Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    মুক্তির গল্প ।। মেহজাবিন হুসাইন তাসনিয়া

    আমি একজন ধর্মত্যাগী বাংলাদেশি নাগরিক, বর্তমানে ভারতের চেন্নাইতে বসবাস করছি। আমি একজন প্রাক্তন মুসলিম, এবং আমার জীবনের গল্প হয়তো অনেকের মতোই সাধারণ, তবে আমার কাছে এটি একটি গভীর ও ব্যক্তিগত যাত্রা। এই গল্পে রয়েছে শৈশবের স্মৃতি, ধর্মীয় সন্দেহ, সামাজিক নিপীড়ন, এবং নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার এক অদম্য প্রচেষ্টা।



    শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি

    আমি বাংলাদেশের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আমাদের পরিবার ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের আগে থেকেই তৎকালীন অখণ্ড ভারতে বসবাস করত। আমাদের দুটি বাড়ি ছিল—একটি সিলেটে, অন্যটি রাজশাহীতে। আমার বাবা ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, এবং মা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যবস্থাপক। আমাদের পরিবার ঐতিহ্যগতভাবে মুসলিম। আমরা অন্যান্য বাংলাদেশি মুসলিম পরিবারের মতো ধর্মান্তরিত ছিলাম না। 

    কিন্তু আমার শৈশব মোটেও সুখকর ছিল না। অল্প বয়সে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমি আমার বাবা-মাকে হারাই। এরপর আমি আমার দাদু-দিদার কাছে সিলেটে মানুষ হই। তাঁরা আমাকে স্নেহে এবং যত্নে বড় করে তোলেন, কিন্তু বাবা-মার শূন্যতা আমার জীবনে একটি গভীর প্রভাব ফেলে।

    ইসলামের প্রতি আগ্রহ ও প্রশ্নের শুরু

    ছোটবেলা থেকেই আমার ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। আমি বোরখা পরতাম, নিয়মিত নামাজ পড়তাম, এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য আমার মনে একটি প্রবল কৌতূহল ছিল। একজন মুসলিম মেয়ে হিসেবে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করতাম। আমার এই আগ্রহ আমাকে কোরআন, হাদিস, এবং তাফসির পড়ার দিকে ঠেলে দেয়। তবে আমার পড়াশোনা শুধু মুখস্ত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; আমি বুঝে পড়তে চাইতাম।

    এই সময় আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন একজন আন্টি, যিনি আমার বাবা-মার মৃত্যুর পর আমাকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না, তাই আমি তাঁর কাছে প্রায়ই সময় কাটাতাম। তিনি ছিলেন আরবি ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী, এবং তাঁর কাছেই আমি আরবি শিখি। আরবি শেখার পর আমি কোরআন, হাদিস, এবং অন্যান্য ইসলামিক গ্রন্থের মূল আরবি সংস্করণ পড়তে শুরু করি। এই সময় আমি লক্ষ্য করি যে, বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদের সঙ্গে মূল আরবি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য আমার মনে ইসলাম সম্পর্কে প্রশ্ন জাগাতে শুরু করে।

    ইসলাম নিয়ে সন্দেহ ও হতাশা

    প্রাথমিকভাবে আমি আমার প্রশ্নগুলোকে একজন গোঁড়া মুসলিমের দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝার চেষ্টা করতাম। উদাহরণস্বরূপ, নবী মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবীদের যুদ্ধে হত্যার ঘটনাগুলোকে আমি ন্যায্য মনে করতাম। আমি ভাবতাম, শত্রুদের আক্রমণের মুখে তাঁরা যা করেছেন, তা আমি নিজেও তাঁদের জায়গায় করতাম। কিন্তু যখন আমি আরবি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ইসলামিক গ্রন্থগুলোর মূল সংস্করণ পড়তে শুরু করি, তখন আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। আমি লক্ষ্য করি যে, নবী মুহাম্মদ শুধু আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি, বরং অনেক নির্দোষ মানুষের প্রাণও নিয়েছেন। তাঁর জীবনে হিংসা, ক্ষোভ, এবং লোভের উপস্থিতি আমাকে বিস্মিত করেছিল। 

    আমি আরও গভীরভাবে নবী মুহাম্মদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে শুরু করি। এই সময় আমি বুঝতে পারি যে, তিনি ‘আল্লাহ’র নামে একটি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন এবং নিজের ইচ্ছামতো কাজ করেছেন। এই সব তথ্য আমার বিশ্বাসকে ধাক্কা দেয়। আমি বিভিন্ন মুসলিম প্রতিবেশী ও পণ্ডিতদের কাছে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর চাইতাম। কিছু প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেলেও বেশিরভাগ সময় আমার প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়া হতো। 

    এক বন্ধুর মাধ্যমে আমি জাকির নায়েক ও আহমেদ দিদাতের বক্তৃতার কথা জানতে পারি। তাঁদের বক্তব্য শুনলাম, কিন্তু তাতে ইসলামের মূল গ্রন্থগুলোর সঙ্গে কোনো মিল পেলাম না। তাঁরা ইসলামকে আধুনিক যুগের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য এর বিভিন্ন অংশ পরিবর্তন করে উপস্থাপন করছিলেন। এই সব অভিজ্ঞতা আমাকে ইসলাম সম্পর্কে আরও হতাশ করে।

    জীবনের কঠিন মোড়

    ক্লাস ১১-এর সময় আমার জীবনে একটি বড় ধাক্কা আসে। মাত্র সাত মাসের ব্যবধানে আমার দাদু হৃদরোগে এবং দিদা ক্যানসারে মারা যান। এর ফলে আমি সম্পূর্ণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ি। এই সময় আমার জীবনে নতুন সংকট শুরু হয়। আমাদের এলাকার কিছু ছেলে, যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল, আমার এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে আমাকে হয়রানি করতে শুরু করে। রাস্তায় কটূক্তি, ঠাট্টা, এবং কু-প্রস্তাব আমার জীবনকে অসহনীয় করে তোলে। 

    আমি এই হয়রানির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। প্রমাণসহ অভিযোগ দাখিল করি, এমনকি বাংলাদেশ পুলিশের ডিআইজি ও আইজিপি’র কাছে ই-মেইল পাঠাই। কিন্তু কোনো সাহায্য পাইনি। উলটো, যখন তারা জানতে পারে আমি তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি, তখন তারা আমাকে ধর্ষণ ও খুনের হুমকি দিতে শুরু করে। আমার ফোন নম্বর কোথা থেকে যোগাড় করে তারা আমাকে এসএমএস ও কলের মাধ্যমে ভয় দেখাত। 

    এক রাতে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছে যায়। প্রায় ৭০-১০০ জন মুসলিম জঙ্গি আমার রাজশাহীর বাড়িতে ইট ছুড়ে ভাঙচুর করে। আমি তখনও বোরখা পরতাম, নামাজ পড়তাম, এবং নিজেকে মুসলিম হিসেবেই মনে করতাম। তাই এই ধর্মীয় আক্রমণের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আমি একা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারছিলাম না। 

    ভারতে নতুন শুরু ও গ্র্যান্ডমার প্রভাব

    এই অসহায়তার মধ্যে আমি আমার গ্র্যান্ডমা’র (আমার মায়ের মা) সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি ভারতের নাগরিক এবং ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস (আইএফএস) অফিসার। তিনি একজন অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত এবং দৃঢ়চেতা নারী, যিনি তাঁর কর্মজীবনে বিভিন্ন দেশে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আমার মায়ের বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি ভারতেই থেকে যান এবং তাঁর কর্মজীবনের মাধ্যমে একটি সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, ক্লাস ১২ শেষ করে ভারতে চলে যাব। কিন্তু এইসব ঘটনার ফলে আমি কিছু দিনের মধ্যেই ভারতে চলে আসি।

    আমি সবকিছু নিজের দেশে সবকিছু ফেলে ভারতে চলে আসি এবং মুম্বাইতে ক্লাস ১২ সম্পন্ন করি। এই সময় আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা এবং ইসলাম সম্পর্কে আমার সন্দেহ আমাকে ধর্ম ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। মুম্বাইতে বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে আমি চেন্নাইতে চলে আসি, যেখানে বর্তমানে বসবাস করছি।

    আমার প্রেরণা: আমার গ্র্যান্ডমা

    আমার গ্র্যান্ডমা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। তিনি শুধু একজন সফল আইএফএস অফিসারই নন, একজন অসাধারণ মানুষ। তাঁর জীবনের শৃঙ্খলা, দৃঢ়তা, এবং ন্যায়বোধ আমাকে সবসময় অনুপ্রাণিত করে। তিনি বিভিন্ন দেশে ভারতের কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব করেছেন, এবং তাঁর কাজের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন শক্তিশালী ও স্বাধীন নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর কাছ থেকে আমি শিখেছি কীভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজের লক্ষ্যের প্রতি অটল থাকতে হয়। আমার কাছে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা আদর্শ নয়, আমার গ্র্যান্ডমাই আমার আদর্শ। আমি চাই তাঁর মতো একজন প্রতিষ্ঠিত, সৎ, এবং শক্তিশালী মানুষ হতে। 

    শেষ কথা

    আমার জীবনের এই যাত্রা সহজ ছিল না। শৈশবের ক্ষতি, ধর্মীয় সন্দেহ, এবং সামাজিক নিপীড়ন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমি শিখেছি নিজের উপর ভরসা রাখতে, সত্যের পথে অটল থাকতে, এবং নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে। আমার গল্প হয়তো অনেকের মতোই, কিন্তু এটি আমার নিজের সত্যের সন্ধান। আমি এখন চেন্নাইতে নতুনভাবে জীবন শুরু করেছি, এবং আমার গ্র্যান্ডমার পথ অনুসরণ করে একজন স্বাধীন ও সফল মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখি।

    No comments