একটু ফ্লাস ব্যাক ।। ডাইরি ।। সাগর পাহাড় জঙ্গলে
পেঁচার দ্বীপ, কক্স বাজার
১৭/০৬/২০১০
এই প্রথম আমার মনে হলো আমি মনে সত্যি সত্যি-ই আর বেশি দিন বাঁচব না। এমনটা যে আগে কখনও মনে হয়নি তা না। তবে এবার একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে। উপরে উপরে ভাব দেখাই আমি অনেক সাহসী। চে গুয়েভারা-বিপ্লবী এই সেই আসলে আমি ভিতুর ডীম। একটুতেই ভয় পেয়ে যাই। মৃত্যু চিন্তা সাহসীদের সহসা আসার কথা না। কিন্তু যেহেতু আমার আসছে সেহেতু আমি ভিতু। আমার একটু রোগ ব্যধি হলেই মনে হয় এবার আমার এই রোগটা অনেক বড় হবে, আমি এই রোগেই মারা যাব। এক বার আর্মিতে থাকতে ডান হতের কড়ে আঙ্গুলে একটা গেজ হলো। আমি মনে মনে এটাকে গেজ থেকে ঘা, ঘা থেকে পচন পচন থেকে ক্যান্সার আর ক্যান্সার থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। এক দিন আর.এম.ও (রেসিডেন্সিয়াল মেডিকেল অফিসার) ক্যাপ্টেন সবরান এক পোচে কেটে দিলেন আর তা দু’দিনেই শুকিয়ে গেলো। আমার মৃত্যু চিন্তা দূর হলো।
![]() |
Picture Credit: Mermaid Beach Resort |
এবার মৃত্যু চিন্তার কারন হচ্ছে দিন দিন আমার ওজন কমে যাচ্ছে, কিছুই খেতে পারছিনা। সেটা শুধু আমি না আমার আসপাশের সবাই খেয়াল করছে। প্রতিদিন যা খাচ্ছি তা সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। মোটামুটি বেঁচে থাকতে চাইলেও এর চেয়ে তিনগুন খেতে হয়। সাথে আরেকটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। পায়ের গোড়ালী থেকে শুরু করে শরীরের বেশীরভাগ অংশেই এক ধরনের ঘা হয়েছে যার সাদা ও লালচে পুঁজ প্রতিদিন চেপে বের করে না দিলে যন্ত্রনায় জীবন যাপন মুস্কিল হয়ে ওঠে। আবার কুচকিতে কোয়েল পাখির ডিমের মতো গজিয়েছে যা ব্যথা বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে খুব কাজ করছে। যার ব্যথা একবার উঠলে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরে। এবার বুঝুন কি যন্ত্রনার মধ্যে থাকি সারা দিন...!!!
দিন রাত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঘুম হয় সব্বোচ্চ চার ঘন্টা। রাতে আড়াইটা তিনটার আগে ঘুমাতে যাওয়ার কথা চিন্তাই করিনা কোন দিন। বিভিন্ন অ-প্রয়োজনীয় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি বেশীরভাগ সময়। সকালে উঠতে হয় পাঁচটায়। আমি যেখানে কাজ করি সেখানে কাজ করতে হলে ভোর পাঁচটায় উঠতে হয় এমন না। বরং আমি যেখানে থাকি সেই থাকার যায়গার কারনে আমাকে উঠতে হয় ভোর পাঁচটায়। আমি ঘুমাই খোলা আকাশের নীচে। মার্মেইড ইকো রিসোর্টের পাশে একটা লম্বা ধরনের জমি নেয়া হয়েছে সাগরের তীর ঘেঁসে। এটা মার্মেইড ইকো ট্যুরিজমেরই একটা সিসটার কর্নসার্ন। নাম ‘মার্মেইড মোর রিল্যাক্স’। এখানে একটা পাঁচতারকা মানের রেষ্টুরেন্ট হবে। বিচ পার্টির খুব সুন্দর ব্যবস্থা থাকবে, আর অল্প কয়েকটি কটেজ হবে। এই হলো আপাতত প্লান। আমি এখানে আমি প্রজেক্টের ম্যানেজার হিসেবে। আমাকে নিয়োগ দিয়েছে আমার এক সময়ের বন্ধু বর্তমান বস মার্মেইড ইকো ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আনিসুল হক চৌধুরী ওরফে এলিয়েন সোহাগ। এখানে এখন প্লান্টেশন থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ শুরু হয়েছে।
সে কথা অন্য আরেক সময় বলা যাবে। যেহেতু আমি খোলা আকাশের নীচে ঘুমাই তাই সমুদ্রের তীর বর্তী উদীমান সূর্যের প্রথম আলোই এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলে
‘‘ডাকে পাখি খোলো আখি
দেখ সোনালী আকাশ
বহে ভোরেরও বাতাস’’
ঘুম থেকে উঠেই যে কাজটি করি তা আমাকে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। সিগারেট নিয়ে টয়লেটে ঢুকি। টয়লেট থেকে বের হয়ে নজিরকে বলি গোসল করব। নজির টিউবলওয়েল চেপে বালতিতে পানি ভরে দেয় আমি গোসল করি, আবার ও গোসল করে আমি ওকে টিউব ওয়েল চেপে দেই। নজির তখন শুধু বালতি ভরাব কাজেই ব্যস্ত থাকে না, মুখে ফুটতে থাকে কথার খই। যার ষাট ভাগ কথাই আমি বুঝি না। আমি ওর কথা বলার এক্সপ্রেশন দেখে একটু আধটু বোঝার চেষ্ট করি। আবার আমি যা বলি তার বেশিরভাগই ও বুঝতে পারে। কিন্তু নজিরকে বলার মতো তেমন কোন গল্প আমার কাছে আপাতত নেই। আমি গায়ে সাবান মাখি আর গুন গুন করে গান গাইতে থাকি। স্নান সেরেই খেতে বসি।
অফিস আমাকে তিন বেলা খাবার দেয়, যা আমি কোন বেলাতেই খেতে পারিনা। আমি মার্মেইডে জনেয়ন করেছি এপ্রিলের এক তারিখে। দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে এই আড়াই মাসে আমি একদিনও পেট পুরে খেতে পারিনি। যা দেখ খেতে তাকে আর যাই বলুক সুখাদ্য বলে না। শাক-সব্জীর মধ্যে বড় বড় তেজপাতা, দারুচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদি দিয়ে ভরিয়ে রাখে। সামনে দেখি কত্ত সুন্দর শাক ভাজা, মুখে দিতে গেলেই মাংশের গন্ধ আসে। আবার কোন কোন দিন ক্ষুধায় অতিষ্ট হয়ে সেই খাবার-ই খেয়েছি পুরোটা। ডীম সেদ্ধ রান্না করা হলে ডীমের কুসুম ভাঙা কষ্টকর হয়ে ওঠে। সিদ্ধ করে ডীমটাকে কৃকেটের বল বানিয়ে ফেলে। এই অখ্যাদ্য যেখানে খেতে হয় প্রতিদিন সেখানে তো মৃত্যু ভয় তো হবেই।
বাবা মা জানেন আমি এখানে খুব আরামে আছি, সুখেই আছি। ঢাকার যন্ত্রনায় যখন অতিষ্ট, তখন ফোন দিয়েছিলাম আমার এক মিডিয়ার বন্ধু এক সময়ের ফারুকীর ভাইব্রাদারদের গ্রুপের অভিনেতা এলিয়েন সোহাগ কে। সে এখন এই কক্স বাজারের সবচেয়ে বড় পর্যটন ব্যবসার মালিক। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম মার্মেইড ইকো ট্যুরিজম।
- হ্যালো সোহাগ ভাই কেমন আছেন?
- ভালো কে বলছেন প্লীজ?
- সাইফুল বাতেন টিটো, ঢাকা থেকে।
- ও সাইফুল বাতেন কি খবর? কেমন আছ?
- ভালো আছি ভাই, আপনার কি খবর?
- ভালো, কি ব্যপার? এতোদিন পর?
- বস আমি আসতেছি কক্সবাজারে। আমাকে একটা চাকরী দিবেন।
- কোথায় মার্মেইডে?
- হুম।
- আস আস চইলা আস।
- থ্যাঙ্ক ইউ সোহাগ ভাই। সরি স্যার।
- যাহ ফাজিল। চইলা আস চইলা আস।
- ঠিক আসে বস দুয়েকদিনের মধ্যেই চইলা আসতেছি।
- ওকে, ওকে আস আস কথা বাড়াইয়ো না, বায়।
- ওকে ভাই বায়।
ফোন করেছিলাম মার্চের ২৬ তারিখে। বাসে চাপলাম ২৯ তারিখে সায়দাবাদ থেকে। উদ্দ্যেশ্য মার্মেইড ইকো রিসোর্ট, কক্স বাজার।
আমার ডাইরি ‘সাগর পাহাড় জঙ্গলে’ থেকে।
সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
No comments