Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    সার্টিফিকেট ।। মুক্তিযুদ্ধের গল্প

    আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমাকে বিয়ে করা। আমি বলে তোমার ঘর করছি। আর কেউ হলে বুঝতে কত ধানে কত চাল।
    এরকম নানা ধরনের মধু মেশানো শব্দ আমার কানে ঢুকতে লাগল সন্ধ্যা থেকে। যথাসম্ভব কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। অফিসের কাজ করছিলাম।
    অবুঝ বাবা চোখ বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দিল আরেকটা অবুঝের সঙ্গে। উহ্, ছেলেটা সরকারি চাকরি করে। গুষ্টি কিলাই তোর সরকারি চাকরির। মনে হয় তিনি একা সরকারি চাকরি করেন এ দুনিয়ায়, আর কেউ সরকারি চাকরি করে না। আমার বাপ-দাদা চৌদ্দগুষ্টি সরকারি চাকরি করে। কই, তারা তো কোনো দিন ঘরে বউ রেখে অফিসের কাজ রাতে বাসায় করেনি। সৎ, তিনি খুব সৎ, কাজে ফাঁকি দেন না। এ রকম সৎ থাকলে আর কয়েক দিন পর ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিতে হবে। 



    আমি একটা সরকারি অফিসের মানবসম্পদ বিভাগের কেরানি ছিলাম। সে অফিসে সম্প্রতি লোক নিয়োগের একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল। আমার কাজ ছিল দরখাস্ত বাছাই করা। বিজ্ঞপ্তিতে যা যা চাওয়া হয়েছে, সব শর্ত মেনে দরখাস্ত বাছাই করা। মোট পদ ষোলোটি। আর দরখাস্ত পড়েছিল উনত্রিশ হাজার ছয় শ আটাশিটি। অফিসে এগুলো বাছাই করার জন্য লোক ছিল মোট তিনজন। একজন ছুটিতে থাকায় আমি ও অন্যজন মিলেই কাজটি করছিলাম।

    অফিসে আসার পর তার স্বাভাবিক কাজ হলো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ক্যান্টিনে গিয়ে আড্ডা দেওয়া। সব দায়িত্ব বলতে গেলে আমার ঘাড়ে বর্তেছিল। চাকরিপ্রার্থীদের পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড পোস্ট করতে হবে ৩০ তারিখে। আজ মাসের ১৪ তারিখ। এর মধ্যে সব দরখাস্ত বাছাই করতে হবে। বাছাইয়েরও আবার প্রকারভেদ ছিল। সাধারণ প্রার্থী, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ইত্যাদি। তারপর পরীক্ষার তারিখ লেখো, সিল মারো, পোস্ট করো। মনে হচ্ছিল হাতে সময় খুবই কম। তাই অফিস থেকে ফেরার পথে দুটি ব্যাগে ভর্তি করে বেশ কিছু দরখাস্ত বাসায় নিয়ে এসেছিলাম আর বাছাইয়ের কাজ করছিলাম। আর তাই আমার বউটি সেই মধুর বুলি বর্ষণ করছিল।
    এমনটা আগেও বহুবার হয়েছে। তাই অভ্যাসমতো কাজ করে যেতে থাকলাম। আরও ঘণ্টাখানেক পর আপনাতেই থেমে যাবে। একসময় সে ঘুমাতে যাবে।

    রাত দশটার দিকে এক ব্যাগ দরখাস্ত দেখা শেষ হলো। নিজ হাতে চা বানিয়ে খেয়ে আবার বসলাম। আরও ঘণ্টা দুয়েক কাজ করে ঘুমাব।
    তখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটার আবেদনপত্রগুলো বাছাই করছিলাম। বাংলাদেশে এত মুক্তিযোদ্ধা? আমি বিস্মিত। পিতা, অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধার বয়স উল্লেখ আছে একাত্তর সালে এগারো বছর।
    প্রশ্ন হলো, একটি এগারো বছরের বালকের ওজন কত আর একটি থ্রি-নট-থ্রি কিংবা রিকয়েল-চালিত রাইফেলের ওজন কত? এ রকম বেশ কিছু আজব লেখা প্রায়ই চোখে পড়ত। একটি দরখাস্তে চোখ আটকে গেল। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট থাকার কথা, সেখানে একটা চিঠির ফটোকপি!
    বেশ লম্বা চিঠি। স্পষ্ট অক্ষর। মেয়েলি ঢঙে লেখা চিঠি। স্টেপলার পিন খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম।

    প্রিয়
    আমার এ চিঠি যখন তোমার হাতে পড়বে, তখন আমি কোথায় থাকব, তা আমি নিজেও জানি না। এ জন্য তোমার কোনো দুঃখবোধ তৈরি হবে কি না, তা আমি জানি না। তবে জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমার মনে হয়েছে, কিছু কথা তোমাকে বলা উচিত। তাই এই চিঠি।

    তোমার বাবা, তুমি কিংবা এই দেশ- কাকে যে আমি বেশি ভালোবাসি, তা আমি আজও ঠিক করে বলতে পারছি না। তোমার বাবার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের কোনো এক শীতের সকালে। আমি আর তোমার বাবা- দুজনই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। তোমার বাবা ছিলেন গণিতের সবচেয়ে তুখোড় ছাত্র। আর আমি তুখোড় না হলেও অখ্যাত ছিলাম না। তবে আমার সাবজেক্ট ছিল সাধারণ ইতিহাস। ওই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তোমাকে আমি অনেকবারই বলেছি। একটা মিছিলের সূত্র ধরে আমাদের পরিচয়। কলাভবনের গেটে তোমার বাবা একটা লাল চাদর পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি গেট দিয়ে ঢুকতে যাব, সে সময় পেছন থেকে ডাক দিলেনÑএই মেয়ে, শোনো। আমি চমকে গেলাম। ভরাট পুরুষালি কণ্ঠ। কোনো মেয়েই সেই কণ্ঠ অগ্রাহ্য করতে পারে না। আজ মিছিল আছে, মিছিলে থাকতে হবে।

    আমার বাবা জাহাজে চড়ে হজ করে এসেছেন বলে আমাদের, অর্থাৎ আমি ও আমার বোনদের জন্য অনেক কিছুই নিষিদ্ধ ছিল। পরপুরুষের সঙ্গে মেশা, কথা বলা, এ রকম আরও অনেক কিছু। সেখানে আমার জন্য মিছিলে যাওয়া কতটা অসম্ভব, তা আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছ। মিছিলে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তোমার বাবা আমাকে এক মিনিট মাটির দিকে তাকিয়ে বোঝালেন। তারপর বললেন, কি, আসবে?
    আমিও মাটির দিকে তাকিয়ে বললাম, আসব।
    ঠিক আছে, যাও। এগারোটার সময় কলাভবনের সামনে থেকো, আমরা সবাই থাকব। বলে তিনি পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন।
    আমি প্রায় দৌড়ে পালালাম। ক্লাসে গিয়ে বুঝলাম, ঘেমে গেছি। আমার হার্টবিট বেড়ে গেছে। বুঝতে পারলাম না কেন আমার এমনটা হলো।

    একটা কথা বলে রাখি। তোমার বাবা দেখতে বেশ সুপুরুষ ছিলেন। লম্বায় ছয় ফুটের কাছাকাছি, টকটকে ফরসা, ভরাট মুখ কিন্তু বেশ কঠিন আর তেজদীপ্ত।
    আমি সেদিন মিছিলে গেলাম। সেই শুরু। এরপর কত সভা, মিটিং, মিছিল, আন্দোলন, কবিতাপাঠ!
    অঙ্কের ছাত্রের যে এত ভালো কবিতা লেখার গুণ থাকতে পারে, তোমার বাবার কবিতা যে না পড়েছে, সে বুঝতে পারবে না। তোমার বাবার কবিতা দিয়ে একদিকে যেমন আগুন ঝরত, অন্যদিকে ঝরত প্রেম আর ভালোবাসা, যা বেগবান করত আমাকে ও আমাদের। ইচ্ছা করেই তোমার বাবাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, তোমার বাবা আমার ভেতরে বাসা বাঁধতে শুরু করেছেন। তা হতে দেওয়া যায় না।

    কিন্তু হলো উল্টো। একসময় টের পেলাম, দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তোমার বাবাই আমার ভাবনায় থাকেন বিশ ঘণ্টা। বুঝতে পারলাম, তোমার বাবাকে ছাড়া বাকি জীবন পার করা প্রায় অসম্ভব। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে একদিন তাকে জানালাম।
    বুঝে বলছ তো? তিনি বললেন।
    জানি না।
    না জানলে তো হবে না। দেশের এখন কী অবস্থা দেখতে পাচ্ছ না? এ সময় এসব চিন্তা আসে কী করে তোমার মাথায়?

    অপমানিত বোধ করলাম। রাগ করে কথা বললাম না বেশ কিছুদিন। কিন্তু মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া বাদ দিলাম না। কারণ, তোমার বাবার পাশাপাশি কখন যে দেশটাকেও ভালোবেসে ফেলেছি, তা নিজেও জানি না। এক দুপুরে রুমের এক জুনিয়র মেয়ে এসে আমার হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দিল। খুলে দেখলাম একটা কথাই লেখা, ঠিক সাড়ে পাঁচটায় মধুর ক্যান্টিনে থেকো।

    কারও নাম নেই। হাতের লেখা দেখে চিনলাম না। মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিল যে চিরকুটের লেখক তোমার বাবা হতে পারেন। আমার শরীরজুড়ে একটা শিহরণ খেলে গেল।
    যথাসময়ে গিয়ে হাজির হলাম। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। দেখলাম, তোমার বাবা ছাড়া আর যে দু-একজন আছেন, তাদের এমন চিরকুট আমাকে লেখার কথা নয়। তোমার বাবা আমাকে ডাকলেন। আমি গেলাম। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। উদ্ভ্রান্তের মতো চোখ, উষ্কখুষ্ক চুল, গালে তিন-চার দিনের না কামানো দাড়ি।
    বলেন।

    কোনো ধরনের ভণিতা না করে তোমার বাবা যে কথাটি বললেন, সেটা ছিল আমার জীবনে শোনা সবচেয়ে মধুর কথা।
    অনেক ভেবে দেখেছি, আমি হেরে গেছি। সারা জীবন সব কাজে তোমাকেই কাছে পেতে চাই।
    কথা শুনে থরথর করে কাঁপছিলাম। তোমার বাবা এসে আমাকে ধরলেন।
    তোমার বাবার ভালোবাসা আমাকে বলীয়ান করে তুলল। মনে হলো তোমার বাবাকেও কিছুটা।
    দেখতে দেখতে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের পর আমরাও সবাই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেলাম। যাবার আগে তোমার বাবা আমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে গেলেন আর বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। দেশে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ।

    এদিকে আমার বাবা স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের আসন অলংকৃত করলেন। তিন বোনের স্থান হলো আমাদের দোতলার একটি ঘরে। তিন দিন পরপর এক দিন গোসল করতে বাইরে বের হতাম। আর প্রাণটা ছটফট করত তোমার বাবা আর এই দেশটার জন্য।
    তোমার বাবা সংবাদ পেয়ে এক রাতে সশস্ত্র হামলার মাধ্যমে আমাকে তুলে নিয়ে গেলেন। কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে আমাকে নিয়ে গেলেন বেনাপোলে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
    চার দিনের মাথায় তোমার বাবা সুন্দর চাঁদকে সাক্ষী রেখে কোনো কাজি ছাড়াই আমাকে বিয়ে করলেন। সেই রাতেই ছিল আমার বাসর। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত।

    তোমার বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে আমরা থাকতে শুরু করলাম। তোমার বাবার নেতৃত্বে একটা গেরিলা টিম ছিল। তারা মাঝেমধ্যে অপারেশনে যেত। আমাদের বিয়ের এগারো দিনের মাথায় মেজর জলিলের নির্দেশে তোমার বাবা ক্যাপ্টেন এহসানের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ায় চলে গেলেন ট্রেনিংয়ের জন্য আর আমাকে একটি ক্যাম্পে পাঠানো হলো প্রাথমিক চিকিৎসা শিখতে। যেন আমি যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার কাজে আসতে পারি। কিন্তু আমি যুদ্ধে যেতে চাইলাম। সবাই আমাকে বোঝাল। বলল, তুমি যুদ্ধে গেলে যে উপকার হবে, তার চেয়ে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা করলে বেশি উপকার হবে।
    আমি তা-ই করলাম।



    সারাক্ষণ মনে পড়ত তোমার বাবার কথা। সারা দিন চোখের পানি ফেলতাম। এভাবে মাস দেড়েক কেটে গেল। হঠাৎ একসময় আমার মধ্যে তোমার উপস্থিতি টের পেলাম। দেশের এই ক্রান্তিকালে তোমার উপস্থিতি আমাকে যেমন ভীত করছিল, তেমনি খুশিও। আমার স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে গেলাম। তত দিনে মোটামুটি ট্রেনিং পেয়েছি। আমাকে পাঠানো হলো সাত মাইল দূরের বাঁশখালি ক্যাম্পে। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ হচ্ছিল না। জুলাই মাসের ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় তোমার বাবা সেই ক্যাম্পে হাজির হলেন। তার ট্রেনিং শেষ হয়েছে। তোমার বাবাকে দেখে কিশোরী কন্যার মতো কাঁদতে শুরু করলাম। তোমার বাবা অনেক শুকিয়ে গেছেন। কিন্তু মনে হলো আরও তেজদীপ্ত হয়েছেন। তোমার কথা বললাম তোমার বাবাকে। খবরটা শুনে তোমার বাবা যে কী পরিমাণ খুশি হয়েছিলেন, তা লিখে বোঝাতে পারব না। পরদিন আরও সতেরো জন মুক্তিযোদ্ধাসহ তোমার বাবা আর আমি বাঁশখালি ক্যাম্প থেকে খানিকটা পশ্চিমে একটা জমিদারবাড়ির মতো বাড়িতে উঠলাম।

    তোমার বাবা বললেন, এই বাড়িটা হবে একটা দুর্গ। আমিসহ তিনজন সারা দিন বাড়ি পাহারা দেব, আর তোমার বাবাসহ পনেরো জনের একটা টিম প্রতিদিন অপারেশনে যাবে। হলোও তা-ই। সারা দিন যে কী অবস্থায় কাটিয়েছিলাম, তা আশা করি তুমি বুঝতে পারছ। যা-ই হোক। এভাবে পরপর তিন দিন গেলেন তোমার বাবা। চতুর্থ দিন তারা পনেরো জনের বদলে ফিরলেন তেরো জন। দুজন শহিদ হয়েছেন। আমরা সবাই অনেক কান্নাকাটি করলাম। রাতে জরুরি অপারেশনে পাঁচজনের একটা টিম বের হয়ে গেল। তোমার বাবা গেলেন না। তোমার বাবা আর আমি রাতে দোতলার একটা রুমে থাকতাম। সতেরো জন যোদ্ধার অস্ত্র ছিল মাত্র সাতটি। রাতে যে টিমটি অপারেশনে গিয়েছিল, তারা পাঁচটি রাইফেল আর আটটি গ্রেনেড নিয়েছিল সঙ্গে। দুর্গে রয়েছে মাত্র দুটি রাইফেল, তিন রাউন্ড গুলি। আর কিছু না। চরম অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে ভোরের অপেক্ষা করছিলাম।

    রাত তখন আড়াইটার মতো হবে। আমার চোখ সবে বুজে এসেছে। হঠাৎ হইচইয়ের কারণে আমার তন্দ্রা ছুটে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় দেখতে পেলাম নয়জন পাকিস্তানি আর্মির একটি দল অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে বাড়ির সামনের ভাগ ঘিরে আছে। তাদের সবার হাতে রাইফেল। ভয়ে জমে গেলাম। ধাক্কা দিয়ে তোমার বাবাকে ওঠালাম। তিনি চট করে রাইফেল বের করে গুলি করতে উদ্যত হলেন। ফিসফিস করে বললাম, পাগল হয়েছ? মাত্র তিন রাউন্ড গুলি নিয়ে নয়জনের একটা বাহিনীর সঙ্গে তুমি পারবে?
    তাহলে কী করব?
    সামনের একজন পরিষ্কার ইংরেজিতে বলল, আমরা খবর পেয়ে এসেছি, এখানে তোমরা সাতজন রয়েছ। তোমরা বেরিয়ে এসো, না হলে আমরা গুলি খরচ করতে বাধ্য হব। তোমার বাবা ফিসফিসিয়ে বললেন, এখন কী করব, বলো?
    দাঁড়াও, মাথা ঠান্ডা রাখো। উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্তে আমাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে।
    কী করতে চাও তুমি? মৃত্যু যখন নিশ্চিত, তখন লড়াই করে মরি।
    চট করে একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সাতজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন তখন আমার জীবনের তুলনায় অনেক বেশি মনে হলো। বিছানা ছেড়ে উঠলাম। তোমার বাবা আমার হাত চেপে ধরলেন।
    কী করছ তুমি? পাগল হয়েছ?
    আমাকে বাধা দিয়ো না, প্লিজ।
    খবরদার, এক পা সামনে এগোবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকো।

    জানি না আমার শরীরে কী ভর করেছিল। এক ঝটকায় তোমার বাবার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। তাকে আটকে রাখলাম বাইরে থেকে।
    এসে দেখলাম মুক্তিযোদ্ধারা একটা রাইফেল পাশে নিয়ে জড়সড় হয়ে আছেন। সে রাইফেলে কোনো গুলি নেই। তারা আমাকে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না।
    তাদের বললাম, কোনো ধরনের বোকামি করবেন না। দয়া করে দোতলার দরজা খুলে ওকে নিয়ে সবাই পালিয়ে যান।




    আর্মির সেই অফিসারটা কখনো ইংরেজিতে, কখনো উর্দুতে চেঁচিয়েই যাচ্ছিল।
    সদর দরজা খুলে উঠানে নেমে এলাম। চাদের আলোয় মানুষকে যে এত বীভৎস লাগতে পারে, তা এই আর্মিদের না দেখলে বুঝতে পারতাম না। বুকের কাপড় একটু সরিয়ে অফিসারটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

    কে তুমি? উর্দুতে জানতে চাইল অফিসারটি।
    আমি কাছের বাজারের এক বারবনিতা। স্থানীয় রাজাকার আমাকে এখানে তোমাদের মনোরঞ্জনের জন্য রেখে গেছে। আর মুক্তিরা তোমরা আসার ঘণ্টা দুয়েক আগে অপারেশনে গেছে। আমি ভাঙাচোরা উর্দুতে বললাম।
    সে তো পাঁচজন, বাকিরা?
    তুমি ভুল জানো, অফিসার। পরে বাকিরাও গেছে।
    কী করে তোমাকে বিশ্বাস করব যে তুমি শত্র“ নও।
    তুমি কি বোকা? আমার মতো ভরাযৌবনা একটা মেয়ে তোমার মতো এক মস্ত সুপুরুষ অফিসারের সঙ্গে যুদ্ধ করবে? আমি জয় বাংলার গুষ্টি মারি, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। বিশ্বাস না হলে তুমি আমার সুন্দর ও আকর্ষণীয় বুকে হাত দিয়ে দেখো তোমাকে আমি কেমন আদর করি।
    তাই নাকি?
    দেখতে পেলাম একটা কুত্তা হাসছে দাঁত কেলিয়ে আর তার থাবা আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
    তাহলে ঘরে চলো।
    না, এ ঘরে না। এ ঘরটা একজন হাজি সাহেবের। যে রাজাকার আমাকে তোমাদের বিনোদনের জন্য রেখে গেছে, সে বলেছে, ঘরের মালিকও একজন রাজাকার, খুবই ধর্মপরায়ণ। কেউ বারবনিতা নিয়ে তার ঘরে আনন্দ করুক, তা সে চায় না।
    সামনের কাচারিঘরের দিকে ইশারা করলাম।
    চলো।

    অফিসার আমাকে নিয়ে গেল।
    ঘরে গিয়ে সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
    তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
    দুপুর বারোটার দিকে আমার চেতন হলো। সারা গায়ে রোদের আলো। শরীরে একটা সুতাও নেই। নিজের হাত দেখে বিশ্বাস করলাম না সেটা আমার হাত ছিল। তা ছিল সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাশে। শরীরে এক ফোঁটা শক্তি ছিল না। ওঠার চেষ্টা করলাম, ব্যর্থ হলাম। ওঠার চেষ্টা করায় টের পেলাম, আমার নিম্নাংশে প্রচণ্ড ব্যথা আর বিছানার চাদরের সঙ্গে রক্ত ও বীর্য মিশে শুকিয়ে আমার শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। আশ্চর্য! কাঁদতে চাচ্ছি, কিন্তু কান্না আসছে না। নিশ্চিত ছিলাম যে আমার ভেতরের তুমি বোধ হয় মারা গেছ। চোখ বন্ধ করলাম। আমাকে যে হত্যা করা হয়নি, এ জন্য মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম আর্মিদের। কিছু সময় পর অনেক কষ্টে উঠলাম। যে বাড়িটাতে আমরা ছিলাম, সেই বাড়িটার ভেতরে গিয়ে দেখলাম সব আসবাব ভেঙেচুরে একাকার করে রেখেছে আর্মিরা। টের পেলাম, আমার পেটে প্রচণ্ড খিদে। সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও এমন কিছু পেলাম না যা খেয়ে খিদে মেটাতে পারি।

    প্রথমে গোসল সেরে নিলাম। এরপর খাবারের আশায় পাশের বাড়িতে গেলাম। তারা সবাই আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। তাদের কাছে কিছু খাবার চাইলাম। একজন আমাকে ভাত খেতে দিল। সাহায্যের আশায় তাদের সব খুলে বললাম। কিন্তু ফল হলো উল্টো। খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আমাকে বের করে দিল। দুর্গে ফিরে এলাম। গা ছমছম করা পরিবেশ। চারদিক নীরব। কেন জানি না আমি আর ভয় পেলাম না। তবে নিজে নিজে খুব তৃপ্ত হলাম এই ভেবে যে আমার জন্য সাতজন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে গেছেন। যা-ই হোক, অন্য কোথাও গেলাম না। ওই বাড়িতেই, অর্থাৎ দুর্গেই থাকতে লাগলাম। তোমাকে পেটে নিয়েই ভিক্ষা করা শুরু করলাম দূরদূরান্তের গ্রামে। আর প্রতি সন্ধ্যায় খুব আশা নিয়ে ফিরতাম যে গিয়েই বোধ হয় দেখব তোমার বাবাসহ অন্যরা ফিরে এসেছেন।
    কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, তোমার বাবাও ফেরেন না, মুক্তিযোদ্ধারাও ফেরেন না।

    তখন অক্টোবর মাস। এক গভীর রাতে সেই দুর্গ আবার আক্রান্ত হলো। তুমি তখন আমার পেটে অনেক বড় হয়েছ। তোমাকে নিয়ে হাঁটাচলা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে আমার জন্য। আর্মির উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে গেলাম। পরের রাতে আবার। বুঝতে পারলাম, সেখানে থাকা অসম্ভব। অবর্ণনীয় কষ্টে তেরো মাইল দূরে এক মওলানার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। একদিকে প্রাণের ভয়, অন্যদিকে তোমার বাবাকে হারানোর ভয়। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তারা আমাকে নিজেদের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন।

    একদিন তাদের একজনকে নিয়ে এসে সারা বাড়ির দেয়ালে কোথায় আছি, তা খড়িমাটি দিয়ে লিখে গেলাম। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ আশায় থাকতাম, এই বুঝি তোমার বাবা এলেন। দিন যত যাচ্ছে, প্রসবের দিন তত ঘনিয়ে আসছে। দেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছেÑএই সংবাদই আমি পেতাম। ১৮ ডিসেম্বর খবর পেলাম, দেশ স্বাধীন হয়েছে, আর তখনই আমার মনে হলো, আমার জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল ওই রাতে তোমার বাবাকে রুমে আটকে রেখে নিজেকে পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে তুলে দেওয়া।

    ১০ জানুয়ারি তুমি পৃথিবীতে এলে। আমার চোখে দেখা দিল নতুন স্বপ্ন। কিন্তু তোমার বাবা আর এলেন না। ধরে নিয়েছিলাম, তিনি শহিদ হয়েছেন।
    ২৫ জানুয়ারি হঠাৎ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এলেন সেই বাড়িতে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। ভাবলাম, তোমার বাবা বোধ হয় এসেছেন। কিন্তু না। তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ঠিকই কিন্তু তোমার বাবার বন্ধু তারা নন। তারা ছিলেন এ দেশেরই নতুন গঠিত কোনো এক বাহিনীর লোক। যে বাড়িতে শেষে আশ্রয় পেয়েছিলাম, সেটা ছিল এক মওলানার বাড়ি। কিন্তু কসম খোদার, সেই মওলানা কখনো রাজাকার বা শান্তি কমিটির কেউ ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধের জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন আমার সামনে। কিন্তু আমার চোখের সামনে যা ঘটল, তা আজও বিশ্বাস করতে পারছি না। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা ঘরের লোকজন বের করে সব লুট করে নিয়ে গেল। ঘরে আগুন দিল। বাড়ির মালিককে গুলি করে মারল। বাক্রুদ্ধ হয়ে গেলাম। শুনলাম, এরাও নাকি সত্যিই মুক্তিযোদ্ধা। কেমন মুক্তিযোদ্ধা? কেমন রক্ষীবাহিনী? তোমাকে নিয়ে আবার পালিয়ে বাঁচলাম। ভাবলাম, দেশ হয়তো স্বাধীন হয়নি। কেউ হয়তো ভুল করছে।

    তোমাকে নিয়ে কুমিল্লায় বাবার বাড়িতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম একই অবস্থা। রক্ষীবাহিনী সেখানেও হামলা চালিয়েছে। আমার কাছে সবকিছু রহস্যময় লাগল। এটা কী হচ্ছে? বাবার বাড়িতে আক্রমণ করেছে, ঘরে আগুন লাগিয়েছে, তাতে আমি অখুশি হইনি। কারণ, আমার বাবা সরাসরি স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি ছিলেন, কিন্তু মওলানা সাহেব? আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তোমাকে নিয়ে রওনা দিলাম ঢাকায়।
    শুরু হলো আরেক জীবন।

    অনেক কষ্টে একটা হাসপাতালে নার্সের চাকরি পেয়ে কোনোমতে তোমাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে শুরু করলাম। একদিন গেলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তোমার বাবার খোঁজে। যদি তার বাহিনীর কাউকে পাই এবং পেয়েও গেলাম। জানতে পারলাম, তোমার বাবা বেঁচে আছেন এবং বেশ ভালোভাবেই আছেন।
    আমার ঠিকানা দিয়ে হাসপাতালে চলে এলাম। ডিউটি দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, এই বুঝি তোমার বাবা এলেন।
    ডিউটি শেষ হতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। এর মধ্যে এক নার্স এসে খবর দিল, আমার খোঁজে কেউ একজন এসেছেন। আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম তোমার বাবা। আগের মতোই ছিলেন, শুধু গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে। দীর্ঘক্ষণ কাঁদলাম। তোমার বাবাকে নিয়ে আমার পুরান ঢাকার বাসায় এলাম।
    সব বললাম। তিনি শুনলেন। কিছুই বললেন না।
    তারপর বললাম, হাতমুখ ধুয়ে এসো। খাবে।
    না, খাব না।
    কেন, খাবে না কেন?
    খিদে নেই। শোনো, কিছু কথা বলি, তোমাদের ঢাকায় থাকতে-চলতে যে খরচ হয়, তা সবই দেব আমি কিন্তু তোমাকে নিয়ে ঘর-সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
    আমি পাথর হয়ে গেলাম। কী বলে লোকটা? পাগলটাগল হয়ে গেল নাকি?
    হেসে বললাম, কী বলছ তুমি?
    কী বলছি বুঝতে পারছ না? তুমি যা করেছ, তার ঋণ হয়তো আমি কিংবা আমার সহযোদ্ধারা কোনো দিনও শোধ করতে পারব না বা শোধ করারও নয়। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমি তোমাকে নিয়ে ঘর করতে পারব না। আমাকে ক্ষমা করো।
    আমি কিছুই বললাম না। মনে মনে ভাবলাম, আমি স্পেশালি তোমার জন্য কিছু করিনি। যা করার দেশের জন্য করেছি।

    সুগভীর যন্ত্রণা সত্ত্বেও নিজেকে সংযত করে শুধু বললাম, ঠিক আছে। তুমি যেতে চাও, যাও। চলো আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দিই।
    তোমার বাবাকে বিদায় দিলাম। শুরু হলো তোমাকে নিয়ে আমার জীবন। তুমি বড় হতে থাকলে। তোমাকে কোনো দিন বাবার অভাব বুঝতে দিইনি। জীবনের চলার পথে তোমার বাবার নাম দরকার হতে পারে, সেটা আমার মাথায় ছিল। আমি তোমার বাবার নাম ঠিকই রেখেছি খাতাপত্রে। তোমার বাবা কোথায়, সে প্রশ্নের জবাবে আমি বরাবরই নীরব থেকেছি।

    কিন্তু আমি যখন দেখলাম তুমি তোমার বাবার খোঁজে মরিয়া হয়ে উঠেছ, তখন আর কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। সেই রাতে তুমি আমার সাথে তর্কযুদ্ধে নামলে। তর্কের একপর্যায়ে তুমি আমাকে সন্দেহ করলে। সন্তান যদি তার মায়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন করে, তখন আর কিছু করার থাকে না। আমার রিটায়ারমেন্টের টাকা তোমার নামেই ব্যাংকে রাখা আছে। সামান্য কিছু টাকা। পারলে একটা চাকরি নিয়ে একটা মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করে সুখে-শান্তিতে বসবাস শুরু করো।
    একটা উপদেশ তোমাকে দিই। দাম্পত্য জীবনে তোমার সহধর্মিণীর ওপর বিশ্বাস হারাবে না।
    ভালো থেকো।
    তোমার মা (যদি তুমি মনে করো)

    পরদিন অফিসে গিয়ে আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে চিঠিটা দেখালাম। তিনি পড়লেন।
    স্যার, এই লোকটার মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নেই। সার্টিফিকেটের বদলে এই চিঠিটা উনি দিয়েছেন।
    তো?
    স্যার, চিঠিটা পড়ে দেখলে বুঝবেন দরখাস্তকারীর মা-বাবা দুজনই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। চিঠিটা তারই প্রমাণ।
    কিন্তু সার্টিফিকেট তো নেই। সার্টিফিকেট লাগবে।
    ও। কিন্তু ওনার তো সার্টিফিকেট নেই।
    তাহলে আর কী? সাধারণ কোটায়ই ওনাকে ডাকো।
    আরেকটা কথা, স্যার। ওনার বয়স এখন একত্রিশ বছর আট মাস তিন দিন।
    ও। তাহলে বাদ।
    আচ্ছা স্যার।
    আমি অন্য দরখাস্তগুলোতে মন দিলাম।



    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে)

    3 comments:

    1. এত সুন্দর গল্প একটা মানুষ কিভাবে লিখতে পারে!!! অসাধারন!!!

      ReplyDelete
      Replies
      1. প্রিয় পাঠক, গল্পটি আপনার ভালো লাগলে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো। ধন্যবাদ।

        Delete
    2. Proto ti shobdha dhuba giachlum. Proshongsha korar moto Bangla shobdho amar vhandara nai. Valo Basha ar srodhha from core

      ReplyDelete