্তার, ডাক্তার আর ডাক্তার। একটা ওষুধ প্রেসক্রাইভড করাতে কত কী না করতে হয়! কোম্পানির দেওয়া স্যাম্পল, নানা ধরনের গিফট- এসব তো আছেই, তার ওপর নিজে থেকেও করতে হয় নানা উপকার। বশিরকে বাজার পর্যন্ত করে দিতে হয়েছে। কোম্পানি বাইক দেওয়ার পর শরাফত ডাক্তারের নাইনে পড়া মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতে হয়। তবে শরাফত ডাক্তার ওর কোম্পানির ওষুধ কমবেশি লেখে। সিরাজুল হক ডাক্তারের পসার বেশ। প্রচুর রোগী। তাকে ওষুধ লেখানোর জন্য কী না করেছে বশির? ছেলের জন্মদিনে গিফট দিয়েছে, তাদের ম্যারিজ ডেতে নিজের বেতনের টাকা দিয়ে শাড়ি-পাঞ্জাবি পর্যন্ত কিনে দিয়েছে। সেই শাড়ি-পাঞ্জাবি পরেই তারা ম্যারিজ ডের প্রোগ্রাম করেছে। বশিরকে দাওয়াত দিয়েছে ঠিকই কিন্তু কথাটি পর্যন্ত বলেনি। কী হারামির হারামি! বশির বেশি ঘৃণা করে এই ডাক্তার জাতিকে।


    আপনার ফ্যামিলি কি পটুয়াখালী থাকে, না ঢাকায় থাকে? জানতে চাইল বশির।
    ঢাকা থাকে। পটুয়াখালীতে তেমন কেউ থাকে না। আচ্ছা, এই যে আমরা দুজন দেখতে প্রায় একই রকম, এটা আপনার কাছে কেমন লাগছে? জানতে চাইল আশিক।
    আসলে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কিছু নেই। শুনেছি তো পৃথিবীতে অ্যাট আ টাইম এক রকম দেখতে তিনজন মানুষ থাকে। আমরা দুজন। তৃতীয়জনকে খুঁজে বের করতে হবে। হা হা হা।
    এরপর দুজন চেয়ারেই বসে অনেক সময় কথা বলল। একসময় বশির বুঝতে পারল, আর যা-ই হোক, এই লোকের বদ মতলব নেই। এর সাথে গল্প করে কাটালে মন্দ কী? আলাপের একপর্যায়ে বশির বলল, আপনি রেগুলার বাড়িতে যাতায়াত করেন বুঝি?
    না ভাই, আমি আজ প্রায় বিশ বছর পর বাড়িতে যাচ্ছি। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল আশিক।
    আশিকের দেখাদেখি আজ বশিরও বেশি সিগারেট খাচ্ছে। এখানে বসে এর মধ্যেই দুটো সিগারেট শেষ করে ফেলেছে। আরেকটা ধরাতে ইচ্ছা করছে। নিজের প্যাকেট থেকে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, বলেন কী! কেন? বিশ বছর পর কেন যাচ্ছেন, এত দিন যাননি কেন?
    আসলে হয়েছে কি, আমার এক চাচা ছাড়া এই দুনিয়ায় রক্তের আর কেউ নেই।
    ওহ! আই অ্যাম সরি।
    না না, সরি বলার তো কিছু নেই।
    তা এত দিন পর কেনই-বা যাচ্ছেন?
    ভাই, সে তো এক বিরাট গল্প। আপনার শোনার ধৈর্য হবে?
    নিশ্চয়ই, আপনার যদি বলতে আপত্তি না থাকে।
    না, আপত্তি নেই। অনেক ট্র্যাজিক স্টোরি। ১৯৯৮ সালে একটা লঞ্চ ডুবে ৩১ জন মানুষ মারা গিয়েছিল। আপনার মনে আছে?
    নাহ।
    আপনার মনে না থাকারই কথা। কিন্তু আমার মনে আছে। কারণ, ওই লঞ্চ আমার জীবন থেকে সবাইকে কেড়ে নিয়েছে। আমার বাবা, মা আর আমার একমাত্র বোন ফিরছিল ওই লঞ্চে। সবাই মারা যায়। আমি বাড়িতে থাকায় বেঁচে যাই।
    মাই গড। তারপর? 

    তারপর শুরু হয়ে গেল আমার সিনেমাটিক লাইফ। আমার চাচা আর তার দুই ছেলে মিলে আমাদের সব সম্পত্তি দখল করে নিল। আমার দাদা আরশাদ আলী তালুকদারের বিশাল তালুক ছিল পায়রা বন্দর এলাকায়। হিসাব অনুযায়ী তার অর্ধেক আমাদের, আর অর্ধেক চাচার। কিন্তু আমার বাবা-মা মারা যাওয়ায় পর আমার চাচা সব সহায়-সম্পদ দখল করে নেয়। পথের কাঁটা একমাত্র আমাকে যখন তারা হত্যার প্ল্যান করে, তখন আমি পালিয়ে চলে যাই আমার নানার বাড়ি। সেখানে আমার এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মামা আর নানি থাকত। আমি আমার নানিবাড়িতে থেকে কোনোভাবে আইএ পরীক্ষা দিতে পারি। পরীক্ষার পরপরই আমার নানি মারা গেলে আমি ঢাকায় চলে আসি। শুরু হয় বেঁচে থাকার লড়াই। সে লড়াইয়ে আমার বিশাল প্রতিপক্ষের সামনে আমি একমাত্র যোদ্ধা। ঢাকায় আসার পর থেকে চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটা মুহূর্ত আমার কীভাবে যে কেটেছে, তা একমাত্র আমি আর একমাত্র আল্লাহ পাকই জানে। ওই সময়ে বেশির ভাগ দিনই আমার না খেয়েই কাটাতে হয়েছে। এক মুঠো ভাতের জন্য আমি ঢাকা শহরে টয়লেট পর্যন্ত সাফ করেছি। বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আশিক। পানি চলে আসে বশিরের চোখেও।

    লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ আসছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বশির নিজের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল আশিকের দিকে।
    চলমান লঞ্চে লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাতেও একটু কসরত করতে হলো আশিককে। বশিরের দিকে লাইটার এগিয়ে দিতে দিতে আশিক বলল, সরি বশির সাহেব, আপনাকে আমার ব্যক্তিগত কাহিনী শুনিয়ে বিরক্ত করছি।

    আরে না, কী যে বলেন? বিরক্ত করবেন কেন? আপনাকে দেখলে বোঝাই যায় না আপনি ভেতরে এত বড় ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন। কী অদ্ভুত মানুষের জীবন, না?
    হ্যাঁ, সত্যিই অদ্ভুত। তবে একটা বিষয় কি জানেন, বশির সাহেব, ছোটবেলা থেকে আমি একটা কথা খুব বিশ্বাস করতাম, এখনো করি, ভবিষ্যতেও করব, কথাটা কী, জানেন?
    কী?
    মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়
    আড়ালে তার সূর্য হাসে
    হারা শশীর হারা আলো
    অন্ধকারেই ফিরে আসে
    হ্যাঁ, আমি নিজেও বিশ্বাস করি। তবে আস্থা রাখতে পারি না।
    আমি যেমন বিশ্বাস করি, তেমন আস্থাও রাখতে পারি। আর আস্থা ছিল বলেই হয়তো এত দিন পর আমার কপাল খুলেছে।
    মানে?
    মানে হলো, ভাগ্য আমার সুপ্রসন্ন হয়েছে। আমার চাচার মতি ফিরেছে। সে এখন আমাকে আমার ভাগ ফিরিয়ে দিতে চায়।
    বলেন কী!
    হ্যাঁ, চাচার অনেক বয়স হয়েছে। যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। চাচার দুই ছেলে প্রচুর অর্থ-সম্পদ হাতে পেয়ে নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। বড় ছেলেটা রাজনীতিতে জড়িয়ে একটা খুনের দায়ে যাবজ্জীবন জেল খাটছে। আরেকজন প্রতিপক্ষের হামলায় পঙ্গুত্ব বরণ করে অসাড় জীবন যাপন করছে। এখন চাচা চাইছে আমি আমার সম্পত্তি বুঝে নিই। আর যদি বুঝে নিই, তাহলে চাচা মরে গিয়ে শান্তি পাবে। আর না হলে সে দোজখবাসী হবে বলে তার ধারণা।
    মাই গড! এ তো আপনার জন্য এক বিশাল সুসংবাদ।
    সুসংবাদ তো বটেই।
    আপনি তো নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত। এই বিশাল জমিজমা দিয়ে আপনি কী করবেন?
    আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধারাতে আশিক বলল, আমাদের জমিজমা বা সম্পদ এখন তো আর আগের মতো ওই অবস্থায় নাই। পায়রা বন্দর গভীর সমুদ্রবন্দরের নাম শুনেছেন?
    হ্যাঁ। সে তো বিশাল বড় প্রজেক্ট।
    হ্যাঁ। আমার জমি বেশির ভাগ ওখানে। ফলে চাচা জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে। এখন সেই জমি লিকুইড মানি। আমি যাচ্ছি আসলে সেই টাকার ভাগ বুঝে নিতে। সেটাই বুঝলাম চাচার চিঠিতে।
    ও, আচ্ছা আচ্ছা। তা কী পরিমাণ টাকা হবে? করব না করব না করেও শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা না করে থাকতে পারল না বশির।
    আমাদের যে সম্পত্তি থাকার কথা, তার ফিফটি পার্সেন্টের বাজারদর এখন আট-দশ কোটি টাকা।
    ও মাই গড! বলেন কী, আশিক ভাই! আপনি তো তাহলে রীতিমতো কোটিপতি হয়ে গেলেন। বাহ! আপনার দুঃখের দিন শেষ।
    তা বলতে পারেন। এখন যদি একটু সাজাতে পারি নিজের জীবনটা। অনেক কষ্ট করেছি, ভাই জীবনে, অনেক কষ্ট! আপনাকে যা বলেছি, তা হয়তো বলা সম্ভব ছিল। আর যেসব অবর্ণনীয় কষ্ট রয়েছে, তা হয়তো কোনো দিন কাউকে বলতেই পারব না।
    মুহূর্তেই সামনের লোকটা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে গেল বশিরের। একটা শ্রদ্ধার ভাব চলে এল আশিকের প্রতি। এই লোক এত বড়লোক, ভাবতেই বশিরের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল। আট-দশ কোটি টাকা! জীবনে একবার বশির বারো লাখ টাকা দেখেছিল। তা-ও এক লোক একটা চটের ব্যাগে করে ব্যাংকে জমা দেওয়ার সময় বশির দেখেছিল। পাঁচ শ টাকার নোটের চব্বিশটা বান্ডিল। এত টাকা আর কখনো একসাথে বশিরের দেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এ তো লাখের গল্প নয়! কোটির গল্প, আট-দশ কোটি! এত টাকা দিয়ে কী করবে লোকটা? 

    টাকার লোভ যে বশিরের একেবারে নেই, তা নয়। সবার থাকে। কম আর বেশি। বশির সব সময় মনে মনে ভেবেছে, এক কোটি টাকা হলে মায়ের আর এমিলির জন্য ফরিদপুরে একটা বাড়ি করে দেবে আর পঞ্চাশ লাখ টাকা ব্যাংকে রাখলে যে সুদ আসবে, তা দিয়ে সারা জীবন আরামে পার করতে পারবে। কিন্তু এই লোক আট-দশ কোটি টাকা দিয়ে কী করবে, ভেবে পায় না সে। একবার ভাবল, জিজ্ঞেস করবে। পরে আবার ভাবল, না, একদম ছোটলোকি প্রশ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না বশির। মনে মনে ভাবে, লোকটাকে একটু খাতির করা উচিত। কেবিনের ভেতরে গিয়ে মায়ের জন্য কেনা আনার নিয়ে এল দুজনে খাবে বলে। আনার কাটার ছুরির জন্য বেল টিপে বেয়ারাকে ডাকল। একটা ছুরি, সাথে রাতে দুজনের খাবার অর্ডার দিল বশির। বেয়ারা ছুরি দিয়ে চলে গেলে প্লেটের ওপরে রেখে আনার কাটতে কাটতে বশির বলল, রাতে আমার সাথেই খাবেন। আর আমার কেবিনে যেহেতু দুইটা সিট আছে, আমার সাথেই থাকবেন। সমস্যা আছে কোনো?
    আরে না, ভাই। সমস্যা কিসের? তবে আপনার আবার উপদ্রব হয়ে না যাই।
    ছি! উপদ্রব হবেন কেন? কী বলেন? ছি ছি ছি! আপনি থাকায় জার্নিটা বরং ভালো লাগছে আমার।
    দুজনে মিলে একটা আনার খেলেও প্লেট থেকে বশির আশিককেই সিংহভাগ খেতে দিয়েছে। হাত ধোয়া যখন শেষ, বশির খেয়াল করল, বেসিনের সামনের আয়নায় ওর পেছনে যে মুখটি আছে, তার সাথে কম করে হলেও ৯০ ভাগ মিল আছে তার। বশির সামান্য একটু ফরসা আর ওয়েটে হয়তো কেজি তিন-চারেক বেশি হবে। এর বেশি কিছু নয়। অনায়াসে একজন বলে আরেকজনকে চালিয়ে দেওয়া যাবে। 

    বশিরের মতো দেখতে একটা ছেলে, ওর বয়সী, হঠাৎ শুনল, সে আট-দশ কোটি টাকার মালিক। কেমন লেগেছিল সংবাদটা জেনে? এটা তো জানতে চাইতেই পারে বশির। নাকি তাতে ও লোভী ভাববে ওকে? আচ্ছা, বশির যদি হঠাৎ এমন কিছু টাকা পেত, তাহলে কী করত সে? 

    নদীভাঙনের পর বশির আর ওর ছোট বোনকে নিয়ে কি ঘাটে ঘাটে কম পানি খেয়েছে ওর বিধবা মা? আজ মামার বাড়ি তো কাল খালার বাড়ি, পরশু চাচার বাড়ি। বশির তখন ক্লাস এইটে পড়ে। একবার মাস ছয়েকের জন্য বশির ওর দূরসম্পর্কের এক মামার চালের গুদামে ঘুমানোর সুযোগ পেল। তখন মা আর এমিলি থাকত ওই মামার বাড়িতেই। মা কাজ করত। তখন বশিরের বয়স ১৩-১৪ বছর। দেখতে-শুনতে বশির ছোটবেলা থেকেই নাদুসনুদুস আর ফরসা। বশির ঘুমাত গুদামের পেছনে চার হাত লম্বা আর দুই হাত চওড়া একটা খুপরির মধ্যে। মাথার ওপরে একটা খাঁচা ফ্যান চলত। আর গুদামে বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকত। শফিক মামা একদম সকালবেলা গুদামে যেত। যখন থাকা শুরু করেছে, তার তিন-চার দিন পরের কথা। প্রতিদিন শফিক মামা আসার আগেই ঘুম থেকে জেগে যেত সে। সেদিন আর জাগতে পারল না। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ টের পেল কেউ তার সারা শরীরে-পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চোখ খুলে দেখে শফিক মামা। ও ধড়মড় করে উঠে বসে দেখে, শফিক মামা পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। 
    কি ভাইগনা, এহনো হুইয়া রইছো। থাহো থাহো, হুইয়া থাহো।



    হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে মামাকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আবার শুয়ে পড়ল বশির।
    আমিও একটু তোমার পাশে হুই, বলে শফিক তার পাশে শুয়ে পড়ল। একসময় বশিরের গায়ে একটা পা তুলে দিল মামা। নিজের চেয়ে তিন গুণ বেশি বয়সের আর দশ গুণ শক্তিশালী শফিক সেদিন বশিরকে প্রথম বলাৎকার করেছিল। জানোয়ারটা ছয় মাস ধরে ওকে ভোরবেলা বলাৎকার করেছে। পাশের আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিং থেকে দুই ফুটের একটা রড এনে রেখেছিল বশির। কিন্তু মা আর এমিলির কথা ভেবে রডটা ব্যবহার করতে পারেনি সে। 
    তবে জীবনে সে আর কিছু করুক বা না করুক, শফিককে সে খুন করবে, এমন প্রতিজ্ঞা থেকে সরেনি বশির একচুলও। এর প্রতিশোধ বশির না নিয়ে থাকবে কী করে? 

    হ্যাঁ, এ রকম কিছু টাকা পেলে, তা যা লাগে, শফিককে খুন করবেই বশির। মাকে আর এমিলিকে নিয়ে থাকার জন্য সুন্দর একটা দোতলা বাড়ি করবে। নদীভাঙনের পর থেকে নিজের টাকায় বাসা ভাড়া নেওয়ার আগ পর্যন্ত এক রাতের জন্য শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি বশির। মা-ও ঘুমাতে পারেনি। সব সময় একটা ভীতি তাড়া করে বেড়িয়েছে সবাইকে। মায়ের বয়স হয়েছে। তার ওপর শরীরে যে রোগ বাসা বেঁধেছে, তাতে কদিন বাঁচে, কে জানে! এখন যদি মাকে নিজের তৈরি একটা বাড়িতে রাখতে পারে, তবেই বশিরের শান্তি। শেষে একটা ভালো ছেলে দেখে এমিলিকে বিয়ে দিয়ে তারপর না হয় ভোরের স্কুলযাত্রীকে নিয়ে ভাবা যাবে। তার আগে টাকাগুলো ব্যাংকে রাখতে হবে। কিন্তু কোন ব্যাংকে রাখা যায়? এত্তগুলো টাকা কোন ব্যাংকে একসাথে রাখলে ওকে সন্দেহ করবে না ব্যাংক? তার চেয়ে নিজের কাছে লুকিয়ে সেভ করে রাখাই ভালো। আস্তে আস্তে বের করে কাজ করতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে এ ব্যাংকে ও ব্যাংকে কিছু মায়ের নামে, কিছু এমিলির নামে রেখে দিলে আর কারও কোনো সন্দেহের সুযোগ থাকবে না।

    হ্যাঁ, তা-ই করতে হবে। সেই সাথে এদিক-সেদিকে চুপচাপ জমি কিনে টাকা আটকে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। কিন্তু টাকা? টাকা কোথায়? কোন টাকার কথা ভাবছে সে? মাথা ঠিক আছে তো? ভাবনার গভীর থেকে বাস্তবে ফিলে আসে বশির। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে তার। এত্ত টাকা? আট-দশ কোটি?
    আবার দুজন মুখোমুখি বসে গল্প শুরু করল। 
    আমি তো এতক্ষণ নিজের গল্প বললাম। এবার আপনার কিছু কথা বলেন শুনি। মুখে হাসি ধরে রেখেই সিগারেটে টান দিল আশিক।

    বশির এখন শুধুই শুনতে চায়। তার বলার কিছু নেই। তার চোখের সামনে এখন শুধুই বান্ডিল বান্ডিল এক হাজার টাকার নোট। লাল লাল বান্ডিল! 
    আমার তেমন কিছুই বলার মতো নাই জীবনে। আপনি আপনার কথা বলেন। আপনার ছোটবেলা, বেড়ে ওঠা। আপনার জীবন তো অনেক পোড়খাওয়া। গল্প বলেন না শুনি।
    তা খারাপ বলেননি। অনেক পোড়খাওয়া জীবন আমার। আমার জন্ম ওই বাড়িতেই।
    এরপর বশির আশিকের কাছ থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গল্প শুনল। আশিকের বেড়ে ওঠা, প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, বাবা-মা হারানো, চাকরি, বিয়ে, বন্ধুবান্ধবÑসব খুঁটিনাটি। যা বাদ গেছে, তা-ও নিজে থেকে প্রশ্ন করে জেনে নিল বশির। কোন বন্ধুর সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল, কে আশিককে কী নামে ডাকত, ওরা ছোটবেলায় বিশেষ কী খেলত, কোথায় খেলত, কার সাথে কার জুড়ি ছিল, কার সাথে কার আড়ি ছিল, ভাব ছিলÑসব। রাত একটার দিকে কেবিনে ঢুকে দুজন দেশি মুরগির ঝোল, পাতলা ডাল, সালাদ, সাদা ভাত পেট পুরে খেয়ে সিগারেট খেয়ে আশিকের তাড়াতেই দুজন দুই খাটে শুয়ে পড়ল। শোয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় আশিক নাকডাকা শুরু করল।

    বশির ঘড়িতে দেখল, রাত একটা তেত্রিশ। লঞ্চে সারা রাতই কেউ না কেউ জেগে থাকে। বিছানা ছেড়ে কেবিনের বাইরে এসে বাইরে থেকে দরজাটা লাগিয়ে রেলিংয়ে ভর দিয়ে নদীর দিকে তাকাল বশির। এখন কার্তিক মাস। বাইরের ঠান্ডা বাতাস মুখে এসে ঝাপটা মারছে। লঞ্চ এখন কোথায় আছে, জানে না বশির। সামনে তাকালে শুধু কালো জল দেখা যায়। ঠান্ডা হিমশীতল জল। নদীর কোনো সীমানা চোখে পড়ছে না। নদীর মধ্যে ভাসমান লাইট দিয়ে চরের সীমানা দেওয়া। কেবিনের সামনের চেয়ারগুলোয় এখন কেউ আর নেই। একটু আগে একটা মেয়ে বের হয়ে বাথরুমে গেছে। চারদিক নীরব। লঞ্চের ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল বশির। এখন তার যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। কী করবে, কীভাবে করবে এবং কেন করবে সব প্ল্যান করে রেখেছে সে। জীবনে সুযোগ বারবার আসে না। দরজাটা খুলে ভেতরে এসে সে আরেকবার দেখে নিল আশিকের মুখ। শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। গভীর ঘুম, দেখলেই বোঝা যায়। পায়ের কাছে রাখা কম্বলটা গলা পর্যন্ত টেনে দিল বশির। আরামে ঘুমাচ্ছে। আরও আরাম করে ঘুমাক বেচারা। একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা জ্বালাল বশির। এখন এটুকু বেশি সিগারেট খেলে ক্ষতি কী? ক্ষতি হলেও সব ঠিক পুষিয়ে নেওয়া যাবে। একটু মুচকি হাসল সে। মনে মনে তারিফ করল নিজের বুদ্ধির।
    রাত দুইটার একটু পর বশির নিজের মাথার বালিশটা নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরল ঘুমন্ত আশিকের মুখ। যে স্লিপিং পিল একটা খেলে মানুষ ঘুম থেকে আর সোজা হয়ে বসতে পারে না, সেই পিল বশির আশিকের ভাতের সাথে মিলিয়েছে একটা, ডালের সাথে দুইটা। প্রায় অচেতন আশিক পায়ে মাত্র দুইবার টান দিয়ে প্রাণ ত্যাগ করল। এলএমএফপি পাস করা বশির যখন শতভাগ নিশ্চিত হলো, আশিকের শরীরে আর প্রাণ নেই, তখনই তার মনে হলো, সে আট-দশ কোটি টাকার মালিক। কতগুলো এক হাজার টাকা নোটের বান্ডিল! ভাবতে গিয়ে জ্ঞান হারাল সে।

    ঠকঠক শব্দে সংবিৎ ফিরে পেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল বশির। মুহূর্তেই সব কথা মনে পড়ে গেল তার। কেউ দরজায় নক করছে। কোনো সমস্যা নেই। আশিককে দেখলে মনে হবে ঘুমাচ্ছে। কেবিনের দরজা খুলে বাইরে এসে সে দেখে, কেউ নেই। বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল বশিরের। কে নক করল তাহলে? দরজা লাগিয়ে ভেতরে এসে মোবাইলে দেখল, রাত তিনটা উনিশ। যা করার দ্রুত করতে হবে। রুমের লাইট জ্বালাল একবার সবকিছু ঠিকঠাক দেখে নেওয়ার জন্য। কাজ যা করার, অন্ধকারেই করতে হবে। মৃত আশিকের দিকে ফিরে তাকাতেই বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল। বশিরের মনে হলো, সে নিজেই মরে পড়ে আছে। সাথে সাথে লাইট বন্ধ করে দিল। এ দৃশ্য চোখে দেখা মুশকিল। নিজের লাশ কি কেউ দেখতে পারে? বশিরের মনে হলো, আবার সেই ঠকঠক শব্দটা আসছে। একটু ভয় পেল বশির। আবার কেবিনের লাইট জ্বালিয়ে দেখল, আশিকের হাতের একটা আঙুল কেবিনের দেয়ালের সাথে ঠকঠক করে বাড়ি খাচ্ছে।

    আধা ঘণ্টার মধ্যে বশির আশিকের হাত-পা সব বেঁধে ফেলল মায়ের জন্য কেনা শাড়ি ছিঁড়ে। এখন লাশটা ঝুপ করে নদীতে ফেলে দিলেই ব্যস, কেল্লা ফতে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, আশিকের চেহারাটা বিকৃত করে তারপর ফেলতে হবে। না হলে কেউ যদি চিনে ফেলে? কিন্তু আবার মনে হলো, যদি রক্ত পড়ে। মায়ের শাড়ি শেষ। এবার এমিলির জন্য কেনা শাড়িটা এনে আশিকের মাথার নিচে বিছিয়ে বেয়ারার দেওয়া ছুরিটা দিয়ে ফালা ফালা করে দিল মুখটা। ছিলে নিল অনেকখানি মাংস। যত রক্ত বের হবে ভেবেছিল, তত বের হয়নি। চুয়ে চুয়ে কিছু রক্ত পড়েছে শাড়িতে। বিছানায় পড়ল কি না, তা-ও খেয়াল করে দেখেছে বশির। শেষে শাড়ি দিয়ে মুখটা ভালো করে প্যাঁচিয়ে রুমের বাইরে এসে ঠান্ডা মাথায় হাত ধুয়ে কেবিনের বারান্দায় ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখল, কেউ নেই। এখন লাশটা এনে নদীতে ফেলতে হবে। কিন্তু মৃত মানুষ যে এত ভারী হয়, তা জানা ছিল না বশিরের। কেবিন থেকে বারান্দার রেলিং পর্যন্ত হাত চারেক পথ আনতে ঘাম ছুটে গেল তার। কার্তিক মাসেও টপটপ করে ঘাম পড়ছে কপাল বেয়ে। লাশটা একদম কিনারায় নিয়ে নিচে তাকাল বশির। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে একটা ধাক্কা দেওয়ার তিন-চার সেকেন্ড পরই ধুপ করে একটা শব্দ শুনতে পেল। সেই সাথে চোর চোর বলে গুঞ্জন উঠল নিচের ডেকে। আর কিছু জানতে চায় না বশির। কেবিনে ঢুকে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

    দরজায় প্রচণ্ড করাঘাতে ঘুম ভেঙে গেল বশিরের। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে তার মনে পড়ে গেল, গত রাতে সে একজনকে খুন করে আট-দশ কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। চারদিকে প্রচণ্ড শব্দ, মানুষের হাঁকডাক, কুলির চিৎকার-চেঁচামেচি, অনেক হুইসেল-হর্ন। তাহলে কি সব জানাজানি হয়ে গেছে? পুলিশ চলে এসেছে? চারদিকে এত গ্যাঞ্জাম কিসের? দরজায় ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে কেউ একজন। ক্রমাগত জোরে জোরে ধাক্কাচ্ছে। এ পুলিশ না হয়ে যায় না। পালানোর পথ নেই। কিন্তু পুলিশ খবর পেল কী করে?
    মামা, খোলেন, বরিশাল চইল্যা আইছে। আমনে নামবেন না?
    হঠাৎ টের পেল বশির, লঞ্চ চলছে না। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। রুমের আলো দেখে বুঝতে পারল, দিন হয়ে গেছে। মোবাইলে তাকিয়ে দেখল, ছয়টা বাজতে এখনো নয় মিনিট বাকি। লঞ্চ কি আজ অনেক আগে আগে চলে এসেছে? বশির গিয়ে দরজা খুলে দেখে, বেয়ারাটা দাঁড়িয়ে আছে একটা খয়রি রঙের চাদর গায়ে দিয়ে। সকালবেলা ভালোই ঠান্ডা অনুভব করল বশির।
    মামা, কত ঘুম ঘুমান? লঞ্চ তো বরিশাল ঘাটে চইল্যা আইছে। নামবেন না?

    মুহূর্তেই বুক থেকে পাথর সরে গেল বশিরের। বরিশাল চলে এসেছে! তার আর ধরা পড়ার ভয় নেই। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রুমের সবকিছু গুছিয়ে বেয়ারাকে দুটি এক শ টাকার নোট বখশিশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে শুনল যাত্রীদের অনেকেই একটা বিষয় নিয়ে আলাপে মগ্ন, আর সেটা হলো, চোর। কাল ভোররাতে কেবিন থেকে বড় কিছু চুরি করে কোনো এক চোর নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। এটা লঞ্চের নৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু আসল বিষয় কী, তা বশির ছাড়া কেউ জানে না। কেউ বলছে, আরে, আমি নিজের চোখে দেখছি হাতে বিশাল বড় একটা ব্রিফকেস নিয়া লাফ দিছে। কেউ একজন বলছে, একজন না, লগে আরও কেউ ছিল। এই সব কাজ একা হয় নাকি?

    বশিরের বুকটা দুরুদুরু করছে। কাল তো অনেকেই আশিকের সাথে বশিরকে দেখেছে। কেউ ওর দিকে তাকিয়ে নেই তো? বশির দেখল, নাহ, কেউ তার দিকে খেয়াল করছে না। সে নিজেকে সামলে স্বাভাবিকভাবে ঘাটে নামার সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল। নিজেকে মিলিয়ে দিতে চাইল ভিড়ের মধ্যে। এখনো অনেক যাত্রী নামছে। সিঁড়ির সামনে লম্বা লাইন। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে আসতে আসতে বশিরের ভয় আরও কেটে গেল। কারণ, গল্পের বেশ ডালপালা ছড়িয়েছে। মনে মনে হাসল বশির। নিজেকে এখন তার কোটিপতি বশির আহমেদ মনে হচ্ছে। না, সে মাকে আর এমিলিকে নিয়ে ফরিদপুরেও থাকবে না। দূরে কোথাও চলে যাবে। নিজের নাম দেবে চৌধুরী এম বশির।

    লঞ্চ থেকে নেমেই শুনতে হলো ঘাটে দাঁড়ানো রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচলিত ইজিবাইকের ড্রাইভারদের চিল্লাফাল্লা - কাউনিয়া, নতুল্লাবাদ, রূপাতলি...
    লঞ্চঘাট থেকে এই সময় সাধারণত বশিরের বাসার দিকে রিকশা বা ইজিবাইক যেতে চায় না। যাত্রী বেশি থাকে না বলে ড্রাইভারদের পোষায় না। একাই একটা ইজিবাইক নিতে হবে মনে হচ্ছে তার। টাকা একটু বেশি চাইবে হয়তো। কিন্তু তাতে কি? বশির তো এখন কোটি টাকার মালিক! এক-দুই লাখ টাকার মালিক নয়, আট-দশ কোটি টাকার মালিক সে। চল্লিশ টাকার ভাড়া দেড় শ টাকায় ঠিক করে ব্যাগ নিয়ে উঠে বসার পর যখন পার্কিং থেকে ড্রাইভার অটো বের করতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি একজন লোক একটা সাইড ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে ওদের অটোর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, হাজির ট্যাক যাবেন না, ভাই? প্লিজ, আমাকে একটু নিয়ে যান। নইলে আমি যেতে পারব না। 
    বশির তাকিয়ে দেখল, ৩৪-৩৫ বছরের এক ভদ্রলোক ইন করা, চশমা পরা, দেখতে অনেকটা ব্যাংকের কর্মকর্তা বলে মনে হয়। আবার কোনো উটকো ঝামেলা হবে না তো? এই লোক সাথে গেলে ভাড়া কিছুটা কম পড়বে বটে, কিন্তু বশির এখন নিজেকে সবার কাছ থেকে লুকাতে চায়। ড্রাইভার বশিরের দিকে তাকিয়ে বলল, মামা, স্যাররে লইয়া লই। স্যার তো হাতেম আলী কলেজের টিচার। 
    বশির কোনো কথা না বলে মাথা নেড়ে সায় দিল। 

    লোকটা হেসে তার সামনে বসতে বসতে বলল, এখান থেকে এত সকালে কোনো কিছু পাওয়া খুব মুশকিল!
    এ কথার কোনো জবাব দিল না বশির। অটো চলতে শুরু করল। বশির পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা নিয়ে প্যাকেটটা লোকটার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, চাইলে নিতে পারেন। 
    লোকটা একটু ইতস্তত করে সিগারেট নিয়ে যখন ধরাতে যাবে, তখন দেখল কার্তিক মাসের বাতাসে চলন্ত অটোতে সিগারেট জ্বালানো মুশকিল। অটোটা একটু সাইড করতে বলল বশির। একটা কাঠি দিয়ে দুজনে সিগারেট ধরিয়ে সহযাত্রী বলল, সাত্তার আপনারে খুব জ্বালিয়েছে রাতে, তাই না?
    কোন সাত্তারের কথা বলছেন?
    ওই যে, যার সাথে লঞ্চে দেখলাম আপনাকে। আপনার মতো দেখতে, ওই সাত্তার।
    মুহূর্তে ধড়াস করে উঠল বশিরের বুক। এই লোক কী বলছে! দেখেছে নাকি কিছু? এ লোক নিশ্চয়ই আশিককে চেনে না। চিনলে নাম ভুল করত না।
    ও, আপনি চেনেন নাকি ওনাকে?
    চিনব না মানে, সে আমার ক্লাসমেট!
    তাই নাকি?
    হ্যাঁ, আমরা একসাথে পড়তাম বিএম কলেজে। আমি সাইকোলজিতে ছিলাম আর ও ছিল বাংলায়। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। সেকেন্ড ইয়ারের শেষ দিকে ওর বাবা মারা যাওয়ায় আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি। খুব নিডি ফ্যামিলির ছেলে সাত্তার।
    তাই নাকি? ওনার নাম কি সাত্তার? 
    হ্যাঁ, ওর নাম সাত্তার। খাতাপত্রে ওর নাম আব্দুস সাত্তার মৃধা। তবে আশিকুজ্জামান ছদ্মনামে ও একসময় কবিতা-টবিতা লিখত পত্রপত্রিকায়।
    তাই নাকি? কিন্তু... 
    সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেছে বশির।
    বুঝেছি, আপনাকে অন্য কোনো নাম বলেছে হয়তো। মুচকি হেসে বলল বশিরের সহযাত্রী। অটোবাইক ফাঁকা রাস্তায় পেয়ে দ্রুতই চলছে। কার্তিক মাসে যে বাতাস বইছে, তাতে সবার ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দরদর করে ঘামছে বশির।
    লেখাপড়া শেষ করতে না পারায় ওর মাথায় একটু গন্ডগোল দেখা দিয়েছিল একসময়। অবশ্য এখন কতটা ঠিক হয়েছে, জানি না। তবে ওর একটা...
    কী একটা?
    ও অনেক মিথ্যা গল্প বলে। বলে, ওর অনেক টাকাপয়সা আছে। এমন গল্প ও সবাইকে করে বেড়ায়। এই জন্যই তো কাল ওর সাথে দেখা হওয়ার পর এড়িয়ে গেছি। আমাকে দেখে বলল, দোস্ত, চলো দুজন মিলে গল্প করতে করতে যাই। আমার বিরক্ত লাগে। অবশ্য সবাইকে বিরক্ত করে না। যাকে ভালো লাগে, যাকে আপন মনে হয়, তাকে মিথ্যা গল্প বলে ও একধরনের আনন্দ পায়। কাউকে বলে, ওর চাচা ওকে পটুয়াখালীতে অনেক জমিজমা নিয়ে ডাকছে। কাউকে বলে, ওর নিঃসন্তান বিধবা ফুফু ওর জন্য বাড়ি-গাড়ি নিয়ে বসে আছে, সে মরলেই সব ও পাবে।
    বশির কুলকুল করে ঘামতে শুরু করল। তার সহযাত্রী বলল, কী হয়েছে আপনার? খারাপ লাগছে?
    না, ঠিক আছে। বলতে গিয়ে দেখল মুখ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে পারছে না, জিব বেশ ভারী লাগছে। বুকের বাম পাশ থেকে একটা চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়েছে। বশির জানে এই ব্যথার মানে কী।
    ও কোনোমতে দুই দিকে মাথা নাড়াতে পারল।

    লোকটি আবার বলতে শুরু করল, এটা একটা রোগ। সাইকোলজির ভাষায় যার নাম ক্লিনিক্যাল লায়ার বা প্যাথলজিক্যাল লায়ার। এটা রোগীর জন্য কখনো মারাত্মক হয়ে থাকে। জনেনই তো মিথ্যাকে সকল পাপের জনক বলা হয়। আর তার এই বানিয়ে বলা গল্প এমন হয় যে আপনি ধরতেই পারবেন না লোকটা সত্য বলছে, না মিথ্যা বলছে। কারণ, গল্পটা একসময় সে নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করে। ফলে যাকে বলে, সে কোনোভাবেই সত্য না মিথ্যা, তা বুঝতে পারে না।

    ব্যাটারিচালিত অটো চলছে গন্তব্যের দিকে। হঠাৎ কথা থামিয়ে বশিরের সহযাত্রী বলল, এই ভাই, কী হইছে আপনার, এই...এই অটো, থামাও। লোকটা মনে হয়...।
    বশিরের কানে সবকিছু ক্ষীণ লাগছে। মনে হচ্ছে দূর থেকে কথা বলছে কেউ। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দুই আঙুলের ফাঁক থেকে খসে পড়ে অনেক সময় আগে থেকে টান না দেওয়া মার্লবোরো সিগারেটটা।

    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে) 

    No comments