Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন ।। কলাম

    ধানীসাফা বাজারে এক দূরন্ত কৈশর কেটেছে আমার। জীবন ঘনিষ্ট বন্ধুদের অনেকেই ধানীসাফার। ফ্রেন্ড মাসুদ, মুক্তা, শামীম, সুমন রায়, প্রাণ, আল-আমীন, রলি, পারভীন, তুহিন, আকরাম, কাইয়ূম এরকম আরো অনেকে। এরা কেউ কেউ আমার ক্লাস ফ্রেন্ড আনার কেউ কেউ আবার আমার পারিবারিক আত্মিয় ছিলো। আমরা প্রাত্যেকে প্রত্যেকের বাসায়-ই থেকেছি খেয়েছি। আমাদের সকলে যাতায়াতই সকলের পরিবারে ছিলো। বিশেষ করে আমি। 

    আমার বাবা কৈশরে আমাকে টিভি দেখতে দিতেন না। তখন নিজের বাসায় টিভি থাকা সত্ত্বেও আমি অন্যের বাসায় গিয়ে টিভি দেখতে বাধ্য হতাম। বিশেষ করে রলি, সুনম, মাসুদ এদের বাসায় টিভি দেখতে জেতাম-ই। তখন সময়টা ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৯ সাল। আলীফ লায়লা, আকবর দ্যা গ্রেট, সিন্দবাদ, মুভি অব দ্যা উইক এর সময়। টিভি দেখার কারনে হলেও অনেকের সাথে আমার আলাদা সখ্যতা ছিলো। আমি এখানে কার কথা আলাদা ভাবে লিখব জানি না, প্রত্যেকের সাথেই আমার এত্ত বেশী অম্ল-মধুর সম্পর্ক রয়েছে যে আমি লিখে শেষ করতে পারব না। কি না করেছি..!! তবে আজ আমি আমার এক বিশেষ বন্ধুর কথা লিখতে বসেছি। লিখতে বসেছি ওর মায়ের কথা। যাকে ঘিরে আমার স্মৃতির ভান্ডার এত সমৃদ্ধ যে তা দিয়ে একটি আস্ত উপন্যাস হবে। ওর নাম প্রাণকৃষ্ণ কর্মকার। প্রথমে ও আমর এক ক্লাস নিচে পড়ত। পরে আমি এইটে দুইবছর থাকার ফলে আমরা ক্লাশমেট হয়ে গেলাম।




    প্রাণ কৃষ্ণ যখন আমার এক ক্লাস নিচে পড়ত তখন আমার ইংলিশ শিক্ষক বাবার কাছে ও ইংলিশ পড়ত। প্রাণ তখন থেকে সবচেয়ে ভদ্র সভ্য ছেলে হিসেবে বার্ষিক পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে দুটি পুরস্কার জিতেছে আর আমার বাবা তখন অলরেডী আমার মারামারির খেসারত হিসেবে বেশ কিছু টাকা আমার প্রতিপক্ষকে দিয়েছে চিকিৎসা খরচ হিসেবে। কিভাবে জানিনা ইস্কুলের সবচাইতে ভদ্র ছেলেটির সাথে আমার কঠিন বন্ধুত্ব হয়ে গেল। 


    কর্মকারের কাজ আমাকে ছোট বেলা থেকে ভিষন আকর্ষণ করত। একটা শক্ত লোহাকে আগুনে পুড়িয়ে লাল করে অন্য রুপ দেয়াকে আমার কাছে তখন এক চরম বিস্ময়কর আর ক্রিয়েটিভ কাজ বলে মনে হতো। এমনও হয়েছে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছি প্রাণের বাবা-চাচার দোকানে। তাঁরা যে আমাকে কি পরিমান আদর করতেন তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। প্রায়ই আমি প্রাণ কৃষ্ণদের বাসায় দুপুরে খেতাম। আমাদের দেখা হতো সকাল বেলা স্কুল শুরু হওয়ারও আগে। ও আসতো আব্বুর কাছে পড়তে। তার পর আমরা একসাথে স্কুলে যেতাম। স্কুল ছুটির পর আমরা সাফা মসজিদের পুকুরে গোসল করতাম। গোসল করতাম না ছাই। সেই ডুবান ডুবাইতাম। সাফা মসজিদের সামনে পিছনে দুই পাশে দুটি পুকুর আছে। এমন অনেকদিনে হয়েছে যে আমরা সামনের পুকুরের পানি ডুবাতে ডুবাতে এমন ঘোলা করে রেখেছি যে বাজারের অনেকেই গোসল করতে এসে ফিরে যেত। কেউ কেউ এসে ধমক ধামক দিয়ে উঠিয়ে দিতো আমরা তখন আবার পিছনের পুকুরে গিয়ে ডুবাতাম। আহা আহা সেই দিন.....



    যাই হোক পূজা পার্বন বা স্পেশাল কোন অনুষ্ঠানে আমি প্রানদের পরিবারে সবসময়ই এক বিশেষ অতিথি হিসেবেই উপস্থিত থাকতাম। তখন প্রানের মা পাতিল নিয়ে এসে রাখতেন আমার আর প্রানের সামনে। আমার মনে হতো আমি মুসলমান বলে আমাকে ওরা একটু বেশী খাতির করত। একদিন মনে আছে আমি প্রানদের দোকানে বসে ওর দাদার আর চাচার কাজ দেখছি এমন সময় কাকী এসে বললেন
    -এ মনু তোর জন্য আজ তোর কাকু বড় একটা শৌল মাছ কিনছে। আজ তুই আমাদের বাসায় খাবি। যা বাসায় বলে আয়।
    এটা এমন কোন বিষয় না। প্রায়ই এরকম হয়ে থাকে। আমিও বাসায় বলে এলাম। মাও এরকম বিষয় অভ্যস্ত। দুপুরের সময় আমি গোসল টোসল করে গেলাম খেতে। প্রানের মা ভাজা মাছের কড়াই টা এনে রাখলেন। ইয়া বড় বড় একেক পিস মাস। একটু বেশী ঝাল দিয়ে নতুন আলু ফলি ফলি করে দিয়েছে। ধনে পাতা আর হলুদ মরিচ দিয়ে সিম্পল রান্না। মোটা চালের ভাত দিয়ে খেতে কিযে স্বাদ তা লিখে আমি কেন রান্না বিষেসজ্ঞ টমি মিয়াও বোঝাতে পারবেন কিনা সন্দেহ। খেতে বসেছি আমি প্রাণ আর ওর ছোট বোন সুপ্রিয়া। আমি এতো খেয়েছিলাম যে আমার প্রাণদের বাসায় ঘুমাতে হয়েছিলো দুপুরে। 


    সেই সময় ওদের ধর্মীয় এমন কোন অনুষ্ঠান ছিলো না যেখানে আমার উপস্থিতি থাকত না। তখন আমি জামাতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। নামাজ শেষে টুপি-পাঞ্জাবি পরে ঠাকুর ঘরে গিয়ে প্রসাদ খেলেও প্রাণের মা কিংবা দাদী কখনও কিছু বলতেন না। আমরা খেতে বসলে প্রানের মা বাতাস করতেন। আমি নিচে গিয়ে প্রাণকে ডাকা ডাকি করলে ও মা মাচায় ডেকে নিয়ে যেতেন আমাকে।
    -এ মনু এদিকে আয়। আমরা সবাই মাচায়। শাবনাজ-নাইমের সিমেনা চলতেছে আয় দেখ। আমি কাঠের সিড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গিয়ে চম্পার মাথায় একটা আর সোনাইয়ের মাথায় একটা গাট্টা মেরে দুই পা মুড়ে বসে পরতাম। 




    অনেক অনেক দিন পরের কথা। এবছর (২০১৬) মার্চের দিকে আমি বাড়ীতে গেলাম নির্বচনের উদ্দেশ্যে। তখন ধানী সাফা উইনিয়নের প্রতিটি গ্রাম চষে বেড়িয়েছি। একদিন ওয়ার্ক করতে গেলাম সাফা বাজারে। হঠাৎ মনে হলো একটু প্রান কৃষ্ণদের বাসায় যাই কাকিমার সাথে দেখা করে আসি। আমার সাথে প্রানের মায়ের শেষ বারের মতো দেখা হয়েছিলো তখন ক্লিন সেভই থাবতাম। উনি আমাকে কখনও দাড়ি গোঁফে দেখেন নি। কিন্তু নির্বচনের সময় আমার মুখ ভরা দাড়ি ছিলো। আমি গিয়ে প্রাণদের দরজায় নক করলাম। বেশ কয়েবার নক করার পর কাকি এসে দরজা খুললেন। কেমন যেন ভিত দৃষ্টি। দরজা একটু ফাঁকা করে বললো কাকে চান?
    -কাকী আমি বাতেন। প্রানের বন্ধু।
    -কেনম আছো গেদু কত্ত বড় হইছো.... 

    আমি খেয়াল করলাম উনি এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। দরজা খুলে আমাকে ভিতরে যেতে বলছেন না। আমি ভিষণ অবাক হলাম। এমনটা হওয়ার কথা নয়। আমার সাথে থাকা দুয়েকজন যাবার জন্য তাড়া দিলো। আমি ইচ্ছে করে আর বেশী কথা না বাড়িয়ে বললাম
    -কাকীমা একটু ইলেকশনের কাজ করছি আজ যাই?
    -বইলি না গেদু?
    -না কাকী একটু ব্যস্ত।
    -চারদিকের যেই অবস্থা গেদু সারাক্ষন ভয়ে থাকি।
    -কেন কাকি মা কি হইছে?
    -দেহ না খালি কোপাইয়া কোপাইয়া হিন্দু গো মাইররা হালায়, ঘর বাড়ী দহল কইরা লইয়া যায়, আগুন দেয়।


    আমি কোন কথা বললাম না। কারন এই যে বা যারা কোপাইয়া মাইররা হালায় বা ঘর বাড়িতে আগুন দিয়ে দখল করে নেয়, কোন না কোন ভাবে সে বা তারা আর আমি ধর্মীয় ভাবে মুসলমান, তা কাকি মা ও জানেন। এর আগের বার যখন এসেছিলাম তখনকার আমি আর এখনকার আমি সাইজে সাস্থে একই। তখন কাকিমা আমাকে টেনে কোলের মধ্যে নিয়ে ছিলেন, এখন কেন শুধু তার নথ বেরিয়ে দরজার ফাঁকে? আজ আমার মুখে দাড়ি বলে আমি বাইরে? 


    কাকীমা বললনে
    -আমি ছোট বেলায় গন্ডগোলের সময় এমন দেখছি। কিন্তু এহন এমন হয় ক্যান? শেখ সাইবের মাইয়া গদিতে, এই অবস্থায় যদি রাইতে ঘুমাইতে ভয় পাই তাইলে অন্য কেমনে হইবো? এইডা কি আমাগো দ্যাশ না? আমাগো বাপ দাদার ভিটা না? আমার ঘরে অন্য মানুষে আগুন দিবে কেন? দখল করবে কেন? জানস আমি প্রাণরে লইয়া কি পরিমান ভয়ে ভয়ে দিন কাটাই? এমনিতেই কথায় বলে মায়ের মনে যা কয় শত্রুর মনেও তা কয় না। সবাই খালি ইন্ডিয়া যায়, আমাগো তো ইন্ডিয়া কেও নাই। আমরা কই যামু? 

    আমি এই নারীর কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না। বধির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তার পর ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম
    -কাকিমা আমি যাই।
    -যা গেদু ভালো থাহিস। নির্বাচনের সময় চার দিকের অবস্থা কিন্তু ভালো না।
    আমি খালের পাড় ধরে হাঁটছি আর ভাবছি কোথাকার পরিস্থিতি কোথায় গেছে। হিন্দু জনগোষ্ঠি এক সাধারণ খেটে খাওয়া কর্মকার পরিবারের ৫২ বছরের গৃহীনির এই প্রশ্নের কোন জবাব আমার কাছে ছিলো না। কাকিমা আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো না। শুধু বলব এই ‘‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’’
    মা তুমি শুধু তোমার নথ বের করে ছেলেকে বার বার বললে ‘‘বইলি না? বইলি না?’’ আগের মতো কোলে টেনে নিয়ে বললে না ‘‘আইজ তোর জন্য সরপুটি ভাজছি সরিষার তেল আর বেশী কইরা পেঁয়াজ দিয়া খাইয়া যাইস।’’ কারন আমার বন্ধু প্রাণ কৃষ্ণর মা ভয়ে আছেন। কখন কি হয়ে যায়। 





    আজ ব্রাহ্মণবাড়য়িার নাসরিনগরে র্ধমীয় অনুভূতিতে আঘাতরে প্রতবিাদ করার নামে উপজলা সদররে অন্তত তিন শতাধকি হন্দিু বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়ছে। সখোনকার আটটি হন্দিুপাড়ার অন্তত ১০ টি মন্দরি হামলা করে প্রতমিা ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়ছে। যারা এটা করে তাদের আসল উদ্দেশ্য কি? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর সবিনয়ে জানতে চাইছি। এদেশে কি হিন্দুরা থাকবে না? যারা এই অমানবিক কাজ দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে তারা আসলে কারা? তাদের খুঁটির জোর কোথায়?


    ৩০ অক্টোবর, ২০১৬
    মোটা দাগের কথা
    © সাইফুল বাতেন টিটো

    No comments