Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    নাইটপাস ।। ছোটগল্প

    আমাদের ক্যাম্পে তিনজন মিজান ছিল। একজনকে আমরা ডাকতাম লম্বা মিজান; কারণ, ওর হাইট ছিল সাড়ে ছয় ফিট, তুখোড় ভলিবল প্লেয়ার। একজনকে ডাকতাম ওসিইউ মিজান। কারণ, ওর ট্রেড ছিল রেডিও অপারেটর। আর তৃতীয় মিজানকে ডাকতাম নাইটপাস মিজান বলে। 

    সেনাবাহিনীতে নাইটপাস বলে একধরনের অল্প সময়ের ছুটি আছে। এমনিতে যারা ফ্যামিলি নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে থাকে না, তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন তথা সরকারি ছুটির দিনগুলো ক্যাম্পেই কাটাতে হয়। বড়জোর সিটিপাস নিয়ে শহরে কেনাকাটা বা ঘোরাফেরা করতে পারে। তবে যাদের বাড়ি ক্যান্টনমেন্টের আশপাশে বা পাঁচ-ছয় ঘণ্টার পথ, তারা বৃহস্পতিবার দুপুরের পর থেকে শনিবার সান্ধ্য রোলকলের পূর্বপর্যন্ত ছুটি পায়। এটাকে নাইটপাস বলে। 



    সেনাক্যাম্পের কঠোর নিয়মকানুন আর উন্নত খাবারদাবার খেয়ে সব বিবাহিত সৈনিকই এই নাইটপাস চায়, সপ্তাহান্তে বউয়ের সাথে মিলিত হওয়াই থাকে উদ্দেশ্য। সে জন্য ব্যাটালিয়ন সার্জেন্ট মেজরের (বিএসএম) রুমের সামনে বুধবার থেকেই ধরনা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু বিএসএম তো আর সবাইকে প্রতি সপ্তাহে নাইটপাস দিতে পারেন না। একটা ব্যাটালিয়নে শুরু থেকে আজীবন একটা সৈনিক-সংকট থেকেই যায়। আবার সবাইকে ফাঁপরে রাখতে বিএসএম নিজেও একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখে। ফলে এই বহুকাক্সিক্ষত নাইটপাসের জন্যও কত যে ফন্দিফিকির, ধান্দাবাজি আর তেলবাজি করতে হয়, তা যারা এ বাহিনীতে চাকরি না করেছে, তারা বুঝতে পারবে না। 

    এই সবের মধ্যেও নাইটপাস মিজানের নাইট পাস চাই-ই চাই। দুনিয়া উল্টে গেলেও সে যে করেই হোক নাইট পাস নেবেই নেবে। আসার সময় বিএসএম, সিএসএম, ডিএনসিওর জন্য বাড়ির নানা রকম জিনিসপত্র নিয়ে আসবে। একসময় ক্যাম্পের সবাই বউপাগল এই সৈনিকটার নাইটপাস মেনে নিয়েছিল। ঠিক আছে, যাক বেচারা। ক্যাম্পের সবাই ওকে কেবল নাইটপাস মিজান নাম দিয়ে ক্ষান্ত ছিল। মিজানের এই নাইটপাস খ্যাতি পেতে কিন্তু মাস ছয়েকও লাগেনি। বেচারা বিয়েই করেছে সাত-আট মাস হবে। আজ সেই নাইটপাস মিজানের একটা করুণ গল্প বলব।


    আগে একবার বলেছি, মিজান বিয়ে করেছে মাস আষ্টেক হবে। আমরা কাছাকাছি ব্যাচের ছিলাম বলে আমাদের সম্পর্কটা ও জুনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুত্বপূর্ণই ছিল। ডিউটি পোস্টে ওর সাথে ডিউটি পড়লে সারাক্ষণ নতুন বউয়ের গল্প। ওর বিয়ের পর প্রথম যখন ওর সাথে ডিউটি পড়ল, তখন তো কনে দেখা থেকে বাসর রাতের ঘটনা পর্যন্ত শুনতে হয়েছে। এই করেছে, সেই করেছে, ওকে কত ভালোবাসে, কী কী করে ওর জন্য, রাগলে কেমন দেখায়, ও রাগলে ওর জন্য কী করে। নাইট পাসে ও যত দিন বউয়ের কাছে থাকে, তত দিন নাকি মিজান শত চেষ্টা করেও নিজ হাতে খেতে পারে না। ওর বউ ওকে মুখে তুলে খাওয়ায়। ওর যা যা খেতে পছন্দ, ওর বউ ও ছুটি যাওয়ার দুই দিন আগে থেকেই সেসব রান্না করা শুরু করে। মিজানের জ্যাঠাশ ভায়রাও নাকি ওকে যথেষ্ট আদর-যত্ন করে। খালি আদর-ভালোবাসার গল্প শুনতে শুনতে নিজেরও বিয়ে করার ইচ্ছে জাগে। ওস্তাদ, বিয়া কইরা ফালান, বয়স গেলে আর মজা পাইতেন না, বলে মিজান বেসুরো গলায় গাইতে শুরু করে, দিন গেলে দিন আর পাবে না, ভাটা যদি লয় যৌবন...থাকতে ক্ষুধা প্রেমসুধা পান করো রে পাগল মন...। তখন মনে মনে ভাবি, মাকে বলব মেয়ে দেখতে। সামনে একটা পে-স্কেল হওয়ার কথা।


    ফিরে আসি মিজানের গল্পে। মিজানের বাড়ি কুমিল্লায়। আমাদের ব্যাটালিয়ন চিটাগং ক্যান্টনমেন্টে। মিজানের কুমিল্লায় নাইটপাস যেতে-আসতে কোনো সমস্যাই হয় না। ওর নিজের বাড়ি দাউদকান্দিতে। আর ওর বউয়ের বড় বোনের বাসা কুমিল্লা শহরে। কিছুদিন আগে ওর বউয়ের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মিজানের ইচ্ছা ওর বউ তার বোন, বোনজামাইয়ের কাছে থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে কোনো একটা ভালো সাবজেক্টে অনার্স পড়–ক। আর সেই জন্যই ওর বউ এখন ওর ভায়রার বাসা কুমিল্লা সদরেই আছে। ফলে মিজানের জন্য আরও সুবিধা হলো। মিজান তার সব কথাই আমাকে শেয়ার করে। ওর ভায়রার কুমিল্লায় অনেক বড় কাটা কাপড়ের ব্যবসা আছে। কুমিল্লায় বাড়িও আছে তাদের। মিজানেরও ইচ্ছা ওর ভায়রার বাড়ির পাশে এক খণ্ড জমি কিনে সেখানে বাড়ি করে। সামনে বিদেশ মিশনের অপেক্ষায় আছে ও।


    একদিন সন্ধ্যাবেলা রোলকলে হঠাৎ বিএসএম বলল,
    কুমিল্লা বাড়ি কার কার?
    কয়েকজন হাত তুলল। মিজানও হাত তুলল।
    আমাদের সিও স্যারের একটা ফাইল নিয়ে ইমার্জেন্সি ভিত্তিতে সকালে কুমিল্লা যেতে হবে। যে যাবে, সে দুই দিন নাইটপাস পাবে। বলে বিএসএম একটু মুচকি হাসল। মিজান খুব উৎসাহের সাথে রাজি হয়ে গেল। বিএসএম তক্ষুনি মিজানকে দুই দিনের নাইটপাস দিয়ে দিল। কিন্তু যাওয়ার সময় দেখা গেল কোনো ফাইল নয়, আসলে ছয়টা বিশাল সাইজের কাতল মাছ। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ধরা হয়েছে। সিও স্যার সস্তায় কিনেছেন। আমরা বিএসএমএর মুচকি হাসির কারণ খুঁজে পেলাম। তার পরও মিজান তার অতি সুন্দরী আর অতি পেয়ারের বউয়ের সাথে মিলিত হবার জন্য কালোমুখ সোনামুখ করে মাছ নিয়ে রওনা দিল। দুই দিন বাদে মিজান ফিরে এল ঠিকই, কিন্তু যে মিজান গিয়েছিল, সেই মিজান ফেরেনি। সন্ধ্যায় সৈনিক মেসে আমার সাথে দেখা। দেখি ওর চোখ দুটো টকটকে লাল। চোখের নিচেও কালি। বোঝা যাচ্ছে, ঘুম হয়নি। আমি একটু খোঁচা মেরে বললাম, কীরে, ডিউটি একটু বেশি করছিস নাকি রে? মিজান কোনো জবাব না দিয়ে প্লেটের খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে যেতে যেতে বলল, আপনার সাথে আমার সেকেন্ড ডিউটি। ইউনিফর্ম পরে রোলকলে আইসেন। রোলকল হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে। আট-দশ মিনিট রোলকলের পর ক্যান্টিনে দুই-একটা সিগারেট খেয়ে আটটার সময় ডিউটি পোস্টে চলে যাব ভেবে আমি ওর কথামতো ইউনিফর্ম পরেই রোলকলে হাজির হলাম। আমি আটটা পাঁচে ডিউটি পোস্টে গিয়ে দেখি মিজান পৌঁছে গেছে। কয়েল জ্বলছে। সাথে সিগারেটের গন্ধও পেলাম। ব্যাপার কী? মিজান কি সিগারেট খাওয়া শুরু করল নাকি? আমি সিগারেট খাই বলে ও বাড়ি যাওয়ার আগেও নাক সিটকে গেল। সেই মিজান সিগারেট খাচ্ছে? বিষয়টি আমার কাছে একটু কেমন লাগল।


    কীরে নাইটপাস মিজান, তুই কি সিগারেট খাস নাকি?
    ওস্তাদ, আমারে আর নাইটপাস মিজান ডাকা লাগবে না, আমি আর কোনো দিন নাইটপাস যামু না।
    শেষ দিকে কণ্ঠটা কেমন ধরে এল। আমি চমকে গেলাম। সব সময় হাসিখুশি ছেলেটার কী হলো? নিশ্চয়ই বউয়ের সাথে মারাত্মক ঝগড়া করে এসেছে। আমি আধো আলো আধো অন্ধকারে দেখলাম মিজানের চোখ চকচক করছে। ও আনাড়ির মতো সিগারেট টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, আমার তো সব শেষ, ওস্তাদ।
    আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, কী হয়েছে মিজান, খুলে বল।
    বলতেছি, বসেন। সিগারেট খাবেন? আমার কাছে বেনসন আছে।




    আমি ওর প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট ধরিয়ে টুলে বসতে বসতে আর্মস অ্যামোনেশন চেক করে নিলাম। মিজান হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা সিগারেট ধরাল। বোতল থেকে পানি খেয়ে বলতে শুরু করল, আমি তো সিও স্যারের বাসায় মাছ পৌঁছাইয়া দিয়া একটার মধ্যে ফ্রি হইয়া গেলাম। একবার ভাবলাম, আমার ভায়রার ওখানে গিয়ে তাকে নিয়ে বাসায় যাই। পরে মনে পড়ল, আজ সোমবার, কাজের চাপ বেশি। আমি ঐশীর জন্য ওর পছন্দের অনেক কিছু কিনলাম। যখনই নাইট পাস যাই, তখনই কিনি। আমি ওকে সারপ্রাইজ দেব বলে আমার যাওয়ার খবরটা আর ফোন করে দিইনি। আমি যখন ওর বোনের বাসায় পৌঁছলাম, তখন আড়াইটার মতো বাজে। বাসায় গিয়ে আমি দেখি দরজা খোলা। পাশেই আমার ভায়রার মেয়ের স্কুল। বুঝতে পারলাম, আমার জ্যাঠাশ তার মেয়েকে আনতে স্কুলে গেছে। হয়তো দরজা কোনো কারণে খোলা আছে। আর বাসায় তো ঐশী রয়েছেই। আমি ওকে পেছন থেকে জাপটে ধরে চমকে দেব বলে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে দেখি আমরা যে রুমে থাকি ঐশী সেই রুমে ঘুমাচ্ছে। আমার মাথায় আরও দুষ্টামি চাপল। 

    আমি আস্তে আস্তে জানালার পর্দাগুলো টেনে দিলাম, রুমের দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। ঐশীর ঘুম খুব গভীর। কিন্তু হঠাৎ যখন ও টের পাবে, ভরদুপুরে ওকে কেউ আদর করছে, তখন ও কী করবে, এটা ভেবে আমার খুব উত্তেজনা হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। আমি ঐশীকে আদর করা শুরু করলাম। একসময় ও টের পেয়ে সাড়া দেওয়া শুরু করল। ঘুম আর কামমেশানো কণ্ঠে ও আমার কানে মুখ লাগিয়ে বলল, কী করছ, দাদাভাইয়া, আপু তো এখনই রাইসাকে নিয়ে চলে আসবে।

    আমি খুব অবাক হয়ে মিজানের কাছে জানতে চাইলাম, দাদাভাইয়াটা কে?

    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি প্রথমে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় ছাপা হয় ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর। পরে আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত হয়। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

    No comments