জাতের নামে বজ্জাতি ।। ছোটগল্প
এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আমি ফোনটা অ্যাভয়েড করলাম। ধরলাম না। ইদানীং পরিচিত নম্বর থেকে কল এলেও বিরক্ত লাগে। মোবাইল ফোনে কথা বলতেই ভীষণ বিরক্ত লাগে আজকাল। আবার ফোন এলো একই নম্বর থেকে। ভাবছি, এবার ধরব। ধরে বলব— ভাই আমি একটু জরুরি মিটিং-এ, আপনি পরে ফোন দেন; কিন্তু ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে যে নামটা বলল তাতে আমার কৌশল আর খাটল না।
‘—হ্যালো দাদা, আমি শিশির; শিশির অধিকারী, সাতক্ষীরা থেকে। অধিকারী বইঘর...।’
আমি অনেকদিন ধরেই এই শিশির অধিকারীর ফোন নম্বর খুঁজছিলাম মনে মনে। তার সাথে যখন দেখা তখন তার ফোন নম্বর নিয়েছিলাম। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি।
নমস্কার শিশিরদা, কেমন আছেন?
জি দাদা, আছি মোটামুটি, আপনি কেমন আছেন?
জি ভালো। দাদা স্যরি, আমি আপনার ফোন নম্বরটা হারিয়ে ফেলেছিলাম বলে এতদিন ফোন করতে পারিনি। থ্যাংকস, আপনি মনে করে ফোন করেছেন।
দাদা আমি তো এখন ঢাকায়।
ও গড! তাই নাকি? আপনি এক্ষুনি আমার বাসায় চলে আসুন। কোথায় উঠেছেন আপনি?
আমার বোনের বাসায়। বাসাবো।
বাহ্! আমার বাসা দক্ষিণ বনশ্রী। আপনি একটা রিকশা নিয়ে এক্ষুনি চলে আসুন।
স্যরি দাদা, এখন তো আসতে পারব না। বিকেলে আসতে হবে। আমার বোন একটু ভালো-মন্দ রান্না করেছে। না খেলে কান্নাকাটি করবে। একমাত্র বোনের একমাত্র ভাই আমি। বোঝেনই তো।
আমি ভদ্রলোককে বাসার ঠিকানা দিয়ে ফোন রাখলাম। শিশির অধিকারী ফোন রাখার আগে জানাল, ঠিক চারটায় আমার বাসায় আসবে।
ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় সাতক্ষীরায় বসে। মাসতিনেক আগে একবার সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর কর্মক্ষেত্রে বেড়াতে। ভুলে লেখার খাতা নেইনি বলে বাজারে খাতা কিনতে গিয়ে ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়। কালীগঞ্জ বাজারে ‘অধিকারী বইঘর’-এর মালিক এই শিশির অধিকারী। খাতা কেনার সময় আমি আমার স্বভাবমতো রুলটানা খাতা খুঁজছিলাম বইয়ের দোকানগুলোয়। সবাই শিশুদের হাতের লেখা খাতা বের করে দিচ্ছিল। তার দোকানে গিয়ে আমার দরকারমতো খাতা খোঁজার পর তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন আমি খাতায় কী করব। বললাম আমি একজন লেখক, লেখার জন্য খাতা চাই। তিনি উঠে খুব সুন্দর ৩০০ পৃষ্ঠার ২টি খাতা দিলেন। আমার খুব পছন্দ হল। দাম দিয়ে ফেরার সময় বললেন— দাদা, যদি কিছু মনে না করেন, একটু বলবেন আপনি কী নামে লেখেন?
আমি আমার নাম বললাম। খুব অবাক হয়ে দেখলাম তিনি আমাকে চেনেন। আমি ভাবতেই পারিনি, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের মতো এক মফস্বলের বইয়ের দোকানদার আমার মতো অখ্যাত লেখককে চিনবে। এখন পর্যন্ত আমার কোনো বইও বের হয়নি। কয়েকটি দৈনিকের সাহিত্যপাতায়, কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় আর নিজের ফেসবুক পেজ ছাড়া আমি আর অন্য কোথাও লিখি না। ভাবছি সামনের বইমেলায় একটা ছোটগল্প সংকলন বের করব, কিন্তু বিক্রি নেই বলে প্রকাশকদের দেখলাম ছোটগল্প প্রকাশের ব্যাপারে আগ্রহই নেই।
ভদ্রলোক খুব করে ধরল, সাতক্ষীরার মিষ্টি আর চা খাইয়েই ছাড়বে। সাতক্ষীরায় এখনো দুধের কেজি পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা বলে কম টাকায় যেমন সুস্বাদু মিষ্টি পাওয়া যায় তেমনি গরুর টাটকা খাঁটিদুধের চা। চা-মিষ্টি আর তার কথার স্রোতে আমি ভেসে গেলাম। ভদ্রলোক পড়াশোনা করেছেন খুলনা বিএল কলেজে ইসলামের ইতিহাসে। আমি অনেক হিন্দুকেই ইসলামের ইতিহাস নিয়ে অনার্স পড়তে দেখেছি। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে বয়স আন্দাজ করার উপায় নেই। তবে চল্লিশের কম না।
চার প্রজন্মের বইয়ের ব্যবসা। শিশির অধিকারী ছাড়া এ ব্যবসা আর কেউ বাঁচানোর ছিল না বলেই তার এই জ্ঞানের সওদাগরী। তিনি নাকি আমার সব লেখাই পড়েছেন। আমাকে একটা গল্প বলার জন্য মনে মনে ভাবছিলেন আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, হঠাৎ এমন দেখা হয়ে যাবে ভাবেননি। কথা বলতে বলতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। বন্ধুর ফোনে হুঁশ ফিরল। সদ্যবিবাহিত বন্ধু আর তার পত্নী মিলে ভালোমন্দ রান্না করেছে আমাকে খাওয়াবে বলে।
পরেরদিন আসব এবং গল্প শুনব এমন প্রতিশ্রুতি আর সাথে আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে তার কার্ড নিয়ে আমি বন্ধুর বাসায় হাজির হয়ে মৃদু বকার সাথে সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে টিভিতে শুনলাম— আগামিকাল থেকে একসপ্তাহ অবরোধ! দুইদিন পর ঢাকায় আমার একটা ওয়ার্কশপ আছে। আমাকে পরশু সন্ধ্যার মধ্যে ঢাকায় থাকতেই হবে। আমার ইচ্ছে ছিল আরো একদিন থেকে ফিরব, কিন্তু অবরোধের কারণে সিদ্ধান্ত নিলাম সন্ধ্যার বাসেই ফিরব।
বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর কালো মুখ দেখে আমারও খারাপ লাগল, কিন্তু নিরাপদে প্রাণ নিয়ে ঢাকায় ফিরতে হলে আজ সন্ধ্যায় যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমি অবরোধ খুব ভয় পাই। ইহা হরতালের চাইতেও ভয়ংকর। অবরোধের সময় চলতি বাসে পেট্রোলবোমা মারা হয়। আর তার ফলাফল হয় খুবই ভয়ংকর। কেউ রেহাই পায় না। কেউ পুড়ে মরে, কেউ ভয়ে মরে। কেউ পুড়ে গিয়ে সারাজীবন আধমরা হয়ে বেঁচে থাকে। আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। এরপর ভুলে গেলাম শিশির অধিকারীর কথা। মাঝখানে কিছুদিন রাইটার্স ব্লকে ভুগছিলাম। তখন শিশির অধিকারীর কথা, তার গল্পের কথা মনে পড়েছিল। খুঁজে দেখি কার্ডটা কোথাও নেই। আজ তিনি নিজে ফোন করলেন।
ঠিক চারটার সময়ই বাসার কলিংবেল বেজে উঠল। ডোর-হোলে তাকিয়ে দেখি দুহাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে শিশির অধিকারী দাঁড়িয়ে। ইদানীং ডোর হোলে না দেখে খুলি না। ভয় লাগে। আমি লেখক মানুষ। কোন লেখায় কখন কার অনুভূতিতে আঘাত লাগে কেমনে বুঝব? পরে যদি চাপাতি দিয়ে কল্লা ফেলে দেয়!
দই, মিষ্টি আর মাছ নিয়ে শিশির অধিকারী আমার বাসায় এসেছেন। অনেক কথাবার্তার পর শিশির বললেন, আপনাকে যে গল্পটা বলব বলেছিলাম সেটা কি এখন শুনবেন?
অবশ্যই শুনব। আপনি বলুন...
আসলে আমার সাথে জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যা বিগত ২১ বছর ধরে মাছের কাঁটার মতো আমার গলায় আটকে আছে। আমি না পারি ফেলতে, না পারি গিলতে। আমি ঘটনাটা কাউকে বলতেও পারছি না, ফলে আমার মধ্যে সবসময় একটা অস্বস্তি কাজ করে। আমি আপনার লেখা পড়ি। আপনার প্রকাশিত যত লেখা আমার চোখে পড়েছে সব পড়েছি। আমার ঘটনাটা শোনার পর সেটি আপনি লিখবেন, কি লিখবেন না সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার। তবে যদি লেখেন তো অনুরোধ থাকবে— স্থান ও পাত্রের নাম সরাসরি উল্লেখ করবেন না।
একথা বলে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কোনো উত্তরের আশায়। আমি বললাম— দেখুন শিশিরদা, আমি মানুষের কাছে মানুষের গল্প বলি। এটা বোধ হয় আপনি জানেন এবং বোঝেন। আমার সব গল্পই তো মানুষকে নিয়ে বা মানুষের সাথে যুক্ত বিষয় নিয়েই। আমি যদি মনে করি লিখব, তবে আপনার বক্তব্য বা অনুরোধ যা-ই বলেন-না কেন সেটা অবশ্যই রাখব। আপনি নিশ্চিন্তে বলেন। কাজের মেয়েটা শিশিরবাবুর নিয়ে আসা মিষ্টি, সন্দেশ, দই, ফল, পানি দিয়ে যেতে যেতে বলল— চা কি এখন দেব?
না পনেরো-বিশ মিনিট পরে দাও।
ছোটগল্পঃ প্রকৃতির খামখেয়ালি
শিশিরবাবু গেলাসের অর্ধেক পানি খেয়ে গেলাসটা রাখতে রাখতে বলতে শুরু করলেন— শুনুন তবে। ঘটনাটা আজকের না। নাইন্টি ওয়ানের কথা। তখন আমি খুলনা বিএল কলেজে পড়ি। আমি সনাতন ধর্মের হলেও আমার বন্ধুবান্ধব, বেস্টফ্রেন্ড সব ছিল মুসলমান। এখনো আমি থাকি সাতক্ষীরায় একটা হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়, কিন্তু আমার আশি ভাগ বন্ধুবান্ধবই মুসলমান। আর আমার পড়ার বিষয় ইসলামের ইতিহাস হওয়ার কারণেও আমার মুসলমান বন্ধু যেমন ছিল, তেমনি আমি মিশে গিয়েছিলাম মুসলিম কালচারের সাথে। ইসলামের ইতিহাসের প্রতি প্রেম থেকে নয় বরং অন্য কোনো বিষয় পাইনি বলেই এটা নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কলেজে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল সাত্তার। ও আর আমি হোস্টেলে একরুমে থাকতাম। দুজনে মিলে আলাদা রান্না করে খেতাম। আমার একটা অভ্যাস ছিল, সপ্তাহে একবার বাড়ি যাওয়া। সাত্তার আমার মায়ের হাতের রান্না খুব পছন্দ করত বলে ও প্রায়ই আমার সাথে আমাদের বাড়িতে যেত। একবার আমাকে বলল, ওদের বাড়িতে যেতে। আমি খুশিমনেই রাজি হয়ে গেলাম, কিন্তু একটা শর্ত ছিল, আমি যে হিন্দু সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। কারণ, ওর বাবা ছিলেন প্রচণ্ড গোঁড়া মুসলমান। মুসলমান ব্যতীত অন্য ধর্মের কাউকে মানুষই মনে করতেন না। আমি ওর কথায় সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের সময়ে বাম রাজনীতির কড়া প্রভাব থাকায় আমি জাত-ধর্ম এসব তেমন বিশ্বাস করতাম না বা ওসব নিয়ে আমার তেমন আগ্রহও ছিল না বা এখনো নেই। তবে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি। সে আল্লাহ হোক কি ভগবান। আমি শুকর-গরু দুটোই খাই। ফলে কোনো মুসলমান বাড়িতে গেলে আমার কোনো সমস্যাই হত না।
আর শিশির নামটাও কমন। নির্দিষ্ট কোনো ধর্মকে ইঙ্গিত করে না। আমি আর সাত্তার যখন ওর বাড়িতে গেলাম তখন কী মাস স্পষ্ট বলতে পারব না। তবে বর্ষাকাল ছিল এটা মনে আছে। ওর বাড়ি ছিল বরিশালের পিরোজপুরের একটা গ্রামে। গ্রামের নামটা না-ই বলি। তবে প্রত্যন্ত গ্রাম। বিদ্যুতের তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি যখন ওদের বাড়িতে গেলাম, তখন একটা উৎসবের আমেজ ছিল। ওর বড়ভাইয়ের বউয়ের বাচ্চা হবে। তার নাকি বিয়ের একযুগ পর সন্তান হচ্ছে। বিয়ের আটবছর পর একটা মিসক্যারেজ হয়েছিল, এখন দীর্ঘদিন পর আবার বাচ্চা হচ্ছে। সাত্তারের বড়ভাই ঢাকায় একটা সরকারি চাকরি করত। তাকেও চিঠি লেখা হয়েছে, সেও হয়তো দু-একদিনের মধ্যে বাড়িতে ফিরবে। সাত্তারদের পুরনো আমলের বিশাল কাঠের বাড়ি। দেখলে মনে হয় কাঠের রাজবাড়ি। এলাকায় ওর বাবার প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল বেশ। বাড়ির সামনেই মসজিদ। আমাকে সাত্তারের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হত। আমার বেশ মজাই লাগত। সাত্তারের বাবা রাশেদ খান আমি যাওয়ার কয়েকমাস আগেই হজ্ব করে এসেছেন বলে একটু বাড়াবাড়ি করতেন।
সাত্তারদের বাড়ির চারপাশে দেয়াল তোলা ছিল। বাড়ির ভেতরে কোনো পুরুষের প্রবেশ যেমন হারাম ছিল, তেমনি নারীদের জন্য ছিল আরো কড়াকড়ি। কোনো নারীর কণ্ঠ ভেতরের ঘর থেকে সামনের ঘরে আসা ছিল হারাম। তিনি ফজরের আজানের সময় বাড়ির ছেলেদের তুলে নিয়ে মসজিদে যেতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন জামাতের সাথে। তার ধর্মীয় কঠোরতা আর গোঁড়ামি দেখে বোঝা যেত তিনি খুব শিক্ষিত ধার্মিক নন। কোরআন হাদিস খুব একটা জানতেন বলে মনে হয়নি। সবসময় জোব্বা, পাগড়ি পরে থাকতেন। বুক সমান দাড়ি ছিল তার। সাদা ধবধবে দাড়ি। ইয়া বড়, লম্বা ফিগার, তেমনি স্বাস্থ্য। আমাদের সাথে পাল্লা দিয়ে খেতেন। ওই ৬০-৬৫ বছর বয়সেও তিনি জোয়ান-মর্দের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করতে পারতেন। আমি যে ঘটনাটা আপনাকে বলব, সেই ঘটনাটির সাথে তার বেশ সম্পর্ক রয়েছে বলেই এত বর্ণনা করছি। বিরক্ত হচ্ছেন না তো আবার?
আরে না না, কী যে বলেন? আপনার গল্প বলার ধরনটাও বেশ চমৎকার।
এর মধ্যে কাজের মেয়েটা চা নিয়ে এলো। আমরা চা খেয়ে সিগারেট ধরালাম।
নাক দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে শিশির অধিকারী আবার বলতে শুরু করলেন— তিন-চারদিন খুবই আনন্দ-ফুর্তি আর খাওয়া-দাওয়া করে কিভাবে কেটে গেল টেরই পেলাম না। বিপত্তি শুরু হল পঞ্চমদিন। সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হল। দুপুরে আমরা বিভিন্ন প্রকার মাছ দিয়ে ভুরিভোজ করে কাচারিঘরে বসে তাস খেলছি। কাচারিঘর আসলে এমন একটা ঘর যেটা মূলবাড়ি থেকে একটু বিচ্ছিন্ন থাকে। বাড়িতে পুরুষ মেহমান এলে সেখানে থাকে। আড্ডা দেয়, তাস খেলে। এমন সময় জানতে পারলাম সাত্তারের ভাবির পেইন উঠেছে। সকলের মধ্যে একটা খুশি দোলা দিয়ে গেল। সাত্তারের যত আপন ভাই, চাচাতো ভাই আছে তাদের মধ্যে এই প্রথম কারো সন্তান হচ্ছে। তাই উত্তেজনাটা সবার মধ্যে একটু বেশিই ছিল। সাত্তারের বাবা অজু করে চোখে সুরমা, কানে আতর দিয়ে ঘুরছেন। বাচ্চা খালাস হওয়ার সাথে সাথে আজান দেবেন বলে। একটু পরই গ্রামের একমাত্র ধাত্রী চলে এলো। সকলের মধ্যেই একধরনের উত্তেজনা কাজ করছে। সাত্তারের বাবা দুটো বিশাল সাইজের খাসি বেঁধে রেখেছেন। জবাই করা হবে। কালিজিরা চালের পোলাও হবে। বাড়ির কাজের লোকেরা জাল নিয়ে গেছে মাছ ধরতে।
বিশাল আয়োজনে গমগম করছে পুরো বাড়ি। ওদিকে বৃষ্টিও পড়ছে। আমি একবার সাত্তারকে জিগ্যেস করলাম, দোস্ত যদি হাসপাতালে নিতে হয়, ব্যবস্থা আছে তো? ও বলল, নাহ! হাসপাতালে নিতে হবে না। আর আব্বা বাড়ির বউকে হাসপাতালে নিয়ে পুরুষ ডাক্তারের দ্বারা ডেলিভারি করাবে— এ কথা ভাবলি কী করে? আমি একটু মর্মাহত হলাম। এরকম ধারণা ওই সময়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে ছিল। কিন্তু সাত্তারদের পরিবারে ওর বাবা-মা বাদে সবাই শিক্ষিত। ওদের পরিবারে এমন নিয়ম দেখে আমি একটু অবাকই হলাম। সাত্তারের বাবার কট্টর গোঁড়া চিন্তাভাবনার কথা মাথায় রেখে আমি আর বাড়াবাড়ি করলাম না। সন্ধ্যার কিছু আগে বুঝতে পারলাম ডেলিভারি সংক্রান্ত কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে, কিন্তু আমরা পুরুষেরা তেমন কিছু জানতে পারছি না। আমরা তাসখেলা বন্ধ করে দিয়ে সবাই গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছি। আমি ভাবছি এই কুপির আলোয় কিভাবে ডেলিভারি হবে? তাও আনাড়ি গ্রাম্য ধাত্রী! কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার কথা আমি কাউকে বললাম না। এখান থেকে হাসপাতাল কত দূরে তা আমার জানা নেই। তবে অন্তত আট-দশ মাইলের মধ্যে যে নেই তা জানি। তার ওপর কোনো ভালো রাস্তা নেই। যেতে হলে যেতে হবে খালে-নৌকায়। এর বেশি আমি কিছু জানি না।
বেশ কিছু সময় পর সাত্তার জানাল ওর ভাবির পেটে নাকি জমজ বাচ্চা, বলেছে ধাই। তাই একটু ঝামেলা হচ্ছে। অন্য কোনোকিছু না। আর এই ধাই বহুত জমজ সন্তান নাকি খালাস করেছে। তাই দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সময় যত গড়াতে লাগল সমস্যাও তত বাড়তে লাগল। সমস্যা যে কী, তা আমরা স্পষ্ট করে বুঝতে পারছি না।
রাত নয়টার সময় সাত্তার এসে জানাল ধাই কিছুই করতে পারবে না। সে বলে দিয়েছে যদি মা-সন্তান বাঁচাতে হয় তাহলে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। সাত্তারের বাবা প্রথমেই বাদ সাধলেন। আমি সাত্তারকে বললাম, যেভাবেই হোক তাকে রাজি করা। আর সাত্তারের বাবার কথা হাসপাতালে নিয়ে পরপুরুষের সামনে বাড়ির বউ নিলে বংশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বাতি দেয়ার মতো কেউ আর থাকবে না। এ নিয়ে সাত্তার আর তার বাবার মৃদু তর্ক হচ্ছে। সাত্তারের বাবার সামনে তার কোনো ছেলেমেয়েই গলা উঁচু করে কথা বলে না। সাত্তারের বাবা বলছে যা করার আল্লাহ করবে। এক বড় মাওলানাকে আনা হয়েছে, যে কতক্ষণ পরপর পানি পড়া দিচ্ছে। একবার দেখলাম, বড় একটা কাঁসার বাটিতে পড়া পানি মানে ফুঁ-দেয়া পানি বাড়ির চারদিকে ছিটাচ্ছে আর মুখে ‘হায় হায় যাহ্ যাহ্’ করছে আর বিড়বিড় করে মুখে দোয়া-কালাম পড়ছে। দেখে আমার হাসিও পাচ্ছে আবার কষ্টও হচ্ছে।
সবার অনুরোধে একসময় সাত্তারের বাবা রাজি হলেন ১২ মাইল দূরে উপজেলা সদর থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিতে। ঘাটে নৌকা বাঁধা ছিল। সেই নৌকার ছইসহ চারপাশ কাপড় দিয়ে মোড়ানো হল। বাড়ির ঝি-বউরা নৌকায় কোথাও গেলে এমনই নিয়ম। সবকিছু মিলিয়ে রোগীকে নিয়ে যখন রওনা দিলাম তখন রাত এগারোটা। নৌকায় ধাই, সাত্তারের ভাবি আরো এক মহিলা, যাকে আমি চিনি না; মাঝি দুজন, আমি ও সাত্তার আর ওর বাবা এক নৌকায় আর পেছনে এক নৌকায় আসছে আরো কয়েকজন মর্দ। খেয়াল করলাম, তাদের সাথে দেশি ধারালো অস্ত্র; লাঠিও রয়েছে। ওর বাবা নাকি এভাবেই চলে। কোথাও গেলে সাথে লাটবহর থাকে।
পড়ুন ছোট গল্পঃ নইটপাশ
নৌকায় উঠে বুঝতে পারলাম, সাত্তারের ভাবি আসলে কতটা অসুস্থ। কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে আর চিৎকার করছে। পাশেই কেউ কোরআন শরিফ পড়ছে। সাত্তারের বাবা সবাইকে বলছে আল্লাহকে ডাকতে। কতক্ষণ পরপর পড়া পানি এদিক-সেদিক ছিটাচ্ছে যেন ইবলিশ শয়তান কোনো ক্ষতি করতে না পারে। নৌকার সবাই আমরা আল্লাহকে ডাকছি। কিন্তু নৌকা কিছুদূর যেতেই শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। সাত্তার ভেতরে গিয়ে পানি সেঁচতে শুরু করল। ঝড়ের কারণে নৌকার গতিও বেশ কম। আমরা অনেক কষ্টে একটা খালে গিয়ে পড়লাম। অল্প কিছুক্ষণ পরে ঝড়বৃষ্টি কিছুটা কমে বটে কিন্তু বড় খালে তখন উজান। মাঝি বলল, গুণ টানতে হবে। আমি আর সাত্তার দুজনে নৌকার গড়ার সাথে দুটো লম্বা দড়ি বেঁধে দুজন খালের দুইপাড়ে নেমে গেলাম। সাত্তারের বাবা নৌকার শেষমাথায় বসে বৈঠা বাইছেন আর দোয়া-কালাম পড়ছেন।
খালের পাড়ে আমার হাঁটতে খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। অপরিচিত জায়গা, তার ওপর ঘোর অন্ধকার। টের পেলাম কয়েকবার পা কেটেছে, কাঁটা ফুটেছে। বৃষ্টি আর ঠাণ্ডা বাতাসে আমি কাঁপছি থরথর করে, কিন্তু আমার গায়ে তখন অসুরের শক্তি। সাত্তার মাঝেমধ্যে খালের ওপার থেকে ডাক দিচ্ছে। একসময় ঝড়বৃষ্টি থেমে গেল। আমরা রাত দুইটার দিকে ‘মাইট ভাঙ্গা’ গিয়ে পৌঁছলাম। আমরা হাসপাতালে পৌঁছে দেখি সব সুনসান-নীরব। কোথাও কেউ নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমরা গাইনি ডাক্তারের খোঁজ পেলাম এবং একজন মহিলা ডাক্তারই পেয়ে গেলাম। সকলের মধ্যে একটু হলেও স্বস্তি এলো।
আমরা ডাক্তারকে তার কোয়ার্টার থেকে ডেকে নিয়ে এলাম। আমি, সাত্তার আর ওর বাবা করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। ডাক্তার রোগীকে নিয়ে ওটিতে চলে গেছে। এমন সময় আমি নিজ থেকে সাত্তারকে বললাম, চাচা তো প্রথমে হাসপাতালে আনতেই চাইছিলেন না। কপাল ভালো মহিলা ডাক্তার পাওয়া গেছে। এখন ভগবান মুখ তুলে তাকালেই হয়। কী আর বলব দাদা, আমার ওই একটা কথাতেই সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল। হঠাৎ করে আমার পেছন থেকে ডাক দিলেন সাত্তারের বাবা। ‘এই পোলা, তুমি কী কইলা? তুমি কি হিন্দু? মালাউন তুমি? ভগবানের নাম কইলা ক্যান?’ বলে দৃঢ়ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমার চোখে চোখ রাখলেন। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। মনে হল আমি বিরাট কোনো অপরাধ করে ধরা পড়ে গেছি। কী করব, কী বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। থতমত খেয়ে বললাম, না কাকু আমি হিন্দু হব কেন? আমি তো শ্যাখ। একথা বলায় তিনি খপ করে আমার হাতের কব্জি ধরে ফেললেন। সাত্তার আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। যেন আমরা দুই দুষ্টু ছাত্র হেডমাস্টারের কাছে ধরা পড়ে গেছি কোনো অপরাধ করে। তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সত্য কইরা কও তুমি কি মালাউন?’ আমি হতভম্ব হয়ে সাত্তারের দিকে তাকালাম। সাত্তার ওর বাবাকে বলল, আব্বাজি, কীসব কথা কন? ও মালাউন হতে যাবে কেন? আপনি দেখেন নাই এই কয়দিন ও আমগো লগে নামাজ পড়ল, পেট পুইরা গরুর মাংস খাইল। হিন্দুরা গরুর মাংস খায়? ‘তুই চুপ কর হারামজাদা, তোর বিচার পরে করতেছি। এই পোলা তুমি যদি সত্যি বাপের পোলা হইয়া থাক আর আল্লাহর বান্দা, নবীর উম্মত হও তাইলে চাইর কলেমা মুখস্থ কও। আমি মিথ্যা কথা বিষ্ঠার চাইতেও বেশি ঘৃণা করি।’ যখন সাত্তারের বাবার পাগলামি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল এবং তিনি আমার প্যান্ট খুলে পরীক্ষা করতে চাইলেন, তখন আমি আর টিকতে পারলাম না। আমি বললাম, জি আমি হিন্দু। সাথে সাথে চেহারায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন রাশেদ চাচা। দুহাত দিয়ে কষে থাপ্পড় মারতে লাগলেন সাত্তারের গালে। অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করলেন আমাদের দুজনকেই। তার আগেই সন্দেহ হয়েছিল কোথাও কোনো ঝামেলা আছে, তা না হলে তার মতো হাজির ঘরে কেন রহমতের ফেরেস্তার উপস্থিতি নেই? আমার মতো মালাউন তার বাড়িতে ঘাপটি মেরে ছিল বলেই রহমতের ফেরেস্তা ঢুকতে পারেনি। তার ওপর বিপদ নাজিল হয়েছে। আজ এই বিপদের জন্য সাত্তার আর আমি দায়ী। তিনি সাত্তারকে ছেড়ে দিয়ে একটা বেঞ্চে বসে রাগে ফুঁসতে থাকলেন।
পড়ুন ছোট গল্পঃ যাত্রী
এমন বিপদে সাত্তার তাকে ইচ্ছে করেই ফেলেছে। সাত্তারকে মুখে মুখে ত্যাজ্য করলেন। আমি একটা নাপাক প্রাণী, আমার সাথে তিনি আর কোনো কথাও বলবেন না। এমন সময় নার্স দৌড়ে এসে বলল— প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এই মুহূর্তে একব্যাগ ও-নেগেটিভ রক্ত দরকার। না হলে মা আর তার পেটের দুই সন্তানকে বাঁচানো যাবে না। হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের কাছে ও-নেগেটিভ রক্তের কোনো ব্যবস্থা নেই। যা করার রোগীর আত্মীয়স্বজনকেই করতে হবে।
মুহূর্তে আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমার রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ। আমি সাত্তারকে জানালাম। সাত্তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলল। দুমিনিটের মধ্যেই নার্স আবার এসে বলল, ‘ডোনার ম্যানেজ হয়েছে? যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। আধাঘণ্টার মধ্যে রক্ত দিতে না পারলে ডাক্তার কাউকে বাঁচাতে পারবে না।’ আমি দৌড়ে গিয়ে নার্সকে বললাম, আমার রক্ত নিন, আমার রক্তের গ্রুপ ও-নেগেটিভ। সাথে সাথে সাত্তারের বাবা এসে আমাকে পেছন থেকে কলার ধরে টানতে টানতে হাসপাতালের বাইরে নিয়ে ফেলে দিলেন। সাত্তার প্রথম ওর বাবার ওপরে চটে গেল এবং বলল— আব্বাজি আপনে এখন যা করতেছেন, তা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। এই হাসপাতালে কারো ও-নেগেটিভ রক্ত নাই। ও একব্যাগ রক্ত দিলে ভাবি বাঁচবে। না হলে বাচ্চা দুইটাসহ ভাবি মারা যাবে। ‘মরে মরুক, মালাউনের শুয়ার খাওয়া রক্ত আমি আমার বংশের শরীরে ঢুকামু, তুই ভাবলি ক্যামনে? মোসলমান কইয়া তুই ঘরে মালাউন উঠাইয়া যে পাপ করছস তাতে আমার চৌদ্দগুষ্টির জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হইব। তুই তোর মালাউন বন্ধুরে নিয়া ভাগ। তোরে যদি এই হাসপাতালের চাইরপাশে দেহি তাইলে দুইটারেই কাইটা গরুর মতো ভাগ দিমু। তুইও এহন মালাউন হইয়া গ্যাছিস। নাফারমান কোথাকার...’ বলে তিনি পায়ের জুতা খুলে তেড়ে এলেন। আমরা ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে এলাম।
চারদিক ফর্সা হয়ে আসছে। আমার আর সাত্তারের সারাশরীরে কাদা আর বৃষ্টির পানিতে মাখামাখি, কী করব? কোথায় যাব? নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা জন্ম নিল। বড্ড অসহায় মনে হল এই অশিক্ষিত-ধর্মান্ধ লোকটার কাছে। আমি ইসলাম জানি। এমন কথা ইসলামে কোথাও লেখা আছে বলে আমার জানা নেই। তবে এটা জানি যেকোনো মূল্যে জান বাঁচানো ফরজ। এটা ইসলামে আছে, কিন্তু এই অশিক্ষিত-গোঁড়া ধর্মান্ধ লোকটাকে কে বোঝাবে? বারবার নিজেকে অপরাধী মনে হতে লাগল। কেন আমি বলতে গেলাম, এখন ভগবান মুখ তুলে তাকালেই হয়। আমি এমন কথা সচরাচার বলি না। কিন্তু অতি বিপদে পড়লে অতি নাস্তিক মানুষও এক অদৃশ্যের প্রতি আস্থা রাখতে চায়। কিংবা হতে পারে আমি আমার পারিবারিক আচার থেকেই কথাটা বলেছি। কিন্তু এই কথাটি না বললেই আর কোনো ঝামেলা হত না। আমি আর সাত্তার কিছু সময় পর আবার হাসপাতালের গেটে গেলাম। গিয়ে গেখি সাত্তারের বাবা দুজন ষ-ামার্কা লোক নিয়ে হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, সবার হাতে ধারালো অস্ত্র। আমরা আর এগোলাম না। খালের পাড়ে নৌকার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এলো। আমরা খালের পাড়ে একটা টঙঘরে আশ্রয় নিলাম।
ছোট গল্পঃ জুতা চোর
আনুমানিক ঘণ্টা দেড়েক পর বৃষ্টি থামল। এমন সময় দেখলাম, কাঁদতে কাঁদতে নৌকার দিকে ওদের এক কাজের লোক ছুটে আসছে। সাত্তার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? লোকটা জানাল সাত্তারের ভাবি আর পেটের একটা ছেলে, একটা মেয়ে তিনজনই পরপারে চলে গেছে। আমরা দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়লাম। নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হল। এ কী হয়ে গেল? আমার ভেতরে এক ভয়ংকর অপরাধবোধ জন্ম নিল। এ কেমন সাম্প্রদায়িকতা? যেখানে মানুষের জীবন তুচ্ছজ্ঞান করতে হবে? আমি সাত্তারকে বলে ওইদিনই খুলনায় চলে এলাম। খুলনা থেকে বাড়ি। আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বিষয়টা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলাম না। ভাবলাম, আর লেখাপড়া করব না; কলেজে ফিরে যাব না।
প্রায় মাসখানেক পর বাড়িতে সাত্তারের চিঠি এলো। সে চিঠির বক্তব্য ছিল আরো করুণ, আরো ভয়াবহ, আরো মারাত্মক। সাত্তারের ভাবি যেদিন মারা যায়, ওইদিনই দুপুরে সাত্তারের বড়ভাই বাড়িতে আসে। এসে সাত্তারের কাছে পুরো ঘটনা শুনে সে একধরনের পাগল হয়ে যায়। সে তার বাবার ঘরে ঢুকে সবকিছু বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়। গলায় গামছা বেঁধে টানতে টানতে বাড়ির বাইরে ফেলে দেয় নিজের জন্মদাতা বাবাকে। পরেরদিন সকালে কাচারিঘরের আড়ার সাথে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন সাত্তারের বাবা রাশেদ সাহেব।
এই পর্যন্ত বলে তিনি থামলেন। টি-টেবিল থেকে গ্লাস তুলে পানি খেলেন। তারপর আমার কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে বললেন, এই ছিল আমার ঘটনা। এটাই আপনাকে বলার ছিল। আপনি একজন লেখক। আপনার এমন ঘটনা জানা উচিৎ। এরকম সাম্প্রদায়িক মানুষ যে তিনি একা ছিলেন বা শুধু মুসলমানেরা হয়, হিন্দুরা হয় না, তা নয়। আমি নিজে হিন্দু পরিবারে জন্মেছি। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের গায়ের ছায়া পড়লে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা যে স্নান করে তা তো আমি নিজ-চোখে দেখেছি।
ওনাকে আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। তিনি নিজেই আবার বললেন— আমি এমন মুসলমান-হিন্দুও দেখেছি, তারা যুগের পর যুগ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে কাটিয়ে দিয়েছে। অথচ যে যার ধর্ম পালন করছে।
জবাবে আমি বললাম, আপনি অভিনেতা শংকর শাঁওজালকে চেনেন না?
হ্যাঁ চিনি তো, তিনি তো বোধহয় আগের মতো অভিনয় করেন না।
না করেন না, বয়স হয়েছে তো। তার স্ত্রী যে মুসলমান এ কথা আপনি জানেন?
না তো, তাই নাকি?
হ্যাঁ, শুধু মুসলমানই, না আমি দেখেছি তিনি নিয়মিত রোজা-নামাজ করেন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে যে মানবতা, প্রেম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তাঁরা দুজন। বাইদাওয়ে আপনি সাতক্ষীরায় যাবেন কবে?
আরো দিনতিনেক আছি। কিছু বই নেব দোকানের জন্য। বাংলাবাজার, নীলক্ষেত, আজিজ সুপার মার্কেটে কেনাকাটা করব, তারপর যাব।
ঠিক আছে, আপনাকে নিয়ে শঙ্করদা’র বাসায় বেড়াতে যাব। ভাবি খুব ভালো গরুর মাংস রান্না করেন। আপনাকে খাওয়াবে।
আচ্ছা আচ্ছা, খুব ভালো হবে।
আজ তাহলে উঠি, দাদা আপনাকে ফোন দেব ।
আচ্ছা দাদা ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন।
শিশির অধিকারী বিদায় নেয়ার পর দেখলাম, তার আনা ব্যাগে বড় একটা বইয়ের প্যাকেটও রয়েছে। খুলে দেখি মহাভারতের কলকাতা প্রিন্ট। দেখে খুবই ভালো লাগল। ভাবছি ভদ্রলোককে কী উপহার দেয়া যায়।
সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
(গল্পটি আমার দ্বিতীয় ছোটগল্প সংকলন ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ এ প্রকাশিত। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৯ তে অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে)
No comments