ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত: ইতিহাসের গভীরে একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ - সাইফুল বাতেন টিটো
সারসংক্ষেপ: একটি দীর্ঘস্থায়ী জটিল সংঘাত
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত আধুনিক বিশ্বের অন্যতম জটিল ভূ-রাজনৈতিক সংকট, যার শিকড় প্রোথিত রয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী দাবি-দাওয়ার মধ্যে। এই সংঘাত কেবল দুটি জনগোষ্ঠীর ভূখণ্ডগত বিরোধ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক আইন, মানবিক নীতি এবং বিশ্বশক্তির স্বার্থের এক জটিল জাল। ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে জায়নবাদ ও আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের পর থেকে এই অঞ্চলে প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় আকাঙ্ক্ষাগুলো তীব্র আকার ধারণ করে। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি "জাতীয় আবাসভূমি" প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি এবং একই সাথে আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে, যা সংঘাতের একটি মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করে।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধ এবং এর ফলস্বরূপ ফিলিস্তিনিদের
"নাকবা" বা বিপর্যয়, যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে, সংঘাতের মানবিক দিকটিকে আরও গভীর করে তোলে। এরপর থেকে, আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের ধারাবাহিকতা, ইসরায়েলের দখলদারিত্ব এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলন, উভয় পক্ষেই ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্ম দিয়েছে। শান্তি প্রক্রিয়াগুলো, যেমন ক্যাম্প ডেভিড ও অসলো চুক্তি, বারবার আশা জাগিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে, যা সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধান করতে না পারার অক্ষমতাকে তুলে ধরে।
এই প্রতিবেদনে হামাস, ইসরায়েলি নেতৃত্ব এবং বিশ্বনেতাদের
ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে
বিশ্লেষণ করা হয়েছে। হামাসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী
ও রাষ্ট্রপরিচালকদের বিতর্কিত নীতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বনেতাদের স্বার্থান্বেষী পদক্ষেপগুলো
প্রমাণ ও উদাহরণসহ তুলে ধরা হয়েছে। সংঘাতের মানবিক মূল্য, উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ এবং এই সংঘাত থেকে কারা কীভাবে লাভবান হচ্ছে, তার একটি বিশ্লেষণও এই প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়েছে, যা সংঘাতের বহুমাত্রিকতাকে
উন্মোচন করে।
১. ভূমিকা: প্রতিদ্বন্দ্বী ভূমি, প্রতিদ্বন্দ্বী আখ্যান
ঐতিহাসিক পটভূমি এবং নিরপেক্ষতার অন্বেষণ
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের মূল নিহিত রয়েছে ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে জায়নবাদ এবং আরব জাতীয়তাবাদের সমান্তরাল উত্থানে। উভয় আন্দোলনই ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের উপর ঐতিহাসিক ও জাতীয় অধিকার দাবি করে, যা এই অঞ্চলের উপর প্রতিদ্বন্দ্বী আখ্যান তৈরি করে। ইহুদি জাতি, তাদের দীর্ঘ ইতিহাস জুড়ে, হলোকাস্ট সহ তীব্র নিপীড়নের শিকার হয়েছে, যা একটি নিরাপদ জন্মভূমির জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর, ১৯২০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে আসে। এই ম্যান্ডেট একদিকে "বালফোর ঘোষণা" (Balfour Declaration) দ্বারা ইহুদিদের জন্য একটি "জাতীয় আবাসভূমি" প্রতিষ্ঠার ব্রিটিশ সমর্থনকে অন্তর্ভুক্ত করে, অন্যদিকে আরবদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতিশ্রুতিও দেয়। এই অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বই সংঘাতের বীজ বপন করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় দাবিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করে।
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত সংঘাতকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এই সংঘাতের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি পদক্ষেপ গভীরভাবে আবেগপ্রবণ এবং বিভিন্ন পক্ষ নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা করে। তবে, আমার এই লেখায় আমি কঠোরভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। এর অর্থ কেবল উভয় পক্ষের দাবি উপস্থাপন করা নয়, বরং প্রতিটি তথ্য ও ঘটনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা, নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর নির্ভর করা এবং আবেগপ্রবণ বা পক্ষপাতদুষ্ট ভাষা পরিহার করা। উদাহরণস্বরূপ, "দখলদারিত্ব" বা "সন্ত্রাসবাদ" এর মতো শব্দ ব্যবহার করার সময়, সেগুলোর আন্তর্জাতিক আইনগত বা স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুসরণ করা হয়েছে, যাতে কোনো পক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ না ওঠে। এই সংঘাতের মৌলিক দলিলটি, ব্রিটিশ ম্যান্ডেট, নিজেই পরস্পরবিরোধী উদ্দেশ্য ধারণ করে। এটি কেবল একটি বিদ্যমান সংঘাতকে পরিচালনা করেনি, বরং একই ভূখণ্ডের মধ্যে দুটি ভিন্ন জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে বৈধতা দিয়ে সংঘাতের মূল দ্বিধাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এই অন্তর্নিহিত বৈপরীত্যই পরবর্তীকালে সংঘাতের একটি মৌলিক কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
২. বিরোধের উৎপত্তি:
ম্যান্ডেট থেকে
বিপর্যয় (১৯৪৮-পূর্ববর্তী)
উসমানীয় উত্তরাধিকার এবং ব্রিটিশ ম্যান্ডেট: বিভাজনের
বীজ
ফিলিস্তিন বহু শতাব্দী ধরে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, যেখানে একটি বহু-জাতিগত ও বহু-সাংস্কৃতিক সমাজ বিদ্যমান ছিল। ১৯৩০-এর দশকে ইউরোপে ইহুদিদের উপর নিপীড়ন এবং জায়নবাদী আন্দোলনের প্রভাবে ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন বৃদ্ধি পায়, যার লক্ষ্য ছিল একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই অভিবাসন আরবদের মধ্যে ভূমি দখল, ইহুদি অভিবাসন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে গভীর হতাশার জন্ম দেয়। এই হতাশার ফলস্বরূপ ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন ও ইহুদি অভিবাসনের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, যা ধর্মঘট, বিক্ষোভ এবং আইন অমান্য আন্দোলনের মাধ্যমে তীব্র আরব প্রতিরোধের জন্ম দেয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে, যার ফলে ফিলিস্তিনিরা একটি ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের অভাবে পড়ে।
এই সময়ে, ইহুদি সম্প্রদায় নিজেদের সুরক্ষার জন্য সামরিক সংগঠন গড়ে তোলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল "হাগানাহ", যা প্রাথমিকভাবে স্থানীয় আরব আক্রমণ থেকে ইহুদি সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য গঠিত হয়েছিল এবং পরে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করে। এই ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং উভয় পক্ষের সামরিকীকরণ একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে। জায়নবাদী লক্ষ্য দ্বারা চালিত ইহুদি অভিবাসন এবং ভূমি অধিগ্রহণ আরব প্রতিরোধের জন্ম দেয়, যা পাল্টা ইহুদি আত্মরক্ষা সংগঠনগুলোর সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়া পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে, যা রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণার আগেই উভয় পক্ষকে সশস্ত্র সংঘাতে প্রস্তুত করে তোলে। এটি দেখায় যে সংঘাত কেবল একটি সম্ভাবনা ছিল না, বরং উভয় পক্ষই সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকায় এটি অনিবার্য হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘ বিভাজন পরিকল্পনা
এবং সংঘাতের
সূচনা
১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৮১ নম্বর প্রস্তাব পাস করে, যা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে একটি ইহুদি রাষ্ট্র ও একটি আরব রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রস্তাব করে এবং জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক শাসনের অধীনে রাখার কথা বলে। তবে, আরব বিশ্ব এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে, এটিকে অন্যায় এবং জাতিসংঘের সনদের আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতির লঙ্ঘন বলে মনে করে। এই প্রত্যাখ্যানের পরপরই ইহুদি ও আরব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেসামরিক সংঘাত ও সহিংসতা তীব্র আকার ধারণ করে।
জাতিসংঘের এই বিভাজন পরিকল্পনা, যদিও সংঘাত সমাধানের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল , বাস্তবে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এই পরিকল্পনাটি একটি প্রধান পক্ষের সম্মতি অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায়, এটি এক পক্ষের আকাঙ্ক্ষাকে বৈধতা দেয় এবং অন্য পক্ষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যার ফলে সংঘাত বেসামরিক পর্যায় থেকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। জাতিসংঘের এই পদক্ষেপ, পর্যাপ্ত সমর্থন ছাড়াই একটি সমাধান চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করায়, সংঘাতকে প্রশমিত করার পরিবর্তে আরও ত্বরান্বিত করে।
৩. চলমান ট্র্যাজেডি: যুদ্ধ, দখলদারিত্ব এবং বিদ্রোহ
(১৯৪৮-বর্তমান)
১৯৪৮ সালের যুদ্ধ
এবং নাকবা:
বাস্তুচ্যুতি ও সম্পত্তি হারানো
১৯৪৮ সালের ১৪ই মে, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের সাথে সাথে ইসরায়েল তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যা তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সূচনা করে। মিশর (সৌদি আরব, সুদান ও ইয়েমেনি সৈন্যদের সমর্থনে), ইরাক, জর্ডান, লেবানন এবং সিরিয়া ইসরায়েল আক্রমণ করে। এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ ইসরায়েলের বিজয় হয়, তবে ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হয়, যা "নাকবা" বা "মহাবিপর্যয়" নামে পরিচিত। আনুমানিক ৭,৫০,০০০ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয় বা পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধের পর ইসরায়েল পশ্চিম জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে, মিশর গাজা উপত্যকা এবং জর্ডান পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম লাভ করে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব পাস করে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানায়।
নাকবা কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি চলমান ট্রমা ও অবিরাম প্রক্রিয়া। ফিলিস্তিনিরা আজও ইসরায়েলি বসতি স্থাপন, উচ্ছেদ, ভূমি দখল এবং ঘরবাড়ি ধ্বংসের কারণে বাস্তুচ্যুত ও সম্পত্তি হারাচ্ছে। এটি নাকবাকে একটি একক ঘটনা থেকে অবিরাম অবিচারের একটি চলমান অবস্থায় রূপান্তরিত করে, যা ফিলিস্তিনিদের সম্মিলিত স্মৃতির একটি গভীর বেদনাদায়ক ঘটনা এবং তাদের পরিচয়ের একটি মৌলিক উপাদান।
আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের
চক্র: ভূখণ্ডগত
পরিবর্তন এবং মানবিক মূল্য
·
১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকট: ইসরায়েল মিশরের সিনাই উপদ্বীপ আক্রমণ করে এর বেশিরভাগ অংশ দখল করে নেয়, কিন্তু পরে আন্তর্জাতিক চাপে প্রত্যাহার করে।
·
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ: ইসরায়েল কয়েকটি আরব প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে একটি নিষ্পত্তিমূলক বিজয় অর্জন করে এবং পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা, সমগ্র পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস এবং মিশরের সিনাই উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এটি এই অঞ্চলগুলোতে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের সূচনা করে। এই যুদ্ধ সংঘাতের প্রকৃতিকে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ থেকে দীর্ঘস্থায়ী দখলদারিত্বে রূপান্তরিত করে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নম্বর প্রস্তাব পাস করে ইসরায়েলের দখলকৃত অঞ্চল থেকে প্রত্যাহারের আহ্বান জানায়, যা "ভূমির বিনিময়ে শান্তি" ধারণার জন্ম দেয়।
·
১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ: মিশর ও সিরিয়া দখলকৃত অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে ইসরায়েলকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয়। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৩৩৮ নম্বর প্রস্তাব পাস করে, যা ২৪২ নম্বর প্রস্তাব বাস্তবায়নের আহ্বান জানায়।
·
১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধ: ইসরায়েল লেবানন আক্রমণ করে পিএলও (PLO) নির্মূল করার ঘোষণা দেয়।
ইন্তিফাদা: প্রতিরোধ এবং দমন
·
প্রথম ইন্তিফাদা (১৯৮৭-১৯৯৩): ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের একটি গণঅভ্যুত্থান, যা একটি গাড়ি দুর্ঘটনার সূত্র ধরে শুরু হয়েছিল। এতে প্রায় ২০০ ইসরায়েলি এবং ১,৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এই সময়ে হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়।
·
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (২০০০-২০০৫): ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ এরিয়েল শ্যারনের আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শনের ফলে এই বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়, যা প্রথম ইন্তিফাদার চেয়ে অনেক বেশি সহিংস ছিল। এতে ৪,০০০ ফিলিস্তিনি এবং ১,০০০ ইসরায়েলি নিহত হয়। ইসরায়েল এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম তীরে একটি নিরাপত্তা বেড়া নির্মাণ শুরু করে। প্রথম ইন্তিফাদা মূলত বেসামরিক প্রতিরোধ ছিল , কিন্তু দ্বিতীয় ইন্তিফাদা আরও সামরিকীকৃত ও চরমপন্থী সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়, যা শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার ধারণা এবং হামাসের মতো গোষ্ঠীগুলোর উত্থানকে প্রতিফলিত করে।
গাজা থেকে ইসরায়েলের বিচ্ছিন্নকরণ এবং এর পরিণতি
২০০৫ সালের আগস্টে ইসরায়েল গাজা উপত্যকা থেকে বসতি স্থাপনকারী ও সামরিক বাহিনী একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়। এই প্রত্যাহার সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজাকে ইসরায়েলি সামরিক দখলদারিত্বের অধীনেই বিবেচনা করে, কারণ ইসরায়েল এর সীমান্ত, আকাশসীমা এবং উপকূলরেখার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। বিচ্ছিন্নকরণের পর, ২০০৬ সালের ফিলিস্তিনি নির্বাচনে হামাস জয়লাভ করে এবং ২০০৭ সালে ফাতাহর সাথে সংঘর্ষের পর গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর ফলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
৪. শান্তির অধরা
পথ: চুক্তি,
ব্যর্থতা এবং অপূর্ণ আশা
ঐতিহাসিক চুক্তি: ক্যাম্প
ডেভিড এবং অসলোর প্রতিশ্রুতি
·
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি (১৯৭৮): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (জিমি কার্টার) মধ্যস্থতায় ইসরায়েল (মেনাচেম বেগিন) এবং মিশর (আনোয়ার আল-সাদাত) এর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এটি ইসরায়েল ও একটি আরব দেশের মধ্যে প্রথম শান্তি চুক্তির দিকে পরিচালিত করে, যেখানে ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ থেকে প্রত্যাহার করে। এটি পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা সম্পর্কিত আলোচনার ভিত্তিও স্থাপন করে।
·
অসলো চুক্তি (১৯৯৩, ১৯৯৫): ইসরায়েল (ইৎজাক রবিন) এবং পিএলও (ইয়াসির আরাফাত) এর মধ্যে গোপন আলোচনার ফলে পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং পশ্চিম তীর ও গাজার কিছু অংশে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) অন্তর্বর্তীকালীন স্ব-শাসনের ব্যবস্থা তৈরি হয়। এই চুক্তিগুলোর লক্ষ্য ছিল ১৯৯৯ সালের মধ্যে একটি চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি অর্জন।
শান্তি প্রক্রিয়ার সমালোচনা:
অমীমাংসিত সমস্যা
এবং সুদৃঢ়
বাস্তবতা
·
ক্যাম্প ডেভিড (১৯৭৮): ইসরায়েল-মিশর শান্তি প্রতিষ্ঠায় এটি একটি মাইলফলক হলেও, এটি আরব বিশ্বে মিশরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং ফিলিস্তিনি সমস্যাসহ বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। আনোয়ার আল-সাদাতকে তার ভূমিকার জন্য হত্যা করা হয়।
·
অসলো চুক্তি (১৯৯৩-১৯৯৯): এই চুক্তিগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের একটি নতুন ব্যবস্থা তৈরি করেছে বলে সমালোচিত হয়।
o ইসরায়েল আলোচনাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করতে এবং অবৈধ বসতি সম্প্রসারণে ব্যবহার করে (১৯৯২-২০০০ সালের মধ্যে বসতি স্থাপনকারীদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়)।
o ফিলিস্তিনিদের চলাচলের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
o মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করা হয়।
o এর ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভেদ সৃষ্টি হয়, যেখানে পিএ-এর আধা-সামরিক পুলিশ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সাথে কাজ করে ভিন্নমত দমন করে।
o পশ্চিম তীরকে এরিয়া এ, বি এবং সি-তে বিভক্ত করা হয়, যেখানে ইসরায়েল ৬০% (এরিয়া সি) এর উপর পূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
o অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ফিলিস্তিনি অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়।
o উভয় পক্ষের চরমপন্থীরা শান্তি প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে।
·
২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলন: জেরুজালেমের মর্যাদা এবং টেম্পল মাউন্টের সার্বভৌমত্ব নিয়ে অমীমাংসিত মতবিরোধের কারণে এই শীর্ষ সম্মেলন ব্যর্থ হয়। এর ব্যর্থতার জন্য আরাফাতকে ইসরায়েলি ও আমেরিকান আখ্যানে প্রায়শই দায়ী করা হয়, যদিও অন্যরা যুক্তি দেন যে ইসরায়েলের প্রস্তাব অপর্যাপ্ত ছিল এবং ফিলিস্তিনিরা একটি চূড়ান্ত চুক্তির জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই ব্যর্থতা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই শান্তি প্রক্রিয়াগুলোর সমালোচনা থেকে বোঝা যায় যে, মূল সমস্যাগুলোর
সমাধান না করে কেবল আন্তঃরাষ্ট্রীয়
সম্পর্ক বা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে "শান্তি" অর্জনের চেষ্টা করলে তা ভঙ্গুর হয় এবং এমনকি অন্তর্নিহিত উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। অসলো চুক্তির মতো "অন্তর্বর্তীকালীন"
ব্যবস্থাগুলো স্থায়ী নিয়ন্ত্রণে পরিণত হওয়ার প্রবণতা দেখায়, যা দখলদারিত্বকে সুদৃঢ় করে এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ বাড়ায়। এটি আন্তর্জাতিক
তদারকি ও মধ্যস্থতা ব্যবস্থার একটি বড় ব্যর্থতাকে নির্দেশ করে।
এছাড়াও, ইৎজাক রবিনের হত্যাকাণ্ড এবং বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উত্থান দেখায় যে কীভাবে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিরোধীরা শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে। একইভাবে, হামাসের অসলো প্রত্যাখ্যান এবং তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ এবং "উভয় পক্ষের কঠোরপন্থীদের" শান্তি প্রক্রিয়াকে "ব্যাহত" করার ক্ষমতাকে তুলে ধরে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে শান্তি আলোচনা কেবল আন্তর্জাতিক কূটনীতি নয়, বরং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ, চরমপন্থী মতাদর্শ এবং নেতাদের শান্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছার উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।
৫. জবাবদিহিতা ও কর্তৃত্ব: প্রধান অভিনেতাদের একটি সমালোচনামূলক পরীক্ষা
৫.১. হামাস:
আদর্শ, অপারেশন
এবং ধ্বংসাত্মক প্রভাব
·
উৎপত্তি, সনদ এবং একটি জঙ্গি শক্তি হিসেবে বিবর্তন:
o হামাস (ইসলামিক প্রতিরোধ আন্দোলন) একটি ফিলিস্তিনি সুন্নি ইসলামপন্থী সামরিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, প্যারাগুয়ে এবং ইসরায়েল কর্তৃক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে মনোনীত।
o ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার সময় মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসেবে শেখ আহমেদ ইয়াসিন কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
o এর ১৯৮৮ সালের সনদে ইসরায়েল ধ্বংস এবং ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের (বর্তমান ইসরায়েল, পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে গঠিত) সমগ্র অঞ্চলে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়, যেখানে ইহুদি-বিরোধী বক্তব্যও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও ২০১৭ সালের একটি সংশোধনীতে ইসরায়েল ধ্বংসের আহ্বান বাদ দেওয়া হয়, এটি এখনও ইসরায়েলকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
o হামাস একটি সামাজিক কল্যাণ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করে, যা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করে এবং হামাসের সামরিক কার্যক্রমের জন্য তহবিল সংগ্রহের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
o ২০০৬ সালের ফিলিস্তিনি নির্বাচনে ফাতাহকে পরাজিত করার পর এবং ২০০৭ সালে সংঘর্ষের মাধ্যমে গাজার নিয়ন্ত্রণ জোরপূর্বক দখল করার পর হামাস গাজায় তার ক্ষমতা প্রসারিত করে। এর ফলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
·
কৌশল, সামরিক কাঠামো এবং ইসরায়েলে প্রধান হামলা:
o হামাসের সামরিক শাখা হলো আল-কাসসাম ব্রিগেড, যা গাজা উপত্যকার বৃহত্তম এবং সেরা সজ্জিত জঙ্গি সংগঠন। এটি স্বাধীনভাবে কাজ করে তবে হামাসের বৃহত্তর রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোর অধীন।
o হামাসের কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে রকেট ও মর্টার হামলা, ব্যাপক গুলি, আত্মঘাতী বোমা হামলা, ড্রোন, ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র এবং একটি বিস্তৃত সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা।
o প্রধান হামলা:
§ ২০০৮-২০০৯ গাজা যুদ্ধ: প্রায় ৮০০ রকেট হামলার পর ইসরায়েল গাজা আক্রমণ করে। এতে শত শত বেসামরিক ও যোদ্ধা নিহত হয়।
§ ২০১৪ অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ: পারস্পরিক হামলার পর ইসরায়েল গাজা আক্রমণ করে। এতে প্রায় ২,০০০ গাজাবাসী, ৬৬ ইসরায়েলি সৈন্য এবং ৫ ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়।
§ ২০২১ ইসরায়েল-হামাস সংকট: পূর্ব জেরুজালেমে উচ্ছেদ এবং আল-আকসা মসজিদে সংঘর্ষের ফলে সংঘাত শুরু হয়। গাজায় ২০০ জনের বেশি এবং ইসরায়েলে অন্তত ১০ জন নিহত হয়। হামাস ও পিআইজে ৪,০০০ এর বেশি রকেট নিক্ষেপ করে।
§ ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামলা ("অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড"): ইসরায়েলের উপর একটি নজিরবিহীন আকস্মিক হামলা, যেখানে প্রায় ১,২০০ মানুষ (বেশিরভাগ বেসামরিক) নিহত হয় এবং ২০০-২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এই হামলায় রকেট হামলা, ১,৫০০ জঙ্গি (হামাস ও পিআইজে) দ্বারা অনুপ্রবেশ, কিবুতজিম এবং একটি সঙ্গীত উৎসবে হামলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। জাতিসংঘ যৌন সহিংসতার প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায়। হামাস অবরোধ ও দখলদারিত্বের কথা বলে এই হামলার ন্যায্যতা দাবি করে।
·
অভ্যন্তরীণ ফিলিস্তিনি গতিশীলতা: শাসন ও দলীয় কোন্দল:
o ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাসের বিজয়ের ফলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, কারণ হামাস ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে।
o ফাতাহ-হামাস সংঘাত (জুন ২০০৭) এর ফলে হামাস গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়, যা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত করে। এর ফলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) দুটি সত্তায় বিভক্ত হয়ে পড়ে: ফাতাহ-শাসিত ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ (পশ্চিম তীর) এবং হামাস সরকার (গাজা)।
o এই বিভাজন ফিলিস্তিনি সংসদকে অকার্যকর করে তোলে এবং পিএ আর্থিক সংকটে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং আরব দেশগুলো ফাতাহ-কে শক্তিশালী করতে এবং হামাসকে দুর্বল করতে সহায়তা করে।
সারণী: ইসরায়েলে হামাসের প্রধান হামলা (৭ই অক্টোবর ২০২৩-এর পূর্ব ও পরবর্তী) এবং হতাহতের সংখ্যা
হামলার তারিখ |
লক্ষ্যবস্তু/ঘটনা |
ইসরায়েলি হতাহত (আনুমানিক) |
ফিলিস্তিনি হতাহত (আনুমানিক) |
অন্যান্য তথ্য |
২০০৮-২০০৯ |
গাজা যুদ্ধ |
১৩ (সৈনিক ও বেসামরিক) |
১,১০০-১,৪০০ (বেসামরিক ও যোদ্ধা) |
৮০০ রকেট হামলার পর ইসরায়েলি আক্রমণ |
২০১৪ |
অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ |
৬৬ সৈন্য, ৫ বেসামরিক |
২,০০০ গাজাবাসী |
পারস্পরিক হামলার পর ইসরায়েলি আক্রমণ |
২০২১ |
ইসরায়েল-হামাস সংকট |
১০ (বেসামরিক ও সৈন্য) |
২০০ (গাজা) |
পূর্ব জেরুজালেমে উচ্ছেদ ও আল-আকসা মসজিদে সংঘর্ষের পর হামাস ও পিআইজে ৪,০০০+ রকেট নিক্ষেপ করে |
৭ই অক্টোবর ২০২৩ |
অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড |
১,২০০ (বেশিরভাগ বেসামরিক), ২৫১ জিম্মি |
- |
নজিরবিহীন আকস্মিক হামলা, রকেট হামলা, অনুপ্রবেশ, যৌন সহিংসতা |
৭ই অক্টোবর ২০২৩-বর্তমান |
গাজা যুদ্ধ |
১,৭০০ (৭ই অক্টোবরের হামলা সহ) |
~৫৫,০০০+ (গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়)
|
হামাস ও পিআইজে দ্বারা ইসরায়েলে রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র
ও ড্রোন হামলা (২৮,০০০+)। গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক সংকট |
ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ ফিলিস্তিন (পিএফএলপি) এর প্রধান হামলা:
হামাস ছাড়াও, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) এবং পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ ফিলিস্তিন (পিএফএলপি) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য হামলা চালিয়েছে। পিআইজে, যা ১৯৭৯ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, ইসরায়েল ধ্বংস এবং একটি ইসলামপন্থী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে। এটি ইরান ও হিজবুল্লাহর সমর্থন পায় এবং হামাসের পর গাজা ও পশ্চিম তীরের দ্বিতীয় বৃহত্তম জঙ্গি গোষ্ঠী। পিআইজে-এর সামরিক শাখা, আল-কুদস ব্রিগেড, ১৯৯০-এর দশক থেকে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুতে অসংখ্য হামলার জন্য দায়ী। এর কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে ছোট অস্ত্রের হামলা, মর্টার ও রকেট হামলা, এবং ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আত্মঘাতী বোমা হামলা।
পিআইজে-এর উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
·
১৯৮৭ সালের আগস্ট: গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক পুলিশের কমান্ডারের হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার।
·
১৯৮৯ সালের জুলাই: জেরুজালেম-তেল আবিব হাইওয়েতে এগড বাস ৪০৫-এ হামলা, যেখানে ১৪ জন নিহত ও কয়েক ডজন আহত হয়।
·
১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি: "নাইট অফ দ্য পিচফর্কস" নামে পরিচিত ঘটনায় পিআইজে সদস্যরা তাদের ঘাঁটিতে ঘুমন্ত তিন ইসরায়েলি সৈন্যকে ছুরি, কুঠার ও পিচফর্ক দিয়ে হত্যা করে।
·
৭ই অক্টোবর ২০২৩: হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলায় অংশ নেয়, যেখানে প্রায় ১,২০০ জন নিহত এবং ২৪০ জনের বেশি জিম্মি হয়।
পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ ফিলিস্তিন (পিএফএলপি), যা ১৯৬৭ সালে জর্জ হাবাশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ফিলিস্তিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সংগঠন। পিএফএলপি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না এবং "ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের" সম্পূর্ণ "মুক্তি"র পক্ষে, প্রায়শই সন্ত্রাসের মাধ্যমে। এটি ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে বিমান হাইজ্যাকের জন্য কুখ্যাত ছিল এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আত্মঘাতী বোমা হামলা, গুলি ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
পিএফএলপি-এর উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
·
১৯৬৮ সালের ২৩শে জুলাই: এল আল ফ্লাইট ৪২৬ হাইজ্যাক, যেখানে ২১ জন যাত্রী ও ১১ জন ক্রু ৩৯ দিন ধরে জিম্মি ছিল।
·
১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি: জেরুজালেমের একটি সুপারসোল সুপারমার্কেটে বোমা হামলা, যেখানে ২ জন নিহত ও ৯ জন আহত হয়।
·
১৯৭২ সালের ৩০শে মে: বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লড বিমানবন্দর গণহত্যা, যেখানে জাপানি রেড আর্মির সদস্যদের সাথে পিএফএলপি-এর সহযোগিতায় ২৮ জন যাত্রী নিহত হয়।
·
২০০১ সালের ২১শে অক্টোবর: ইসরায়েলি পর্যটন মন্ত্রী রেচাভাম জিভি-এর হত্যাকাণ্ড।
·
২০১৪ সালের নভেম্বর: জেরুজালেমের হার নফ পাড়ার একটি উপাসনালয়ে গণহত্যা, যেখানে চারজন উপাসক এবং একজন ইসরায়েলি দ্রুজ পুলিশ অফিসার নিহত হয়।
৫.২. ইসরায়েলি
নেতৃত্ব: নীতি,
বিতর্ক এবং আন্তর্জাতিক যাচাই-বাছাই
·
প্রধানমন্ত্রীদের সিদ্ধান্তের বিশ্লেষণ: রাষ্ট্র গঠন থেকে দখলদারিত্ব পর্যন্ত:
o ডেভিড বেন-গুরিয়ন (১৯৪৮-১৯৬৩): ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, জায়নবাদী আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে বিভিন্ন ইহুদি মিলিশিয়াকে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীতে (আইডিএফ) একীভূত করার এবং আরব লীগের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয়ের নেতৃত্ব দেন। তার নেতৃত্বে ফিলিস্তিনি আরব জনসংখ্যার বেশিরভাগকে বিতাড়িত বা বাস্তুচ্যুত করা হয়। তিনি গণ-অভিবাসন এবং ইহুদি অভিবাসীদের আত্মীকরণ তদারকি করেন। তার বিতর্কিত নীতিগুলোর মধ্যে ছিল ১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকটে মিশর আক্রমণের সমর্থন এবং আরব গেরিলা হামলার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক অভিযান। কিছু ঐতিহাসিক যুক্তি দেন যে বেন-গুরিয়ন ফিলিস্তিনি আরবদের বিতাড়নের ধারণাকে সমর্থন করেছিলেন, যদিও কোনো লিখিত আদেশ ছিল না।
o গোল্ডা মেয়ার (১৯৬৯-১৯৭৪): ইসরায়েলের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী, যিনি "আয়রন লেডি" নামে পরিচিত। ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে ইসরায়েলকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা পড়ার জন্য তাকে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে পূর্ণাঙ্গ সামরিক সমাবেশের অনুমোদন দিলেও, তিনি preemptive হামলার অনুমতি দেননি, কারণ এতে ইসরায়েলকে আগ্রাসী হিসেবে দেখা যেতে পারতো এবং মার্কিন সাহায্য ঝুঁকিতে পড়তো। তার সবচেয়ে বিতর্কিত মন্তব্যগুলোর মধ্যে একটি হলো ১৯৬৯ সালে তিনি বলেছিলেন যে "ফিলিস্তিনি বলে কিছু ছিল না"।
o মেনাচেম বেগিন (১৯৭৭-১৯৮৩): ইসরায়েলের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির জন্য আনোয়ার আল-সাদাতের সাথে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। তিনি "বৃহত্তর ইসরায়েলের" ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন, যা সমগ্র ফিলিস্তিনকে অন্তর্ভুক্ত করবে। তার মেয়াদে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় বসতি স্থাপন ত্বরান্বিত হয়, যা ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনাকে জটিল করে তোলে। ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধে ইসরায়েলি আক্রমণের নির্দেশ দেন, যার লক্ষ্য ছিল পিএলও-কে দুর্বল করা।
o ইৎজাক রবিন (১৯৭৪-১৯৭৭, ১৯৯২-১৯৯৫): ইসরায়েলের পঞ্চম ও একাদশ প্রধানমন্ত্রী। তিনি অসলো চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যার জন্য ইয়াসির আরাফাত ও শিমন পেরেসের সাথে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর ও গাজার কিছু অংশ ফিলিস্তিনিদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। এই "ভূমি হস্তান্তরের" ধারণাটি অনেক ধর্মপ্রাণ ইহুদির কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর ছিল, যারা পশ্চিম তীরকে ইহুদিদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করত। ১৯৯৫ সালে একজন ইহুদি চরমপন্থী কর্তৃক তার হত্যাকাণ্ড ইসরায়েলি সমাজে গভীর বিভেদ সৃষ্টি করে এবং শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।
o এরিয়েল শ্যারন (২০০১-২০০৬): ইসরায়েলের একাদশ প্রধানমন্ত্রী। তার বিতর্কিত নীতিগুলোর মধ্যে ছিল ২০০২ সালে পশ্চিম তীরে নিরাপত্তা বেড়া নির্মাণ শুরু করা এবং ২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা থেকে একতরফা বিচ্ছিন্নকরণ পরিকল্পনা। এই বিচ্ছিন্নকরণ পরিকল্পনাটি ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং ফিলিস্তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধির "জনসংখ্যার টাইম বোমা" মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে ছিল। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে এই বিচ্ছিন্নকরণ শান্তি প্রক্রিয়াকে হিমায়িত করতে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনকে বিলম্বিত করতে চেয়েছিল।
o এহুদ বারাক (১৯৯৯-২০০১): ইসরায়েলের দশম প্রধানমন্ত্রী। ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলনে তার ভূমিকা বিতর্কিত ছিল, যা জেরুজালেমের মর্যাদা নিয়ে অমীমাংসিত মতবিরোধের কারণে ব্যর্থ হয়। ইসরায়েলি ও আমেরিকান আখ্যানে প্রায়শই আরাফাতকে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয়, যদিও ফিলিস্তিনিরা মনে করে ইসরায়েলের প্রস্তাব অপর্যাপ্ত ছিল এবং তারা চূড়ান্ত চুক্তির জন্য প্রস্তুত ছিল না। এই ব্যর্থতা দ্বিতীয় ইন্তিফাদার একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
o এহুদ ওলমার্ট (২০০৬-২০০৯): ইসরায়েলের দ্বাদশ প্রধানমন্ত্রী। তার মেয়াদে ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ এবং ২০০৮-২০০৯ সালের গাজা যুদ্ধ (অপারেশন কাস্ট লিড) সংঘটিত হয়। গাজায় ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচক হিসেবে তিনি বলেছেন যে ইসরায়েল "যুদ্ধাপরাধের খুব কাছাকাছি" কাজ করছে। তার শান্তি প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিম তীরের প্রায় ৯৪% ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে ছেড়ে দেওয়া, জেরুজালেমকে ইহুদি ও আরব অংশে বিভক্ত করা এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের "প্রত্যাবর্তনের অধিকার" অস্বীকার করা।
সারণী: ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এবং বিতর্কিত নীতি/সিদ্ধান্ত
প্রধানমন্ত্রী |
মেয়াদকাল |
বিতর্কিত নীতি/সিদ্ধান্ত |
প্রভাব/সমালোচনা |
ডেভিড বেন-গুরিয়ন |
১৯৪৮-১৯৬৩ |
১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের
বিতাড়ন; প্রতিশোধমূলক
সামরিক অভিযান। |
ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি;
সংঘাতের সামরিকীকরণ। |
গোল্ডা মেয়ার |
১৯৬৯-১৯৭৪ |
১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে অপ্রস্তুতি; "ফিলিস্তিনি বলে কিছু ছিল না" মন্তব্য। |
ব্যাপক ইসরায়েলি হতাহত; ফিলিস্তিনি পরিচয়ের অস্বীকার। |
মেনাচেম বেগিন |
১৯৭৭-১৯৮৩ |
পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ; ১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধ। |
শান্তি প্রক্রিয়ার জটিলতা; লেবাননে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক সংকট। |
ইৎজাক রবিন |
১৯৯২-১৯৯৫ |
অসলো চুক্তি; পশ্চিম তীর ও গাজা হস্তান্তর। |
ইহুদি চরমপন্থীদের দ্বারা বিরোধিতা ও হত্যাকাণ্ড; শান্তি প্রক্রিয়ার ভঙ্গুরতা। |
এরিয়েল শ্যারন |
২০০১-২০০৬ |
পশ্চিম তীরে নিরাপত্তা বেড়া নির্মাণ; গাজা থেকে একতরফা বিচ্ছিন্নকরণ। |
ফিলিস্তিনিদের
চলাচলে বাধা; শান্তি প্রক্রিয়াকে হিমায়িত করার অভিযোগ। |
এহুদ বারাক |
১৯৯৯-২০০১ |
২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলনের ব্যর্থতা; জেরুজালেম ও টেম্পল মাউন্ট নিয়ে অনমনীয় অবস্থান |
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূত্রপাত; শান্তি প্রক্রিয়ার পতন |
এহুদ ওলমার্ট |
২০০৬-২০০৯ |
২০০৮-২০০৯ গাজা যুদ্ধ; ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ |
গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক সংকট; আন্তর্জাতিক
সমালোচনা |
·
বসতি সম্প্রসারণ: নীতি, প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক আইনি চ্যালেঞ্জ:
o ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পরপরই দখলকৃত অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু হয়। ইসরায়েলের বসতি স্থাপন নীতি লেভি এশকোল-এর লেবার সরকার কর্তৃক উৎসাহিত হয় এবং পরে মেনাচেম বেগিন-এর লিকুদ সরকার কর্তৃক তীব্রতর হয়।
o এই বসতিগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অসংখ্য প্রস্তাব (যেমন ৪৪৬, ৪৭৮, ২৩৩৪) এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এর রায় (২০০৪, ২০২৪) বসতিগুলোকে আন্তর্জাতিক আইনের "প্রকাশ্য লঙ্ঘন" বলে ঘোষণা করেছে।
o চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দখলদার শক্তি তার নিজস্ব বেসামরিক জনসংখ্যাকে দখলকৃত অঞ্চলে স্থানান্তর করতে পারবে না, যা ইসরায়েল কর্তৃক লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচিত।
o বসতি স্থাপন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে খণ্ডিত করে, একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, যার মধ্যে চলাচলের স্বাধীনতা, জীবিকা এবং সম্পত্তির অধিকার অন্তর্ভুক্ত।
o বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা এবং এর জন্য দায়মুক্তির বিষয়টি গুরুতর উদ্বেগের কারণ, যা প্রায়শই সামরিক সমর্থন ও সুরক্ষায় ঘটে।
·
সামরিক অভিযান এবং মানবাধিকার উদ্বেগ:
o ইসরায়েলি সামরিক অভিযানগুলো, বিশেষ করে গাজা উপত্যকায়, ব্যাপক বেসামরিক হতাহত এবং অবকাঠামো ধ্বংসের কারণ হয়েছে।
o জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, সম্মিলিত শাস্তি এবং এমনকি গণহত্যার অভিযোগ এনেছে।
o অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে ৫৫,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। প্রায় ১.৯ মিলিয়ন মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
o গাজায় ৮৭% এর বেশি স্কুল এবং সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রায় ৮৪% ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
o ইসরায়েল কর্তৃক খাদ্য, পানি ও জ্বালানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা গাজায় তীব্র মানবিক সংকট ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি তৈরি করে।
৬. ইহুদি জাতির প্রতি নিপীড়নের ইতিহাস
ইহুদি জাতি দীর্ঘ এবং প্রায়শই মর্মান্তিক নিপীড়নের ইতিহাস সহ্য করেছে, যা তাদের পরিচয় এবং একটি নিরাপদ জন্মভূমির আকাঙ্ক্ষাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের একটি ব্যাপক বিশ্লেষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৬.১. প্রাথমিক
ইসলামিক ইতিহাস:
ইহুদি গোত্রগুলোর ভাগ্য
·
মদিনার প্রেক্ষাপট: ইসলামের আবির্ভাবের আগে, মদিনা (ইয়াসরিব) ছিল একটি বহু-জাতিগত ও বহু-সাংস্কৃতিক সমাজ, যেখানে বনু নাদির, বনু কায়নুকা এবং বনু কুরাইজা-এর মতো বিশিষ্ট ইহুদি গোত্রগুলো বসবাস করত। এই গোত্রগুলো তাদের স্বর্ণকার এবং অস্ত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত ছিল। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে যখন নবী মুহাম্মদ মদিনায় আসেন, তখন তিনি প্রাথমিকভাবে ইহুদি গোত্রগুলোর কাছ থেকে একটি স্বাগত অভ্যর্থনা আশা করেছিলেন। তবে, স্থানীয় রাজনৈতিক গতিশীলতা এবং আরব গোত্র খাজরাজ ও আওস গ্রোত্রের মধ্যে গৃহযুদ্ধে ইহুদি গোত্রগুলোর জড়িত থাকার কারণে সম্পর্ক দ্রুত অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
·
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং বহিষ্কার: পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে, ইহুদি নেতারা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে একাধিকবার কাজ করেছেন বলে জানা যায়, কিছু সূত্র অনুযায়ী তাকে অন্তত দুবার হত্যার ষড়যন্ত্র এবং একবার বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়েছিল। ফলস্বরূপ, এই গোত্রগুলোর মধ্যে দুটি, বনু নাদির এবং বনু কায়নুকা, তাদের চুক্তি রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং নবীন মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি অনুভূত হুমকি তৈরি করায় মদিনা থেকে নির্বাসিত হয়েছিল।
·
বনু কুরাইজা ঘটনা (৬২৭ খ্রিস্টাব্দ):
o অভিযুক্ত বিশ্বাসঘাতকতা: ৬২৭ খ্রিস্টাব্দে খন্দকের যুদ্ধে, যখন মক্কার বাহিনী মদিনা অবরোধ করে, তখন বনু কুরাইজা, পূর্বের চুক্তি থাকা সত্ত্বেও, অবরোধকারী সেনাবাহিনীর সাথে আলোচনায় প্রবেশ করে বলে অভিযোগ করা হয়। এই কাজটিকে একটি গুরুতর বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হয়েছিল, যা মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি বিধ্বংসী দ্বি-মুখী আক্রমণের মুখে ঠেলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল বলে মুসলিমরা দাবী করে থাকে।
o অবরোধ এবং সালিশ: মক্কার বাহিনী প্রত্যাহার করার পর, মুহাম্মদের সেনাবাহিনী ২৫ দিন ধরে বনু কুরাইজার দুর্গ অবরোধ করে রাখে। গোত্রটি শেষ পর্যন্ত নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে, তাদের ভাগ্য সা'দ ইবনে মু'আদের হাতে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়, যিনি বনু কুরাইজার একজন প্রাক্তন মিত্র ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
o রায় এবং মৃত্যুদণ্ড: সা'দ, যিনি যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন, রায় দেন যে বনু কুরাইজার সমস্ত পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হবে। মুহাম্মদ এই রায় মেনে নেন। মুসলিম সূত্র অনুযায়ী, ৪০০ থেকে ৯০০ জন পুরুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল এবং মদিনার বাজারে খনন করা পরিখায় দাফন করা হয়েছিল।
o ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা: পণ্ডিতরা উল্লেখ করেন যে এই রায় ৭ম শতাব্দীর আরবের যুদ্ধের প্রচলিত নিয়মাবলীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, যেখানে উপজাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার গুরুতর পরিণতি হতে পারত। তবে, কিছু আধুনিক ঐতিহাসিক প্রাথমিক চুক্তির ঐতিহাসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং পরামর্শ দেন যে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য, যেমন লুটপাট এবং ভূমি অধিগ্রহণ, এই নির্মূলকরণে ভূমিকা পালন করতে পারে। এটাকে চরম অমনানবিক ও নবী মোহাম্মাদের কদর্য রূপের বহিঃপ্রকাশ
বলেও মতামত দেন অনেক ঐতিহাসিক।
·
মুসলিম শাসনের অধীনে ইহুদি জীবনের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট: মুসলিম শাসনের অধীনে ইহুদি সম্প্রদায়গুলো
ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন ধরনের আচরণের শিকার হয়েছে। যদিও তাদের প্রায়শই ধিম্মি (কিছু অধিকার এবং বিধিনিষেধ সহ সুরক্ষিত অমুসলিম) মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তবে গুরুতর নিপীড়নের সময়কালও অস্বাভাবিক ছিল না। উদাহরণস্বরূপ,
উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেনে আলমোহাদ খিলাফত (১২-১৩ শতক) সিনাগগ ধ্বংস করে, ইহুদি প্রথা নিষিদ্ধ করে এবং ইসলামে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ
চাপিয়ে দেয়। পারস্যে (১৭-১৯ শতক), ইহুদিরা বহিষ্কার, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ (যেমন ১৮৩৯ সালের মেশেদ ঘটনা), এবং বৈষম্যমূলক আইনের মুখোমুখি হয়েছিল। জায়দি ইয়েমেনও গুরুতর বৈষম্যমূলক আইন চাপিয়েছিল, যা জোরপূর্বক নির্বাসনের দিকে পরিচালিত করেছিল। যদিও কিছু ঐতিহাসিক আপেক্ষিক সহনশীলতার সময়কালকে গুরুত্ব দেন, অন্যরা জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, গণহত্যা এবং অপমানজনক নিয়মের পুনরাবৃত্ত ঘটনাগুলোকে তুলে ধরেন, যুক্তি দেন যে ইহুদি সম্প্রদায়গুলো
চিরস্থায়ী নির্ভরশীলতা
এবং দুর্বলতার অবস্থায় ছিল।
৬.২. হলোকাস্ট:
এক নজিরবিহীন
বিপর্যয়
·
সংজ্ঞা এবং পরিধি: হলোকাস্ট ছিল ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নাৎসি জার্মান শাসন এবং তার মিত্র ও সহযোগীদের দ্বারা ছয় মিলিয়ন (ষাট লক্ষ) ইউরোপীয় ইহুদিদের পদ্ধতিগত, রাষ্ট্র-পৃষ্ঠপোষকতামূলক
নিপীড়ন এবং গণহত্যামূলক হত্যাকাণ্ড। এটি "শোয়া" নামেও পরিচিত, একটি হিব্রু শব্দ যার অর্থ ‘‘মহাবিপর্যয়’’।
এই গণহত্যায় ১৯৩৩ সালে ইউরোপের ৯ মিলিয়ন (নব্বই লক্ষ) ইহুদির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশকে
লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল।
·
নিপীড়নের পদ্ধতি:
o আইনি বৈষম্য: ১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে, নুরেমবার্গ রেস আইন-এর মতো ইহুদি-বিরোধী আইনগুলো ইহুদিদের অধিকার ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, তাদের সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করে এবং ইহুদি মালিকানাধীন ব্যবসাগুলো বন্ধ করে দেয়।
o প্রকাশ্য চিহ্নিতকরণ এবং বর্জন: ইহুদিদের ইহুদি-বিরোধী প্রচার, ইহুদি মালিকানাধীন
ব্যবসা বয়কট, প্রকাশ্য অপমান এবং হলুদ তারার মতো চিহ্নিতকরণ চিহ্ন পরতে বাধ্য করা হয়।
o সংগঠিত সহিংসতা: ক্রিস্টালনাখট (নভেম্বর ১৯৩৮)-এর মতো ঘটনাগুলোতে ইহুদি সম্পত্তি ও সিনাগগগুলোর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখা যায়, পাশাপাশি অন্যান্য পোগ্রোম (দাঙ্গা) এবং বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনাও ঘটে।
o শারীরিক বাস্তুচ্যুতি এবং অন্তরীণকরণ: ইহুদিদের জোরপূর্বক অভিবাসন, পুনর্বাসন, বহিষ্কার, নির্বাসন এবং জনাকীর্ণ ঘেটোতে (যেমন ওয়ারশ, লডজ) আটকে রাখা হয়, যেখানে অনাহার, রোগ এবং অমানবিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক মৃত্যু ঘটে।
·
"চূড়ান্ত সমাধান" (১৯৪১-১৯৪৫): এটি ইউরোপীয় ইহুদিদের ইচ্ছাকৃত এবং পদ্ধতিগত গণহত্যামূলক হত্যাকাণ্ডকে চিহ্নিত করে।
o গণহত্যা: মোবাইল কিলিং ইউনিট (আইনস্যাটজগ্রুপেন) ৫০০,০০০ এরও বেশি সোভিয়েত ইহুদি এবং অন্যান্যদের
হত্যা করে, প্রাথমিকভাবে তাদের গণকবরে গুলি করে।
o কিলিং সেন্টার (নির্মূল শিবির/মৃত্যু শিবির): জার্মান-অধিকৃত পোল্যান্ডে বিশেষ নকশার শিবির যেমন আউশভিৎজ-বিরকেনাউ, বেলজেক, চেম্নো, সোবিবোর এবং ট্রেবলিঙ্কা তৈরি করা হয়েছিল, যার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে ইহুদিদের কার্যকরভাবে গণহত্যামূলক
হত্যাকাণ্ড। ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদিদের রেলপথে এই শিবিরগুলোতে পরিবহন করা হতো, প্রায়শই পৌঁছানোর সাথে সাথেই তাদের গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হতো।
·
পরিধি এবং প্রভাব: হলোকাস্টের ফলে প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদি নিহত হয়, যা ৭ই অক্টোবর ২০২৩-কে হলোকাস্টের পর ইহুদিদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক দিন হিসেবে চিহ্নিত করে। এই নজিরবিহীন গণহত্যা ইউরোপ জুড়ে হাজার হাজার ইহুদি সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দেয়, বেঁচে থাকাদের গভীর মানসিক আঘাত, ক্ষতি এবং বাস্তুচ্যুতির শিকার করে।
·
দায়িত্ব: হলোকাস্ট ছিল একটি বিশাল উদ্যোগ, যেখানে অ্যাডলফ হিটলার, অন্যান্য নাৎসি নেতা (গোরিং, হিমলার, হেইডরিখ, আইখম্যান), অসংখ্য জার্মান প্রতিষ্ঠান (নাৎসি পার্টি, এসএস, গেস্টাপো, সামরিক বাহিনী, রেলওয়ে, স্বাস্থ্যসেবা
ব্যবস্থা, ব্যবসা) এবং অসংখ্য সাধারণ জার্মান নাগরিক উৎসাহ, ভয়, লোভ বা ইহুদি-বিদ্বেষের মাধ্যমে অংশ নিয়েছিল। ইউরোপ জুড়ে অ-জার্মান সরকার এবং ব্যক্তিরাও ইহুদি-বিরোধী আইন প্রণয়ন, ইহুদিদের আটক এবং গণহত্যায় অংশ নিয়ে সহযোগিতা করেছিল।
৬.৩. নিপীড়নের
চক্র: শিকার
থেকে নিপীড়ক
ইতিহাসে প্রায়শই দেখা যায় যে, যারা একসময় নিপীড়নের শিকার হয়, তারাই পরবর্তীতে নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। এই ঘটনাকে "শিকার থেকে নিপীড়ক" (victim-to-perpetrator) চক্র বা "সহিংসতার চক্র" (cycle of violence) হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। মনস্তাত্ত্বিকভাবে, এটি "ঐতিহাসিক ট্রমা" (historical trauma) বা বহু-প্রজন্মের ট্রমার ফল হতে পারে, যা একটি নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক, জাতিগত বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী দ্বারা অভিজ্ঞ হয়। এই ধরনের ট্রমা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে গভীর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটায়, যার ফলে "সহিংস বা আগ্রাসী আচরণের প্রবণতা" বৃদ্ধি পেতে পারে এবং আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ও সামাজিক মূল্যবোধে প্রভাব ফেলতে পারে।
এই চক্রের ঐতিহাসিক উদাহরণ বিরল নয়। যেমন, ইউরোপে ক্যাথলিকরা প্রোটেস্ট্যান্টদের এবং প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিকদের নিপীড়ন করেছে। মুসলিম শাসনের অধীনে ইহুদি সম্প্রদায়গুলোও বিভিন্ন সময়ে গুরুতর নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে, যেখানে সিনাগগ ধ্বংস, ইহুদি প্রথা নিষিদ্ধকরণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের নিপীড়ন দীর্ঘস্থায়ী মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে, যা একটি গোষ্ঠীর মধ্যে টিকে থাকার জন্য চরম পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা তৈরি করতে পারে।
ইহুদি জাতির ক্ষেত্রে, হলোকাস্টের মতো নজিরবিহীন গণহত্যা এবং শতাব্দীব্যাপী নিপীড়নের অভিজ্ঞতা তাদের সম্মিলিত স্মৃতিতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। এই চরম ট্রমা এবং অস্তিত্বের হুমকির মুখে টিকে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা একটি মানসিকতা তৈরি করতে পারে, যেখানে নিজেদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এর ফলস্বরূপ, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এবং চলমান সংঘাতে, ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের কিছু পদক্ষেপকে আন্তর্জাতিকভাবে
"দখলদারিত্ব" এবং "মানবাধিকার লঙ্ঘন" হিসেবে দেখা হয়। এই পদক্ষেপগুলো, যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়, ফিলিস্তিনিদের কাছে নিপীড়নমূলক বলে বিবেচিত হয় এবং এটি "শিকার থেকে নিপীড়ক" চক্রের একটি জটিল প্রতিফলন হতে পারে। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, যা কোনো নির্দিষ্ট পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দেয় না, বরং ঐতিহাসিক ট্রমার গভীর প্রভাব এবং সংঘাতের বহুমাত্রিক প্রকৃতিকে তুলে ধরে।
৭. বৈশ্বিক দাবা
বোর্ড: বিশ্বনেতা,
ভূ-রাজনৈতিক
স্বার্থ এবং সুযোগবাদ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: অবিচল
সমর্থন এবং কৌশলগত হিসাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় সামরিক সহায়তাকারী, যার বার্ষিক সহায়তা প্যাকেজ ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এটি ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি গভীর প্রতিশ্রুতি এবং উভয় দেশের মধ্যে ভাগ করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও কৌশলগত স্বার্থ দ্বারা চালিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের সমালোচনাকারী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোতে ভেটো দিয়েছে, যা তার অবিচল কূটনৈতিক সমর্থনকে তুলে ধরে। ৯/১১ হামলার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি সন্ত্রাসবাদ বিরোধী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভাবিত হয়েছে, যা ইসরায়েল এবং কিছু আরব দেশের সাথে গোয়েন্দা ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সহযোগিতাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের অধিকারের চেয়ে ইসরায়েলের স্বার্থকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ইসরায়েলিদের মধ্যে ৮১% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক বলে মনে করে, তবে ৫০% মনে করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের পক্ষে বেশি পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন। ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামলার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ব্যাপক সামরিক, কূটনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে, যার মধ্যে ১০,০০০ টনের বেশি অস্ত্র এবং ১৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। এই অস্ত্র স্থানান্তরগুলো প্রায়শই গোপন রাখা হয়েছে, যা জনসাধারণের যাচাই-বাছাই এড়াতে এবং কংগ্রেসের তদারকি রোধ করতে সাহায্য করে। এই পদক্ষেপগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে তার ভূমিকা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধানে তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন: অর্থনৈতিক
প্রভাব এবং বিভক্ত কূটনীতি
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, যা ইসরায়েলের মোট বাণিজ্যের ৩২% এর জন্য দায়ী। এই গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক ইইউকে সংঘাতের উপর অর্থনৈতিক প্রভাব প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেয়। তবে, ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রায়শই বিভেদ দেখা যায়, যেখানে হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, অস্ট্রিয়া এবং জার্মানি ইসরায়েলের পক্ষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নেয়, অন্যদিকে আয়ারল্যান্ড, স্পেন এবং স্লোভেনিয়া ফিলিস্তিনিদের প্রতি বেশি সহানুভূতি দেখায়।
ইইউ-ইসরায়েল অ্যাসোসিয়েশন চুক্তির ২ নম্বর অনুচ্ছেদ, যা মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ককে সংযুক্ত করে, ইসরায়েলের গাজায় পদক্ষেপের কারণে লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইইউ-এর কিছু সদস্য রাষ্ট্র ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি স্থগিত করেছে, তবে জার্মানি এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরে ইসরায়েলের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক সরবরাহকারী। এই বিভেদ ইউরোপকে ইসরায়েলের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে বাধা দেয়, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখে ইউরোপের নৈতিক উচ্চতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
রাশিয়া এবং চীন: জোট পরিবর্তন এবং আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
রাশিয়া ও চীন ফিলিস্তিনি ইস্যুতে একই অবস্থান ভাগ করে নেয় এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের জন্য দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান প্রতিষ্ঠায় একসাথে কাজ করার পরিকল্পনা করে। চীন নিজেকে একটি শান্তি-সন্ধানী, "নিরপেক্ষ" পরাশক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের বিপরীতে একটি স্থিতিশীলতাবিহীন প্রভাব হিসেবে বিবেচিত। চীন হামাসের ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামলাকে "সন্ত্রাসী হামলা" হিসেবে বর্ণনা করতে বিরত থাকে, তবে ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপকে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের "সম্মিলিত শাস্তি" বলে অভিহিত করে।
চীন এই সংঘাতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থানকে দুর্বল করতে এবং "আলোচনা শক্তি" যুদ্ধে জয়ী হতে ব্যবহার করে, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি বিশ্বব্যাপী সহানুভূতিকে পুঁজি করে। রাশিয়াও এই সংঘাতকে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বাড়ানোর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ হিসেবে দেখে।
ইরান এবং তুরস্ক:
আঞ্চলিক ক্ষমতা
খেলা এবং প্রক্সি সমর্থন
ইরান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অভিনেতা, যা হামাস, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হাউথিদের মতো বিভিন্ন ফিলিস্তিনি ও আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তহবিল, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সমর্থন করে। ইরান এই গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার "প্রতিরোধ অক্ষের" অংশ হিসেবে দেখে। ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামাসের হামলার পর ইরান প্রকাশ্যে হামাসের প্রশংসা করে এবং তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে।
তুরস্ক, যদিও দীর্ঘদিনের ইসরায়েলের মিত্র, রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের অধীনে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের পদক্ষেপের ক্রমবর্ধমান সমালোচক হয়ে উঠেছে। তুরস্ক হামাসকে "স্বাধীনতা সংগ্রামী" হিসেবে বর্ণনা করে এবং ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামাসের হামলার নিন্দা করতে অস্বীকার করে। তুরস্কের এই নীতি তার বৃহত্তর কৌশলগত স্বার্থ এবং আরব বিশ্বে একটি প্রধান অভিনেতা হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করার ইচ্ছার উপর ভিত্তি করে।
আরব রাষ্ট্রসমূহ: স্বাভাবিকীকরণ, মধ্যস্থতা এবং অভ্যন্তরীণ চাপ
২০২০ সালে স্বাক্ষরিত "আব্রাহাম অ্যাকর্ডস" ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, যা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এই চুক্তিগুলো ইরানকে একটি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখার একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে উন্নত প্রযুক্তি ও নতুন বাণিজ্য সুযোগের সুবিধা প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে বাইপাস করতে ব্যবহার করে।
তবে, গাজা যুদ্ধের পর স্বাভাবিকীকরণের রাজনৈতিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ আরব জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রবল। এই সংঘাত সৌদি আরবের সাথে স্বাভাবিকীকরণ প্রচেষ্টাকে স্থগিত করেছে এবং ইরানের সাথে সামরিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে। মিশর ও কাতার ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে।
সারণী: প্রধান আন্তর্জাতিক অভিনেতা: ঘোষিত নীতি বনাম অনুভূত সুবিধাবাদী স্বার্থ
আন্তর্জাতিক অভিনেতা |
ঘোষিত নীতি |
অনুভূত সুবিধাবাদী স্বার্থ |
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র |
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান, ইসরায়েলের নিরাপত্তা, মানবিক সহায়তা |
মধ্যপ্রাচ্যে
কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখা, অস্ত্র শিল্পের লাভ |
ইউরোপীয়
ইউনিয়ন |
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান, আন্তর্জাতিক
আইন ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা |
ইসরায়েলের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভেদ |
রাশিয়া |
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান, ফিলিস্তিনিদের
অধিকারের প্রতি সমর্থন |
মধ্যপ্রাচ্যে
মার্কিন প্রভাব হ্রাস করা, আঞ্চলিক ক্ষমতা বাড়ানো |
চীন |
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান, বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা, মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ধারণ করা, বৈশ্বিক দক্ষিণ দেশগুলোর সমর্থন আদায় |
ইরান |
ইসরায়েল ধ্বংস, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সমর্থন |
আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার, প্রক্সি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইসরায়েলকে চ্যালেঞ্জ করা |
তুরস্ক |
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান, স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র, পূর্ব জেরুজালেম রাজধানী |
আরব বিশ্বে প্রধান অভিনেতা হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি, আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানো |
আরব রাষ্ট্রসমূহ |
ফিলিস্তিনিদের
অধিকার, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান |
নিরাপত্তা উদ্বেগ (ইরান), অর্থনৈতিক লাভ, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা |
বিশ্বনেতাদের ভূমিকা প্রায়শই তাদের ঘোষিত নীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা দ্বারা চিহ্নিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলের প্রতি অবিচল সমর্থন তার কৌশলগত স্বার্থ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ দমনের লক্ষ্যের সাথে জড়িত। তবে, এই সমর্থন ফিলিস্তিনিদের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একইভাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকার থাকলেও, তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিভেদ ইসরায়েলের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া গ্রহণে বাধা দেয়। রাশিয়া ও চীন, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং নিজেদের আঞ্চলিক অবস্থান শক্তিশালী করতে চায়। এই অভিনেতাদের পদক্ষেপগুলো সংঘাতের গতিপথকে প্রভাবিত করে এবং প্রায়শই শান্তি প্রচেষ্টার চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, যা সংঘাতের দীর্ঘস্থায়ীত্বে অবদান রাখে।
৭.৪. মুসলিম
বিশ্বনেতাদের ভূমিকা:
সংহতি ও বিভেদ
মুসলিম বিশ্বের নেতারা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে একটি জটিল এবং প্রায়শই বিভক্ত ভূমিকা পালন করেছেন। মুসলিম দেশগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান আন্তঃসরকারি সংস্থা হিসেবে, অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন (OIC) ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে কথা বলেছে এবং ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও বসতি স্থাপনের নিন্দা করেছে। OIC-এর লক্ষ্য হলো মুসলিমদের অধিকার রক্ষা করা, ইসলামিক ঐক্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ফিলিস্তিন ও এর পবিত্র স্থানগুলোকে রক্ষা করা, বিশেষ করে আল-কুদস (জেরুজালেম)।
তবে, OIC-এর প্রভাব অভ্যন্তরীণ বিভেদ, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় স্বার্থ এবং ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার কারণে সীমিত হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়া মূলত প্রতীকী (যেমন নিন্দা এবং জরুরি বৈঠকে সীমাবদ্ধ) এবং এটি ইসরায়েলি নীতিকে প্রভাবিত করার জন্য অর্থপূর্ণ কূটনৈতিক উদ্যোগ বা নিষেধাজ্ঞা সংগঠিত করতে পারেনি বা সেই সক্ষমতাও OIC-এর আছে কিনা আমাদের সেটাও
বিবেচনা করে দেখতে হবে। এই অকার্যকারিতা ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে দুর্বল করেছে, বিশেষ করে ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিকীকরণের প্রবণতার কারণে। OIC-এর একটি সুসংহত নীতি, জেরুজালেমের মর্যাদা, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের মতো মূল বিষয়গুলোতে ঐকমত্য এবং হামাস ও ফাতাহর মধ্যে পুনর্মিলন সহজতর করার প্রয়োজন রয়েছে।
২০২০ সালে স্বাক্ষরিত "আব্রাহাম অ্যাকর্ডস" ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, যা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এই চুক্তিগুলো ইরানকে একটি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখার একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে উন্নত প্রযুক্তি ও নতুন বাণিজ্য সুযোগের সুবিধা প্রদান করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিগুলোকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে বাইপাস করতে ব্যবহার করে। তবে, গাজা যুদ্ধের পর স্বাভাবিকীকরণের রাজনৈতিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ আরব জনগণের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রবল। সৌদি আরব, যদিও অক্টোবর ২০২৩-এর আগে স্বাভাবিকীকরণের ইঙ্গিত দিয়েছিল, হামাসের হামলার পর প্রক্রিয়াটি স্থগিত করে এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের একটি বিশ্বাসযোগ্য পথের দাবি জানায়।
তুরস্ক, দীর্ঘদিনের ইসরায়েলের মিত্র হওয়া সত্ত্বেও, রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের অধীনে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের পদক্ষেপের ক্রমবর্ধমান সমালোচক হয়ে উঠেছে। এরদোয়ান ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামলার নিন্দা করেননি এবং হামাসকে "স্বাধীনতা সংগ্রামী" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তুরস্ক আরব বিশ্বে একটি প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চায়। (অন্যদিকে সে আবার ন্যাটোতে ঢুকে যেমন বসে আছে
তেমন হতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য।) তারা হামাসের কমান্ডারদের আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের কার্যকলাপ (যেমন অর্থ পাচার এবং ইরান থেকে পণ্য আমদানি) উপেক্ষা করেছে। তুরস্ক গাজায় মানবিক সহায়তার শীর্ষ প্রদানকারীদের মধ্যে অন্যতম।
মিশর ও কাতার ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। মিশরই প্রথম আরব দেশ, যা ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। কাতার হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয়ের আয়োজক এবং গোষ্ঠীটিকে আর্থিক সংস্থান সরবরাহ করে, যা ইসরায়েলি সরকারের জ্ঞান ও সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। কাতার ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাতা এবং হামাস ও ফাতাহর মধ্যে মধ্যস্থতা করেছে।
ইরান ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অভিনেতা, যা হামাস, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে), লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হাউথিদের মতো বিভিন্ন ফিলিস্তিনি ও আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তহবিল, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সমর্থন করে। ইরান এই গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তার "প্রতিরোধ অক্ষের" অংশ হিসেবে দেখে। ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামাসের হামলার পর ইরান প্রকাশ্যে হামাসের প্রশংসা করে এবং তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে।
৮. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক
গতিশীলতা: বিতর্কিত
ভূমিকা
৮.১. ইসরায়েলি
বামপন্থী রাজনীতিবিদদের বিতর্কিত ভূমিকা
ইসরায়েলি রাজনীতিতে "বাম" বা "জায়নবাদী বাম" শব্দটি মূলত আরব-ইসরায়েল সংঘাত, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের প্রতি মনোভাবের সাথে সম্পর্কিত। বামপন্থী অবস্থান ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে আপস করার এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার ইচ্ছাকে বোঝায়।
তবে, ইসরায়েলি বামপন্থী রাজনীতিবিদদের ভূমিকা বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। কিছু সমালোচক যুক্তি দেন যে, কেন্দ্র-ডান এবং বামপন্থী জায়নবাদী দলগুলো ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতির নীতিকে সমর্থন করেছে এবং ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামলার পর ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আরও প্রতিকূল মনোভাব গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাব, যা গাজার বাসিন্দাদের জোরপূর্বক বিতাড়নের কথা বলেছিল, ইসরায়েলি বামপন্থী রাজনীতিবিদরা নৈতিক কারণে নয়, বরং এর বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই দলগুলো অতীতে অনেক বাস্তুচ্যুতি প্রকল্পের সূচনা করেছে। সমালোচকরা ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রতি "কেন্দ্রবাদী" দলগুলোর প্রতিক্রিয়াকে
"রাজনৈতিক ও নৈতিক ব্যর্থতা" হিসেবে দেখেছেন।
ইৎজাক রবিন, যিনি অসলো চুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিলেন, তার নীতিগুলোও বিতর্কিত ছিল। অসলো চুক্তিতে পশ্চিম তীর ও গাজার কিছু অংশ ফিলিস্তিনিদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ছিল। তবে, এই "ভূমি হস্তান্তরের" ধারণাটি অনেক ধর্মপ্রাণ ইহুদির কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর ছিল, যারা পশ্চিম তীরকে ইহুদিদের জন্মগত অধিকার বলে মনে করত। রবিনের সরকার এবং শান্তি আলোচনার সময়ও ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত ছিল, এবং দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে একটি বিভাজন প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
এহুদ বারাক, ২০০০ সালের ক্যাম্প ডেভিড শীর্ষ সম্মেলনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, পশ্চিম তীরের ৯১% এবং জেরুজালেমের কিছু অংশে ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন, সাথে ভূমি বিনিময়ের প্রস্তাবও ছিল। তবে, এই প্রস্তাবটি জেরুজালেমের টেম্পল মাউন্টের উপর ইসরায়েলি সার্বভৌমত্বের দাবি, প্রতিকূল ভূমি বিনিময় অনুপাত এবং ফিলিস্তিনি আকাশসীমা, সীমান্ত ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবের কারণে সমালোচিত হয়েছিল, যা ফিলিস্তিনিরা দখলদারিত্বকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছিল। এই আলোচনার ব্যর্থতা ইসরায়েলি রাজনীতিকে ডানপন্থার দিকে ঠেলে দেয় এবং দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সূত্রপাত ঘটায় বলে মনে করা হয়।
এহুদ ওলমার্ট, যিনি ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, গাজা থেকে ইসরায়েলের একতরফা বিচ্ছিন্নকরণের একজন সোচ্চার সমর্থক ছিলেন, যদিও তিনি প্রাথমিকভাবে ভূমি প্রত্যাহারের বিরোধিতা করেছিলেন। তার মেয়াদে ২০০৬ সালের লেবানন যুদ্ধ এবং ২০০৮-২০০৯ সালের গাজা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তিনি ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচক হিসেবে বলেছিলেন যে ইসরায়েল "যুদ্ধাপরাধের খুব কাছাকাছি" কাজ করছে।
"প্রগ্রেসিভ এক্সেপ্ট প্যালেস্টাইন" (PEP) শব্দটি এমন ব্যক্তি বা সংগঠনকে বোঝায়, যারা নিজেদেরকে প্রগতিশীল বা বামপন্থী হিসেবে বর্ণনা করলেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন না বা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ফিলিস্তিনপন্থী সমর্থকরা এটিকে রাজনৈতিক ভণ্ডামি হিসেবে দেখেন, অন্যদিকে এর সমালোচকরা এটিকে ইসরায়েল-বিরোধী এবং ইসরায়েলপন্থী বামপন্থীদের বিরুদ্ধে একটি অপবাদ হিসেবে দেখেন। এই প্রবণতা কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান।
৯. বিকল্প আখ্যান:
ধর্মীয় বনাম
জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
৯.১. যদি ফিলিস্তিনিরা ধর্মীয়ভাবে না নিয়ে
জাতিগতভাবে নিতো
তাহলে কী হতো?
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের মূল নিহিত রয়েছে ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী দাবি-দাওয়ার মধ্যে। এই সংঘাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী পরিচয়ের মিশ্রণ। হামাসের মতো সংগঠনগুলো ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদকে ইসলামিক মৌলবাদের সাথে একত্রিত করেছে। তাদের ১৯৮৮ সালের সনদে ইসরায়েলকে ধ্বংস করা এবং ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের (বর্তমান ইসরায়েল, পশ্চিম তীর ও গাজা) সমগ্র অঞ্চলে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছিল, যেখানে ইহুদি-বিরোধী বক্তব্যও অন্তর্ভুক্ত ছিল। হামাস ফিলিস্তিনকে পুনরুদ্ধার করার জন্য "পবিত্র যুদ্ধ" (জিহাদ) কে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জন্য একটি ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করে। একইভাবে, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) ইসরায়েলকে ধ্বংস করে একটি ইসলামপন্থী ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে এবং বিশ্বাস করে যে তাদের লক্ষ্য কেবল সামরিক উপায়ে অর্জন করা যেতে পারে।
যদি ফিলিস্তিনিরা এই দ্বন্দ্বকে সম্পূর্ণরূপে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতো, ধর্মীয় উপাদানগুলোকে বাদ দিয়ে, তাহলে সংঘাতের গতিপথ ভিন্ন হতে পারতো।
·
আলোচনার প্রকৃতিতে পরিবর্তন: যদি ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম কেবল জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ
এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার উপর কেন্দ্রীভূত হতো, তাহলে আলোচনার টেবিলে ধর্মীয়ভাবে বাধ্যতামূলক "সর্বোচ্চবাদী"
দাবিগুলো (যেমন ইসরায়েলকে ধ্বংস করা বা সমগ্র ফিলিস্তিনকে
ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা) অনুপস্থিত থাকতে পারতো। এর ফলে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী-চালিত আলোচনা ভূমি, সীমান্ত, শরণার্থী সমস্যা এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের মতো বাস্তবসম্মত বিষয়গুলোর উপর বেশি মনোযোগ দিতে পারতো। এটি ইসরায়েলের জন্য একটি ধর্মনিরপেক্ষ
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের
সাথে আলোচনা করা সহজ করে তুলতে পারতো, যা ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়।
·
ফিলিস্তিনি ঐক্যের সম্ভাবনা: হামাস এবং ফাতাহর মধ্যে বিদ্যমান বিভেদ আংশিকভাবে তাদের ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের কারণে, যেখানে হামাস একটি ইসলামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং ফাতাহ তুলনামূলকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী। যদি ধর্মীয় উপাদানগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ হতো, তাহলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভাবনা বাড়তো, যা ইসরায়েলের সাথে আলোচনার জন্য একটি শক্তিশালী এবং সুসংহত পক্ষ তৈরি করতে পারতো।
·
আন্তর্জাতিক সমর্থন: একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরও ব্যাপক সমর্থন পেতে পারতো, যারা প্রায়শই ধর্মীয় চরমপন্থাকে সমর্থন করতে দ্বিধা বোধ করে। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও বেশি কূটনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক
আইন প্রয়োগের সুযোগ তৈরি করতে পারতো।
·
সহিংসতার প্রকৃতি: যদি সংঘাতের মূল চালিকাশক্তি ধর্মীয় না হয়ে জাতীয়তাবাদী হতো, তাহলে সহিংসতার প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসতে পারতো। যদিও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোও সহিংস হতে পারে, তবে ধর্মীয় জিহাদের ধারণা প্রায়শই চরমপন্থা এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার ন্যায্যতা প্রমাণ করে। একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্ভবত সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বেশি মনোযোগ দিতো এবং বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলার ক্ষেত্রে ভিন্ন নৈতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে পারতো।
·
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় থেকেই বিকশিত হয়েছে, যা ব্রিটিশ শাসন এবং জায়নবাদী বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের (১৯৩৬-৩৯) মাধ্যমে তীব্র আকার ধারণ করে। এই বিদ্রোহ ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদের একটি গঠনমূলক ঘটনা ছিল। পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ ফিলিস্তিন (পিএফএলপি) এর মতো ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠনগুলোও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না এবং "ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের" সম্পূর্ণ "মুক্তি"র পক্ষে, প্রায়শই সন্ত্রাসের মাধ্যমে। এর অর্থ হলো, এমনকি যদি ফিলিস্তিনিরা ধর্মীয়ভাবে না নিয়ে জাতিগতভাবে সংঘাতকে দেখতো, তবুও ইসরায়েলের অস্তিত্বের প্রতি মৌলিক বিরোধিতা এবং সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যেতো।
তবে, এই ধরনের একটি পরিবর্তন সংঘাতের মূল কারণগুলোকে সম্পূর্ণরূপে দূর করতে পারতো না। ফিলিস্তিনিদের
"নাকবা" (১৯৪৮ সালের বাস্তুচ্যুতি) এবং ইসরায়েলি দখলদারিত্বের ফলে সৃষ্ট ভূমি হারানো, বাস্তুচ্যুতি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বঞ্চনা জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর ক্ষোভের জন্ম দিতো। "প্রত্যাবর্তনের অধিকার" (Right of Return) এর মতো বিষয়গুলো, যা ফিলিস্তিনি পরিচয়ের একটি মৌলিক অংশ, ধর্মীয় বা জাতীয়তাবাদী উভয় আখ্যানের অধীনেই একটি প্রধান আলোচনার বিষয় থেকে যেতো।
সংক্ষেপে, যদি ফিলিস্তিনিরা সংঘাতকে সম্পূর্ণরূপে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতো, তাহলে এটি শান্তি আলোচনার জন্য একটি ভিন্ন এবং সম্ভবত আরও গঠনমূলক পরিবেশ তৈরি করতে পারতো, যা ধর্মীয় চরমপন্থার প্রভাব হ্রাস করতো। তবে, এটি সংঘাতের গভীর ঐতিহাসিক এবং ভূখণ্ডগত মূল কারণগুলোকে সম্পূর্ণরূপে
সমাধান করতে পারতো না, এবং একটি স্থায়ী সমাধান এখনও উভয় পক্ষের মধ্যে মৌলিক দাবি-দাওয়ার উপর নির্ভর করতো।
১০. সংঘাতের অর্থনীতি:
কারা চিরস্থায়ী অস্থিতিশীলতা থেকে
লাভবান হয়?
বৈশ্বিক অস্ত্র শিল্প
এবং সামরিক-প্রযুক্তি খাত
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাত বৈশ্বিক অস্ত্র শিল্প এবং সামরিক-প্রযুক্তি খাতের জন্য একটি লাভজনক ক্ষেত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের বৃহত্তম সামরিক সহায়তাকারী, যা বছরে ৩.৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা প্রদান করে। ৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামলার পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে ১০,০০০ টনের বেশি অস্ত্র এবং ৫০,০০০ আর্টিলারি শেলসহ ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। এই অস্ত্রগুলো মার্কিন করদাতাদের অর্থায়নে ফরেন মিলিটারি সেলস প্রোগ্রামের মাধ্যমে কেনা হয়, যা লকহিড মার্টিন, আরটিএক্স, বোয়িং এবং জেনারেল ডাইনামিক্সের মতো বড় অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের জন্য কর্পোরেট কল্যাণ হিসেবে কাজ করে। এই কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে, আর মানবতা ও মানব সভ্যতা ক্রমাগত তলিয়েছে মাটির অতলে।
ইসরায়েলের নিজস্ব সামরিক-প্রযুক্তি শিল্পও এই সংঘাত থেকে লাভবান হয়। ইসরায়েলকে "ফিলিস্তিন ল্যাবরেটরি" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের উপর অস্ত্র ও নজরদারি ব্যবস্থা পরীক্ষা করা হয় এবং পরে বিশ্বজুড়ে বিক্রি করা হয়। এই সংঘাত ইসরায়েলের সামরিক-প্রযুক্তি শিল্পকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা এটিকে বৈশ্বিক অস্ত্র উদ্ভাবক হিসেবে তার ভূমিকা আরও গভীর করতে সাহায্য করেছে।
গাজা ও পশ্চিম
তীরের পুনর্গঠন
শিল্প
গাজা উপত্যকার পুনর্গঠনের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রয়োজন হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। এই বিশাল পুনর্গঠন প্রচেষ্টা নির্মাণ শিল্পের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে। তবে, এই শিল্পও ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের অধীনে চলে আসে। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষই একমাত্র নির্ধারণ করে যে কোন নির্মাণ সামগ্রী গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করতে পারবে, যার ফলে ইসরায়েলি কোম্পানিগুলো, যেমন নেসার সিমেন্ট, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ব্যাপক লাভবান হয়। নেসার ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি সিমেন্ট বাজারের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং গাজার পুনর্গঠন থেকে বিশাল মুনাফা অর্জন করেছে। এটি ফিলিস্তিনি অর্থনীতিকে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের আরও গভীরে ঠেলে দেয়।
চরমপন্থী গোষ্ঠী: বিশৃঙ্খলাকে নিয়োগ ও প্রভাব বিস্তারের জন্য
ব্যবহার
ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি অনন্য পরিবেশ তৈরি করেছে, যা তাদের মতাদর্শিক এজেন্ডা এবং নিয়োগের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস) এর মতো জিহাদি গোষ্ঠীগুলো ৭ই অক্টোবরের হামলার প্রশংসা করেছে এবং তাদের অনুসারীদের হামাসের উদাহরণ অনুসরণ করে হামলা চালানোর আহ্বান জানিয়েছে। তারা গাজায় মানবিক সংকটের বাস্তব উদ্বেগগুলোকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিদের উগ্রপন্থী করে তুলছে এবং তাদের নিজস্ব প্রচার ও আখ্যান ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই সংঘাতের ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইহুদি-বিদ্বেষ এবং ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সমাজের মেরুকরণকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
রাজনৈতিক লাভ: অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রভাব
সংঘাত ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষের নেতাদের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসে। ইসরায়েলে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, সংঘাতকে তার ক্ষমতা বজায় রাখতে এবং নির্বাচন বিলম্বিত করতে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সামরিক সাফল্যের পর তার জনসমর্থন সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই ‘ধরনের’ অভিযোগ ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর
বিরুদ্ধেও রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) দুর্বলতা এবং একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের ব্যর্থতা হামাসকে সশস্ত্র প্রতিরোধের বার্তা দিয়ে সমর্থন বাড়াতে সাহায্য করেছে। সংঘাতের ফলে পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে বিভাজন বজায় থাকে, যা ইসরায়েলের কিছু অংশের জন্য সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হয়।
ইসরায়েলি বসতি স্থাপন
আন্দোলন: আদর্শগত
ও অর্থনৈতিক
চালিকাশক্তি
ইসরায়েলি বসতি স্থাপন আন্দোলন সংঘাত থেকে সরাসরি লাভবান হয়। এই আন্দোলনটি ধর্মীয় আদর্শ এবং ইহুদিদের জন্য "ইসরায়েল ভূমি" এর সমগ্র অংশ বসতি স্থাপনের ধর্মীয় আবশ্যকতা দ্বারা চালিত। বসতি স্থাপনগুলো ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করতে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং পশ্চিম তীর জুড়ে ইসরায়েলের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। বসতি স্থাপনকারীরা প্রায়শই ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সমর্থনে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ভাঙচুর করে, আউটপোস্ট স্থাপন করে, কৃষকদের উপর হামলা চালায় এবং ফসল ধ্বংস করে। এই বসতি স্থাপনগুলো আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও, তাদের সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে, যা সংঘাতের একটি স্থায়ী চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
মানবিক সহায়তা খাত: চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনা
মানবিক সহায়তা খাত, যদিও সংঘাতের শিকারদের সাহায্য করার জন্য অপরিহার্য, তবে এটিও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলো প্রায়শই তহবিলের অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং জবাবদিহিতার অভাবের অভিযোগের সম্মুখীন হয়। কিছু সমালোচক যুক্তি দেন যে দীর্ঘস্থায়ী সাহায্য কর্মসূচিগুলো নির্ভরতা এবং দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে, যা দেশগুলোর নিজস্ব উন্নয়নের ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের বিধিনিষেধ এবং নতুন বেসরকারি সহায়তা সংস্থাগুলোর অস্বচ্ছ কাঠামো নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। ইসরায়েল একটি নতুন সহায়তা ব্যবস্থা চালু করেছে, যা হামাসকে সহায়তা আত্মসাৎ করা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে, কিন্তু জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলো এটিকে অপর্যাপ্ত এবং মানবিক নীতির লঙ্ঘন বলে মনে করে।
১১. মানবিক মূল্য:
হতাহত, বাস্তুচ্যুতি এবং মানবিক
বিপর্যয়
ইসরায়েলি হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতি: হামলা
ও যুদ্ধের
প্রভাব
ইসরায়েলি-ফিলিস্তিন সংঘাতে ইসরায়েলিদেরও ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে প্রায় ৬,৩৭৩ জন ইসরায়েলি নিহত হয়। প্রথম ইন্তিফাদায় ১৭৯-২০০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়। দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় ১,০১০ জন ইসরায়েলি নিহত হয়। ২০০৮-২০০৯, ২০১২, ২০১৪ এবং ২০২১ সালের গাজা যুদ্ধগুলোতে প্রায় ৩০০ ইসরায়েলি নিহত হয়।
৭ই অক্টোবর ২০২৩ সালের হামাসের হামলায় প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক, এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এই হামলা ইসরায়েলের ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল এবং ইসরায়েলি জনগণের মধ্যে গভীর মানসিক আঘাত সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে, যা বর্তমানেও চলমান।
ফিলিস্তিনি হতাহত
এবং ক্ষয়ক্ষতি: ক্ষয় ও ধ্বংসের মাত্রা
ফিলিস্তিনিদের উপর সংঘাতের প্রভাব ভয়াবহ। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ৭,০০,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়, যা "নাকবা" নামে পরিচিত। প্রথম ইন্তিফাদায় ১,৯৬২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় ৩,১৭৯-৩,৩৫৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৬,৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়।
অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনি হতাহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, জুন ২০২৫ পর্যন্ত ৫৫,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। পশ্চিম তীরেও ৯৫২ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ল্যানসেট-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, জুন ২০২৪ সালের মধ্যে আঘাতজনিত কারণে ৬৪,২৬০ জন নিহত হয়েছে। এই সংখ্যায় "পরোক্ষ" মৃত্যুর সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত নয়, যা সম্ভবত আরও বেশি।
সারণী: ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি হতাহত (১৯৪৮-বর্তমান) সংঘাত/সময়কাল অনুযায়ী
সংঘাত/সময়কাল |
ইসরায়েলি নিহত (আনুমানিক) |
ফিলিস্তিনি নিহত (আনুমানিক) |
অন্যান্য তথ্য |
১৯৪৮ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ |
৬,৩৭৩ |
১৩,০০০-১৬,০০০ |
৭,০০,০০০+ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত |
প্রথম ইন্তিফাদা (১৯৮৭-১৯৯৩) |
১৭৯-২০০ |
১,৯৬২ |
- |
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (২০০০-২০০৫) |
১,০১০ |
৩,১৭৯-৩,৩৫৪ |
- |
২০০৮-২০২১ গাজা যুদ্ধগুলো |
৩০০ |
৬,৪০০ |
- |
৭ই অক্টোবর ২০২৩ হামলা |
১,২০০ 8 |
- |
২৫১ জিম্মি |
অক্টোবর ২০২৩-বর্তমান গাজা যুদ্ধ |
১,৭০০ (৭ই অক্টোবরের হামলা সহ) |
৫৫,০০০+ (গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়) |
গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক সংকট |
চলমান মানবিক সংকট:
খাদ্য, পানি,
স্বাস্থ্য এবং বাস্তুচ্যুতি
গাজা উপত্যকায় মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রায় ১.৯ মিলিয়ন মানুষ (প্রায় বিশ লাখ) অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ৯০%। তাদের বেশিরভাগই জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্র, অস্থায়ী আশ্রয়স্থল বা ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে বসবাস করছে। গাজার ৮২.৪% এলাকা এখন ইসরায়েলি সামরিক অঞ্চল বা বাস্তুচ্যুতির আদেশের অধীনে রয়েছে।
·
খাদ্য সংকট: গাজার অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে এবং সমগ্র জনসংখ্যা তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টিতে ভুগছে। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে ৮৩% খাদ্য সহায়তা প্রবেশে বাধা পাচ্ছে।
·
পানি ও স্যানিটেশন: পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে, যার ফলে মানুষ প্রতিদিন ৫ লিটারের কম পানি পাচ্ছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যূনতম মানদণ্ডের এক-তৃতীয়াংশ। পানীয় জলের অভাব এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ধ্বংস জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
·
স্বাস্থ্যসেবা: গাজার প্রায় ৮৪% স্বাস্থ্য সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে, যার ফলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার পতন ঘটেছে। গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল এবং গর্ভপাতের হার ৩০০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
·
শিক্ষা: গাজার ৮৭% এর বেশি স্কুল এবং সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে, যার ফলে ৬,৫৮,০০০ এর বেশি শিশু ২০ মাস ধরে স্কুলে যেতে পারেনি।
সারণী: গাজায় অবকাঠামোগত ক্ষতি এবং বাস্তুচ্যুতি (অক্টোবর ২০২৩-পরবর্তী)
ক্ষেত্র |
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ |
মানবিক প্রভাব |
আবাসন |
৭২% ক্ষতিগ্রস্ত, ২৯২,০০০+ বাড়ি ধ্বংস/ক্ষতিগ্রস্ত
|
১ মিলিয়নের বেশি মানুষ গৃহহীন |
জনসেবা
অবকাঠামো |
১৯% ক্ষতিগ্রস্ত (পানি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা) |
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পতন, পানির তীব্র সংকট, শিক্ষাব্যবস্থা
অকার্যকর |
বাণিজ্যিক/শিল্প ভবন |
৯% ক্ষতিগ্রস্ত |
অর্থনীতি ৮৩% সংকুচিত |
কৃষি |
৮০% আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত,
৮৩% কৃষি কূপ অকার্যকর |
খাদ্য সরবরাহ সংকট, অপুষ্টি বৃদ্ধি |
সড়ক |
৯২% প্রাথমিক সড়ক ধ্বংস/ক্ষতিগ্রস্ত |
মানবিক সহায়তা বিতরণে বাধা |
যোগাযোগ |
অবকাঠামো গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত |
ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা ব্যাহত |
বাস্তুচ্যুতি |
প্রায় ১.৯ মিলিয়ন মানুষ (৯০% জনসংখ্যা) অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত |
জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্র, মানবিক চাহিদা মেটাতে অক্ষমতা |
ধ্বংসাবশেষ |
২৬ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ |
অপসারণে বহু বছর লাগবে, পরিবেশগত দূষণ |
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় ইসরায়েলের যুদ্ধ পদ্ধতিকে গণহত্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করে, কারণ তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (খাদ্য, পানি, জ্বালানি) থেকে বঞ্চিত করছে। এটি যুদ্ধের একটি অস্ত্র হিসেবে বেসামরিক নাগরিকদের অনাহারকে ব্যবহার করার যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য।
১২. সংঘাতের ভবিষ্যৎ:
সম্ভাব্য পথ ও চ্যালেঞ্জ
ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অনিশ্চিত এবং এটি বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য পথ ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সংঘাতের দীর্ঘস্থায়ীত্ব এবং এর বহুমাত্রিক প্রকৃতি একটি সহজ সমাধানের পথে বড় বাধা।
·
দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে সংঘাতের একমাত্র কার্যকর পথ হিসেবে দেখে। এই সমাধানের লক্ষ্য হলো ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যা ১৯৬৭ সালের সীমান্তকে ভিত্তি করে গঠিত হবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ২৪২ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে "ভূমির বিনিময়ে শান্তি" ধারণার জন্ম দিয়েছিল। তবে, ইসরায়েলি বসতি স্থাপন সম্প্রসারণ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে খণ্ডিত করেছে এবং একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, বসতি স্থাপনের কারণে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান এখন আর বাস্তবসম্মত নয়।
·
এক-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা: ইসরায়েলি বসতি স্থাপন নীতিগুলো পশ্চিম তীরে "অসম অধিকারের এক-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা" কে সুদৃঢ় করছে বলে সমালোচিত হয়। এই পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি শাসনের অধীনে একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে থেকে যেতে পারে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অবিচারের জন্ম দেবে।
·
দখলদারিত্বের ধারাবাহিকতা: আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ২০২৪ সালে রায় দিয়েছে যে, দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরায়েলের উপস্থিতি অবৈধ এবং ইসরায়েলকে দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে, বসতি স্থাপন বন্ধ করতে এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে, ইসরায়েল এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে। দখলদারিত্বের ধারাবাহিকতা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হতাশা ও প্রতিরোধের জন্ম দেবে, যা সহিংসতার চক্রকে বজায় রাখবে।
·
চরমপন্থার বিস্তার: গাজা যুদ্ধ আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট (আইএসআইএস)-এর মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে, যা তাদের মতাদর্শিক এজেন্ডা এবং নিয়োগের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। গাজায় মানবিক সংকটের বাস্তব উদ্বেগগুলোকে কাজে লাগিয়ে তারা ব্যক্তিদের উগ্রপন্থী করে তুলছে এবং তাদের নিজস্ব প্রচার ও আখ্যান ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই সংঘাতের ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে ইহুদি-বিদ্বেষ এবং ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সমাজের মেরুকরণকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
·
মানবিক সংকট: গাজা উপত্যকায় চলমান ভয়াবহ মানবিক সংকট (ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পতন এবং অবকাঠামোর ধ্বংস) অদূর ভবিষ্যতে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে। এই সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং ইসরায়েলের পক্ষ থেকে অবরোধ শিথিল করা অপরিহার্য।
·
আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি: ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের আঞ্চলিক প্রভাব ব্যাপক। ইরান এবং তার প্রক্সি গোষ্ঠীগুলো (যেমন হিজবুল্লাহ, হাউথি) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের "প্রতিরোধ অক্ষ" হিসেবে কাজ করে। এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপান্তরিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে, যা বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার এবং ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।
·
আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা: আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগ এনেছে এবং অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা একটি স্থায়ী শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
·
রাজনৈতিক অচলাবস্থা: সংঘাত সমাধানের জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বারবার ব্যর্থ হয়েছে, যা উভয় পক্ষের মধ্যে একটি গভীর অবিশ্বাস তৈরি করেছে। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয় পক্ষের নেতাদের মধ্যে সংঘাতকে রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহার করার প্রবণতাও দেখা যায়।
একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী সমাধানের জন্য সকল পক্ষকে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। ইসরায়েলকে অবশ্যই দখলকৃত অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং বসতি স্থাপন বন্ধ করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের
অধিকার এবং একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। হামাসের মতো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অবশ্যই তাদের সহিংসতা ত্যাগ করতে হবে এবং ফিলিস্তিনিদের
মধ্যে ঐক্য ও একটি কার্যকর, গণতান্ত্রিক শাসনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। বিশ্বনেতাদের উচিত তাদের স্বার্থান্বেষী নীতি ত্যাগ করে সংঘাতের মূল কারণগুলোর সমাধানে প্রকৃত অর্থে মধ্যস্থতা করা এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে দ্বিমুখী নীতি পরিহার করা। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের বিচার করা একটি স্থায়ী শান্তির জন্য অপরিহার্য। এই সংঘাতের অবসান ঘটাতে কেবল সামরিক শক্তি বা রাজনৈতিক কৌশল যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানবিকতা, ন্যায়বিচার এবং দীর্ঘমেয়াদী সহাবস্থানের প্রতি গভীর অঙ্গীকার।
তথ্যসূত্র
·
8 education.cfr.org. (n.d.).
Israeli-Palestinian Conflict Timeline.
·
9 britannica.com. (n.d.).
Arab-Israeli wars.
·
2 ajc.org. (n.d.).
key events Israel Palestine 1948 to present academic.
·
121 en.wikipedia.org. (n.d.).
History of Israel (1948–present).
·
3 un.org. (n.d.).
UN resolutions Israel Palestine conflict history.
·
1 cfr.org. (n.d.).
Israeli-Palestinian Conflict.
·
7 imeu.org. (n.d.).
explainer-the-oslo-accords.
·
18 history.state.gov. (n.d.).
oslo.
·
6 ebsco.com. (n.d.).
camp-david-accords.
·
17 history.state.gov. (n.d.).
camp-david.
·
30 apnews.com. (2025, June 17).
At least 51 Palestinians killed while waiting for aid trucks in
Gaza, health officials say.
·
5 un.org. (n.d.).
about-the-nakba.
·
10 en.wikipedia.org. (n.d.).
Nakba.
·
4 en.wikipedia.org. (n.d.).
Occupied Palestinian territories.
·
11 en.wikipedia.org. (n.d.).
Israeli-occupied territories.
·
12 congress.gov. (n.d.).
IF12549.
·
13 britannica.com. (n.d.).
Hamas.
·
35 dni.gov. (n.d.).
pij.html.
·
100 aipac.org. (n.d.).
palestinian-islamic-jihad-iranian-sponsored-terrorism-97jpf-nc3cd-sf557.
·
37 ngo-monitor.org. (n.d.).
what-is-the-pflp.
·
38 en.wikipedia.org. (n.d.).
Popular Front for the Liberation of Palestine.
·
31 ajc.org. (n.d.).
IsraelHamasWar.
·
32 britannica.com. (n.d.).
Israel-Hamas-War.
·
22 dni.gov. (n.d.).
hamas.html.
·
23 cfr.org. (n.d.).
what-hamas.
·
122 apnews.com. (2025, June 17).
Israel recovers the remains of 3 more hostages from Gaza.
·
14 en.wikipedia.org. (n.d.).
Palestinian political violence.
·
27 en.wikipedia.org. (n.d.).
Fatah–Hamas conflict.
·
16 en.wikipedia.org. (n.d.).
Fatah–Hamas conflict.
·
33 en.wikipedia.org. (n.d.).
Gaza war.
·
31 ajc.org. (n.d.).
IsraelHamasWar.
·
32 britannica.com. (n.d.).
Israel-Hamas-War.
·
91 en.wikipedia.org. (n.d.).
Palestinian casualties of war.
·
102 britannica.com. (n.d.).
Popular-Front-for-the-Liberation-of-Palestine.
·
14 en.wikipedia.org. (n.d.).
Palestinian political violence.
·
28 en.wikipedia.org. (n.d.).
Al-Qassam_Brigades.
·
29 aph.gov.au. (n.d.).
hamas.pdf.
·
36 en.wikipedia.org. (n.d.).
Palestinian Islamic Jihad.
·
123 publicsafety.gc.ca. (n.d.).
crrnt-lstd-ntts-en.aspx.
·
38 en.wikipedia.org. (n.d.).
Popular Front for the Liberation of Palestine.
·
124 ecfr.eu.
No comments