Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    জুতা চোর ।। ছোটল্প

    দুপুরে ভরপেট খেয়ে ম্যানেজারের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায় সেলিম। আস্তে করে ডেকে বলে, স্যার, আমি একটু নিচ থাইক্যা ঘুইরা আহি। 
    ম্যানেজারের ভাবটা এমন যেন শুনতেই পায়নি।
    ফলে সেলিমকে আবার বলতে হলো কথাটা।
    তোমার এত বাইরে কী? অফিসে আসলে তো তুমি পাঁচ মিনিটও থাহো না, খালি বাইরে বাইরে। ঘটনাটা কী? খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠল গোঁফওয়ালা ম্যানেজার।
    যাও, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চইলা আইসো।
    আচ্ছা স্যার।

    অলঙ্করণঃ সমকালের সৌজন্যে


    ম্যানেজার মিথ্যা বলেনি অবশ্য। অফিসে সেলিম বেশি থাকেও না। তার কাজ অফিসে নয়। সেলিমের অফিসটা প্রিন্টিংয়ের কাজ করে। অমুক কোম্পানির ব্রশিউর, তমুক কোম্পানির এমপ্লয়ির ভিজিটিং কার্ড, এই কোম্পানির হেনতেন সব ছেপে বেড়ায় ওদের অফিস। সেলিমের কাজ হলো বিভিন্ন অফিসে গিয়ে তাদের নানাভাবে পটিয়ে কাজগুলো বাগিয়ে আনা। এর বিনিময়ে মাস গেলে সেলিম চার হাজার টাকা পায়। কার্যত সেলিমের আর বেশি সময় অফিসে থাকা হয় না। সেলিম দরজা খুলে লিফটে কল দেয় নিচে যাওয়ার জন্য। নিজের দাঁত দেখার চেষ্টা করে লিফটের চকচকে দরজায়। আরও ভালোভাবে দেখা যাবে, এই আশায় লিফটের ভেতরে পা দিতে গিয়ে দেখে নয়তলার সেই ঢঙ্গি মেয়েটা। যত না রূপ, তার দশ গুণ ঠাটবাট। দেখলে গা জ্বলে। রাস্তায় নেমে সেলিম ওভারব্রিজের নিচের পান-বিড়ির দোকান থেকে এক খিলি পান আর একটা সিগারেট নিয়ে ওভারব্রিজের ওপরে উঠে যায়। সপ্তাহে যে কয় দিন ও অফিসে যাওয়ার সুযোগ পায়, সেই কয়বারই এই কাজটা করে। রাস্তায় চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে পান খায় আর নাকমুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। আর বেশি দামি গাড়ি দেখলে পিক ফেলে তার গ্লাসে। কখনো লাগে; কখনো লাগে না।



    আজ যখন পূর্ব দিকে তাকিয়ে যে সিগারেট ফুঁকছিল, তখন চোখে পড়ল সেই জুতার দোকানটা। সপ্তাহ দু-এক আগে সেলিম যে দোকানটা থেকে একজোড়া শু কিনেছিল পনেরো শ নব্বই টাকা দিয়ে। দশ দিন যেতে না যেতেই বাম জুতাটার সোল ফেটে হাঁ হয়ে গেছে। আজকাল আর পায়েই দেওয়া যায় না। অথচ অফিসের কড়া আদেশ- শু পরে আসতে হবে অফিসে। সে এক মহা প্যানা। শু পরো, ইন করো, হালকা রঙের চেক শার্ট পরো। কত ফুটানি...! আর বেতন দেয় কত? চার হাজার টাকা। ঢং দেখলে গা রি রি করে।


    তিন-চার দিন ধরে সেলিম শু ছাড়াই অফিস আসছে। গত দুই দিন কেউ তেমন কিছু বলেনি। কাল ডেপুটি ম্যানেজার বলে দিয়েছে শু ছাড়া সে যেন অফিসে না আসে, আর কোথাও না যায়।
    দোকানটা দেখে সেলিমের মনে পড়ল দুই মাস গ্যারান্টি আছে। অর্থাৎ সে এখন তার বাম পায়ের জুতাটা দেখিয়ে ফেরত দিতে পারবে। সিদ্ধান্ত নিল, কালই কাজটা করবে সে। সিগারেটের শেষাংশে পা মাড়িয়ে অফিসের উদ্দেশে পা বাড়ায় সে।
    সেলিমকে অফিসে যেতে হয় সকাল নয়টায়। ঘুম থেকে আটটায় উঠলেই হয়। বাসা থেকে অফিস পাঁচ মিনিটের পথ।


    কাল শোবার আগেই জুতাজোড়া সুন্দর করে ধুয়ে গ্যাসের চুলার ওপরে ধরে এপাশ-ওপাশ, ভেতরের অংশÑসব শুকিয়ে রেখেছে সেলিম। অফিসে যাওয়ার সময় দোকানের দেওয়া প্যাকেটে ভালোভাবে প্যাকেট করে স্লিপটা নিয়ে অফিসে যায়। আজ বাইরে তেমন কাজ নেই। সারা দিন অফিসেই থাকতে হবে ওকে। সাড়ে দশটার দিকে ডেপুটি ম্যানেজারকে বলে জুতাজোড়া নিয়ে দোকানের উদ্দেশে রওনা হয়। মনে মনে আল্লাহকে ডাকে যেন জুতাজোড়া পাল্টে দেয় ওরা। জুতার দোকানে পৌঁছার কিছু আগে টের পায়, তার ডান পকেট কাঁপছে। মোবাইলটা বের করে দেখে বাবার ফোন।
    আসসালামু আলাইকুম, আব্বা।
    কি, কেমন আছ?
    এই তো আব্বা। মা কেমন আছে?
    ভালো। বেতন পাইছস?
    হ আব্বা, ক্যান, বলেন তো?
    হালিমের এক হাজার ট্যাকার দারকার আছিল, দিতে পারবি? আমার কাছে যা আছিল, ডাক্তার দেহাইয়া সব শেষ।
    আচ্ছা, অরে আইতে কইয়েন। দিমুনে।
    আচ্ছা, রাখি তাইলে।
    হালিম সেলিমের পরের ভাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বছর ভর্তি হয়েছে।
    দোকানে ঢুকে জানতে চায় ওর জুতাজোড়া পাল্টানো যাবে কি না। সব উল্টেপাল্টে দেখে কাউন্টারের মাঝবয়সী ভদ্রলোক বলল, আগামী মাসের ১১ তারিখে আসবেন। আর সঙ্গে এই কাগজটা নিয়ে আসবেন, বলে সেলিমকে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়। কাগজটা উল্টেপাল্টে দেখে সেলিম বলে, ভাই, এক মাস লাগবে?
    বললেই তো আর হয় না, স্যার? একটা নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমাদের।
    সেলিমকে সচরাচর কেউ স্যার বলে না। ওর থেকে বেশি বয়সের এই ভদ্রলোক স্যার বলায় এক মাস দেরিকে কোনোমতে হজম করে পাঁচ টাকা দিয়ে একটা মিষ্টি পান আর একটা সিগারেট ধরিয়ে গুনগুন করতে করতে অফিসের পথ ধরে।
    অফিস শেষ করে মেসে গিয়ে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দেয় হালিম। মুখে হাসি টেনে সেলিম বলে, কহন আইছস?
    আধা ঘণ্টা হইবো।
    বয় বয়, রাইতে না থাকলেও খাইয়া যাবি কিন্তু।
    আচ্ছা।


    দিন পাঁচেক পরের কথা। অফিসে সেলিমকে বেশ ধমকাচ্ছে ম্যানেজার।
    তোমারে জিএম স্যার অন্তত পাঁচশবার কইছে না যে শু না পরে অফিসে আইসো না?
    স্যার, আমি তো আপনারে ব্যাপারটা বুঝাইয়া কইছি। কইছি না?
    তার মানে তুমি এক মাস এইভাবে অফিস করবা?
    কী করুম কন?
    আরেক জোড়া কিনো। নইলে চলবা ক্যামনে?
    মহা ঝামেলায় পড়ে গেল সেলিম। আজ ১৬ তারিখ। হাতে টাকা আছে নয় শ। মেসে বাজারের টাকা দিতে হবে। আগে কিছু দিয়েছে, আরও দিতে হবে। অফিস যেভাবে বলাবলি করছে, তাতে মনে হয়, শু-টাই এই অফিসের চাকরি করার একমাত্র যোগ্যতা। অফিস ছুটির আগে তিন দিন সময় চেয়ে নিল ম্যানেজারের কাছ থেকে। মনে মনে ভাবল, একজোড়া শু কিনেই ফেলবে। সন্ধ্যায় গেল গুলিস্তান। গুলিস্তানে চোরাই মার্কেট নামে একটা মার্কেট আছে। যেখানে অনেক চুরির আইটেম পাওয়া যায়। সে বাজারে কোনো বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে না। জ্বলে কুপিবাতি। আর জুতা যারা বিক্রি করে, তারা সব সময় হাতে ব্রাশ নিয়ে, কালি নিয়ে জুতা চকচকে করার কাজে ব্যস্ত থাকে।


    অনেক ঘুরেফিরে একজোড়া শু পছন্দ করে সেলিম। কিন্তু দাম শুনে চোখ কপালের পরিবর্তে মাথায় ওঠে। বারো শ টাকা দাম চেয়ে বসে। এক হাজার না হলে দেবেই না। সেলিম তিন শ বিশ টাকা পর্যন্ত বলে। প্রতিবার বিক্রেতা এমন একটা ভঙ্গি করে, যেন রিকশাওয়ালা গেছে বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনতে। বেশ হতাশ হয়ে ফিরে সেলিম। সময় আছে আর মাত্র দুই দিন। হালিমকে টাকাটা না দিলে কিছু একটা করা যেত। পরদিন অফিসে গিয়ে আবারও একই ঝাড়ি। দুপুরে ম্যানেজার বাইরে পাঠায়। ফিরে এসে দেখে অফিসে পিয়ন ইউনুস ছাড়া কেউ নেই। আয়েশ করে ল্যান্ড ফোনটা হাতে নিয়ে সম্ভাব্য সবার কাছে ফোন করে এক হাজার টাকার জন্য। কিন্তু দিতে পারে না কেউই। সবাই বলে, ভাই, মাসের এই সময় ট্যাকা কই পাই। 
    হাতে সময় আছে আর এক দিন।


    এই সময় কোনোভাবেই চাকরির ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। সেলিমের মায়ের প্রতি মাসে সাত-আট শ টাকার ওষুধ না খেলে বেঁচে থাকাই তার জন্য মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সে মাসে মাকে পাঁচ শ টাকা দেয়। বড় বোনের বড় মেয়ের পড়ার খরচ বাবদ পাঁচ শ টাকা ওকে দিতেই হয়। এক মাস না দিলে পরের মাস থেকে নাকি লেখাপড়া বন্ধ। তবে ওর ভাইটাকে সব সময় দিতে হয় না। এই সময় কোনোভাবে চাকরিটা চলে গেলে ওর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওর ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো। অনেক ভেবেচিন্তে একটু অন্য ধরনের সিদ্ধান্ত নেয় সেলিম।
    আজ শুক্রবার, অফিস ছুটি। সবাই মেসেই আছে।



    মোটামুটি একটার মধ্যেই মেসের সবাই বেরিয়ে গেছে জুমার উদ্দেশে। সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর টুপিটা মাথায় চাপিয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে যায় সেলিম। ঢাকার মোটামুটি একটা অভিজাত এলাকার মসজিদে নামাজের জন্য ঢোকে সে। বাংলায় বয়ান করছেন ইমাম সাহেব। বয়ানের বিষয় চুরি ও হাশরের ময়দানে তার বিচার। বয়ানে মন দিতে পারছে না সেলিম। তার খেয়াল অন্যদিকে। সে বসেছে শেষ কাতারে। জামাতের দুই রাকাত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজে নিজে মোনাজাত শেষ করে। বেরিয়ে আসে কাতার থেকে। আগে থেকে পছন্দ করা জুতাজোড়া হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। ব্যর্থ হয় সেলিম। হঠাৎ টের পায়, পেছন থেকে শক্ত হাতে কলার চেপে ধরেছে কেউ। ঘুরে তাকাতেই কান-নাক-মুখ-চোখের ওপর পড়ে কিছু কিল-ঘুষি। সবকিছু অন্ধকার লাগে সেলিমের। চোখের সামনে থেকে সরে যায় শেষ আলোটুকু। কিন্তু আঁকড়ে ধরে আছে একজোড়া কালো চামড়ার শু।
    পরের দিন শনিবার দেশের প্রথম শ্রেণির একটি দৈনিকের শেষের পাতায় একটা বক্স নিউজ নজর কাড়ে অনেকেরই। 

    নিউজটা এ রকম- গণধোলাইয়ে নিহত জুতা চোর।
    গত শুক্রবার পবিত্র জুমা নামাজ শেষে ধানমন্ডির এক মসজিদ থেকে সেলিম (২৮) নামের এক পেশাদার জুতা চোরকে হাতেনাতে আটক করে মুসল্লিরা। স্থানীয় পুলিশ জানায়, সে দীর্ঘদিন ধরেই মসজিদ থেকে জুতা চুরির পেশায় জড়িত ছিল। যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ঘটনার দিন উত্তেজিত মুসল্লিরা এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে সেলিমকে। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে তাকে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের উদ্ধার করা মানিব্যাগ থেকে প্রাপ্ত জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার নাম সেলিম বলে জানায় পুলিশ।

    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি প্রথমে দৈনিক সমকালের সাহিত্য পাতা কালের খেয়ায় ছাপা হয় ২০১৭ সালের ২৬ মে। পরে আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত হয়। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গল্পটি নিয়ে অভিনেতা নির্মাতা শহিদুল আলম সাচ্চু একটি টেলিফিল্মও নির্মাণ করেছেন, যা চ্যানেল আইতে প্রচারিত হয়েছে। টেলিফিল্মটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেতা শতাব্দী ওয়াদুদ) 

    No comments