Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    সার্ভেন্ট টয়লেট ।। হরর গল্প

    আমার বিয়ের দেড় বছর পরের কথা। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রমোশন পেয়ে আমার পোস্টিং হলো কারওয়ানার বাজার ব্রাঞ্চে। তখনো আমাদের বাসা মিরপুর। বেতন কম বলে বড় বাসা নিতে পারিনি। বিয়ের পর থেকেই সাবলেট আছি। জেসমিন প্রতিদিন বাসা ছাড়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করে। অফিস থেকে প্রমোশন লেটার এনে জেসমিনের হাতে দেওয়ার পর খুলে পড়ে বলল, এবার তাহলে বাসাটা পাল্টাই চলো।


    আমিও ভাবলাম, আর কত? বেতন কিছু বেড়েছে, ভালো পদ হয়েছে। এখন ঘরে নতুন অতিথি আসার সময়। নাহ্, বাসাটা এবার পাল্টাতেই হবে। দুই-তিন দিন ধরে আলাপ-আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, বাসা নেব রামপুরা, বনশ্রী। অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম দুটি কারণ হলো অল্প টাকায় বড় এবং ভালো বাসা আর দ্বিতীয় কারণটা হলো রামপুরা ব্রিজ থেকে মাত্র ছয়-সাত মিনিটে কারওয়ান বাজার পেট্রোবাংলার সামনে নামা যায়। ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে আমরা একটা বাসা দেখে অ্যাডভান্স করে ফিরলাম। মার্চের ১ তারিখে উঠব। ওই দিন আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। দুজনের সংসারে মালপত্র বলতে তেমন কিছুই নেই। দুটি ভ্যানে করে আমরা সবকিছু নিয়ে এসে বিকেলের দিকে বাসায় উঠে গেলাম। বেশ বড় বাসা। তিন বেড, ড্রয়িং, ডাইনিং, দুটি বাথরুম, বিশাল বড় রান্নাঘর। মাসে ভাড়া মাত্র আট হাজার টকা। মাস্টারবেডের সাথে বেশ বড়সড় ঝকঝকে-তকতকে বাথরুম দেখে জেসমিন তো খুশিতে ষোলোখানা। আমাদের অল্প কয়েকটা জিনিস পুরো ঘরে রাখতে গিয়ে দেখলাম আমরা একটা রুমই ভরতে পারছি না। জেসমিন লিস্ট করতে বসল কী কী কিনবে এ জন্য। রাতে আমরা বনশ্রীতে একটা রেস্টুরেন্টে খেলাম। আমরা বাইরে খেতে গেলে চা-কফি খাই না। জেসমিন এত ভালো বানায় যে আমি অফিসেও ওর বানানো চা ফ্লাস্কে করে নিয়ে যাই। বাসায় ফিরে কাপড়চোপড় পাল্টে জেসমিন বলল, চা খাবে, না কফি?
    তোমার যেইটা ইচ্ছা।
    আমি অফিসের দেওয়া নতুন ট্যাবে পত্রিকা পড়ছিলাম। এ সময় জেসমিনের ডাকে আমার মনোযোগ ছুটে গেল।
    এদিকে আসো তাড়াতাড়ি।
    নতুন বাসা, কোথা কিছু পড়ে গিয়েছে কি না বা ছুটে গিয়েছে কি না বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না, এই ভেবে আমি ছুটে গেলাম। আমার বউ কিচেনের দরজায় সহাস্যে দাঁড়িয়ে বলল, একটা ম্যাজিক দেখে যাও।
    কিসের ম্যাজিক?
    ভিতরে আসো।




    আমি ভেতরে গিয়ে দেখি কিচেনের যে দরজা, তার পাশে খুবই সরু একটা গলি চার-পাঁচ হাত লম্বা। গলির শেষে একটা দরজা। আগে সেখানে কয়েকটি খালি কার্টন ছিল বলে দরজাটা খেয়াল করিনি। আমি জেসমিনের সাথে রসিকতা করে বললাম, কী ওটা, গোপন কুঠরি? ধনভান্ডার নাকি?
    আরে নাহ্, মনে হয় সার্ভেন্ট টয়লেট।



    তাতে তুমি এত খুশি হচ্ছ কেন? আমরা দুজন মানুষ, তিনটা টয়লেট দিয়ে কী করব?
    না, মানে কত কম টাকায় কত্ত সুন্দর আর ফ্যাসিলিটিসহ বাসা পেয়েছি আমরা, তাই না?
    বেশ চমৎকার বাসা। আমি আর জেসমিন দুজনেই খুব খুশি। নিয়মিত পানি থাকে। এদিকটায় তেমন লোডশেডিং হয় না। এই বাসাটা পাওয়ার জন্য নিজেই নিজের প্রশংসা করছি।
    আগে খুলে দেখো, টয়লেট, বাথরুম না হয়ে অন্য কিছুও তো হতে পারে।
    তুমি এসে একটু চেষ্টা করে দেখো না, আমি কয়েকবার ট্রাই করেছি, খুলতে পারছি না।
    আমি আমার বউকে পাশ কাটিয়ে ছোট্ট ব্রাকেটের মতো হাতল ধরে টান দিলাম। খুলল না। কোথাও কোনো হুড়কো বা ছিটকিনিও নেই। মনে হলো পেরেক মেরে দরজাটা পারমানেন্টলি লাগিয়ে দিয়েছে। আমারা চা-কফি খেয়ে সেদিন ঘুমিয়ে পড়লাম।
    দিন পনেরো পরের কথা। লাঞ্চের কিছু আগে বউ ফোন করেই বলল, শোনো, খুলে ফেলেছি।
    কী খুলে ফেলেছ? হাঁপাচ্ছ কেন তুমি, জেসমিন?
    সার্ভেন্ট টয়লেট, সার্ভেন্ট টয়লেটটা খুলে ফেলেছি।
    ও, কী দেখলে?
    যা ভেবেছিলাম তাই, সার্ভেন্ট টয়লেট।
    যাক, তা কীভাবে খুললে?
    তুমি যে বলেছিলে পেরেক দিয়ে আটকানো, ওটা পেরেক দিয়েই আটকানো ছিল।
    তা তো বুঝলাম, খুললে কীভাবে, সেটা বলো।
    দারোয়ানকে ১০০ টাকা দিয়ে খুলিয়েছি।
    ওরে কৌতূহল তোমার। তা কী এমন ধনরত্ন পেলে সার্ভেন্ট টয়লেটে?
    কিছুই না, তুমি বাসায় আসবা কখন?
    কখন আর আসব, ওই পৌনে ছয়টার দিকে।
    আজ একটু আগে আগে আসতে পারবে না?
    কেন জেসমিন? কোনো সমস্যা?
    না। ঠিক আছে, রাখলাম।



    আমি চেষ্টা করলাম একটু আগে আগে বের হতে। তার পরও বাসায় পৌঁছাতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। বাসায় ঢোকার সময় দেখি আমাদের গেটে নতুন দারোয়ান বসা। সে নাকি দারোয়ানের ছোট ভাই। দারোয়ান ছুটি-টুটি গেলে ও বদলি ডিউটি করে।
    দরজা নক করার সাথে সাথেই খুলে দিল জেসমিন। মনে হলো ছিটকিনিতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি জেসমিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার মুখ একদম মরা মানুষের মতো ফ্যাকাশে। চোখমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। যে কেউ দেখলে আগেই আমার মতো জিজ্ঞেস করবে, কী হয়েছে?
    আগে জামাকাপড় পাল্টাও, হাতমুখ ধোও, তারপর বলছি।



    কিন্তু আমি জামা-প্যান্ট পাল্টাতে পাল্টাতেই জেসমিন বলা শুরু করল, শোনো কী হয়েছে, তুমি যাওয়ার পর আমি উঠে থালাবাসন ধুইলাম, কিছু সময় টিভি দেখলাম। কিচেনে গিয়ে দরজাটার দিকে তাকিয়ে আমার মনের মধ্যে আবার কৌতূহল চাপল। আমি আবার হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার টান দিলাম, ধাক্কা দিলাম। বঁটি নিয়ে এসে ফাঁকা দিয়ে ঢুকিয়ে চাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করতেই খুট করে বঁটির মাথা ভেঙে গেল। আমি বিরক্ত হয়ে ক্ষান্ত দিলাম। ঠিক এ সময় শুনলাম ভেতরে কিসের যেন একটা শব্দ হলো। আমি একটু চমকে গেলাম। আমার মাথায় আরও কৌতূহল চেপে বসল। আমি ইন্টারকমে দারোয়ানকে আসতে বললাম। বললাম, দরজাটা খুলতে চাই। ও কতক্ষণ চেষ্টা করে বঁটির মাথা আরেকটু ভাঙল। শেষে দেখল, দরজার পাশ দিয়ে দরজার ফ্রেমের সাথে আড়াআড়িভাবে চারটা পেরেক মারা। ও আমাকে বলল মোড়ের মাথা থেকে কাঠমিস্ত্রির শাবল এনে খুলতে পারবে। আমি ওকে এক শ টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম। ও শাবল নিয়ে এসে একটু চাড়ি দিতেই পেরেকগুলো আলগা হয়ে এল। এরপর পেরেকগুলো তুলে ও হাতল ধরে দরজায় টান দিল। কিন্তু দরজা খুলল না। অথচ আর কোথাও কোনো পেরেক নেই, তা খুঁজে-টুজে দেখেছে। 




    আমিও টান দিলাম। মনে হলো দরজাটা ভেতর থেকে কেউ টেনে ধরেছে। বাইরে থেকে টান দিলে একটু স্প্রিং ভাব আসে। ও আমাকে বলল, ভাবি, আপনি সরে যান। মনে হয় ভেতর থেকে রশি বা কিছু দিয়ে টানা দিয়ে রেখেছে। আমি পা বাজাইয়া টান দেই। আমি সরে যাওয়ার পর ও দুই হাত দিয়ে হাতল ধরে দেয়ালে পা লাগিয়ে টান দিতেই ঝট করে খুলে গেল দরজাটা। ভেতর থেকে একটা হিম বাতাস তীব্র বেগে বেরিয়ে এল। পাশ থেকে কোনো মানুষ চলে গেলে যে রকম বাতাস হয়, সেই রকম বাতাস, কিন্তু অনেক জোরে। এতই জোরে যে সেই বাতাসের বেগে দারোয়ান ফ্লোরে পড়ে গেল। আমি ভেতরে তাকিয়ে দেখি, খুবই কম আলোয় একটা লো প্যানের নোংরা টয়লেট। পাশে একটা বদনা আর একটা পুরোনো ব্রাশ। কিন্তু কোনো ভেন্টিলেশন সিস্টেম নেই। কোনো লাইট নেই। টয়লেটটা বেশ লম্বা। মধ্যে অন্ধকার। কেমন একটা ইঁদুর-পচা গন্ধ আসছিল টয়লেটটা থেকে। আমি একটা লাইট এনে দারোয়ানকে লাগাতে বললাম। ও লাইট লাগিয়ে সুইচ দিতেই জ্বলে উঠল লাইট। পরিষ্কার হয়ে গেল বাথরুমের ভেতরটা। কিন্তু মিনিটখানেক পরই দুই-তিনবার ফ্লিক করে লাইটটা নিভে গেল। দারোয়ান চেক করে দেখল, কেটে গেছে। আমি ওকে আবার একটা লাইট এনে দিলাম। আবারও একই ঘটনা ঘটল। একসময় টের পেলাম, গন্ধটা ক্রমশ বাড়ছে। দারোয়ানকে বললাম দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে কার্টনগুলো আগের মতো সামনে টেনে দিতে, তাতে যদি গন্ধটা কমে। দারোয়ান চলে যাওয়ার পর আমি রান্নার কাজে মন দিলাম। কিন্তু আমার হঠাৎ মনে হলো, এই বাসায় আমি ছাড়া মনে হয় আরও কেউ একজন আছে।


    এ পর্যন্ত বলে জেসমিন একটু থামল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি, জেসমিন? 
    আমি খুবই আশ্চর্য হলাম ওর এমন কথা শুনে।
    কেন তোমার এমন মনে হলো বলো তো?
    আমি আসলে তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না বিষয়টা। কেমন একটা অস্বস্তিকর ফিলিং। মনে হচ্ছে কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
    কী বলছ এসব?
    হ্যাঁ। আমি তোমাকে বানিয়ে বলতে যাব কোন দুঃখে? তারপর কী হয়েছে শোনো। বিকেল থেকে দারোয়ানের ডায়রিয়া শুরু হয়েছে। অবস্থা খুবই খারাপ। আইসিডিডিআরবিতে নিয়ে গেছে বাড়িওয়ালার ভাইপো পাভেল।
    বলো কী!
    হ্যাঁ।
    চলো তো বাথরুমটা গিয়ে দেখি।



    গিয়ে দেখি দরজার সামনে আবার সেই কার্টনগুলো রাখা। আমি সব সরিয়ে হাতল ধরে টান দিতেই দরজাটা খুলে গেল। একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ এসে লাগল নাকে। কোনো প্রাণী মরে পচে যাওয়ার পর রোদে শুকালে যেরকম একটা কড়া পচা গন্ধ আসে, সেরকম। ভেতরটা এখন পুরোপুরি অন্ধকার। আমি আমার মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ভেতরে মারলাম। ও যেমন বলেছে, তেমনই। আমি ভেতরে ঢুকতে যাব, এমন সময় বন্ধ হয়ে গেল মোবাইলের লাইটটা। আবার চেষ্টা করলাম জ্বালাতে। টর্চের সুইচ অন দেখাচ্ছে কিন্তু জ্বলছে না। তারপরও আমি বাথরুমটার মধ্যে ঢুকলাম। আমার কাছে তেমন কিছু মনে হলো না। আমি বেরিয়ে এসে দরজাটা বাইরে থেকে হুড়কো লাগিয়ে সামনে কার্টনগুলো টেনে দিলাম। সন্ধ্যায় আমরা একত্রে চা-বিস্কুট খেলাম। রাতে আমরা দুজন বসে টিভি দেখছি। আমি রিমোট হাতে চ্যানেল পাল্টে চলেছি। একসময় ব্লাঙ্ক স্ক্রিন চলে এল। কোনো শব্দ আসছে না। ঠিক এমন সময় শুনলাম কিচেনে পানি ফোটার শব্দ। আমি চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে জেসমিনকে বললাম, পানি কতক্ষণ আগে গিয়েছ? হয়নি? হয়ে গেলে চুলাটা নিভিয়ে দাও।
    পানি গরম দিয়েছি তোমাকে কে বলল?
    চুলায় পানি ফোটার শব্দ হচ্ছে যে!
    কোথায়? কই? 
    আমি টিভির সাউন্ড মিউট করে ওকে বললাম, শোনো।



    এবার জেসমিন আর আমি দুজনেই শুনলাম পানির বলক ওঠার শব্দ। জেসমিন শব্দ শুনে বলল, তাই তো। বলে ও খাট থেকে নামল। আমিও ওর পেছন পেছন গেলাম। কিচেনে যাওয়ার সময়ও আমরা শব্দ শুনতে পেলাম। আরও স্পষ্ট। পানি যদি অনেক বেশি ফুটে যায়, তখন যে বলকের দমকে পানি চুলায় খানিকটা পড়ে ফচফচ শব্দ হয়, আমরা সেটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু কিচেনে গিয়ে আমরা দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেলাম। কোথাও কিছু নেই, কোনো শব্দ নেই। আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। দুজনেই কি তবে ভুল শুনেছি? তা কী করে সম্ভব? আমরা ফিরে এসে আবার টিভি দেখতে বসলাম। কিন্তু কান রইল কিচেনের দিকে। কিন্তু যতক্ষণ জেগে ছিলাম, ওই রাতে আর কোনো পানি ফোটার শব্দ পাইনি। পরের দিন সকাল থেকে শুরু হলো এক ভয়াবহ উৎপাত। সকালবেলা নাশতার টেবিলেই আমরা সার্ভেন্ট টয়লেটের সেই পচা গন্ধ পেতে শুরু করলাম। কোনো মৃতদেহ পচা গন্ধ ঠিকই কিন্তু এটা একটু অন্য রকম। বেলা বাড়ার সাথে সাথে গন্ধ আরও বাড়তে থাকল। আমি অফিসে চলে যাওয়ার পর গন্ধ এত বেশি বাড়ল যে আমার স্ত্রী বাসায় তালা দিয়ে তার বান্ধবীর বাসায় গিয়ে বসে ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে বাসায় এসে দুজন মিলে একত্রে ঢুকলাম। আশ্চর্য, কোনো গন্ধ তো নেই-ই, বরং কী একটা সুগন্ধ বিরাজ করছে ঘরজুড়ে। তবে সুগন্ধি ব্যাপারটাও আমাদের কাছে ভালো লাগেনি।



    রাতে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, সামনের মাসেই এ বাসা পাল্টাব। এখানে অস্বাভাবিক কিছু রয়েছে, যা আমাদের চিন্তার বাইরে। আমি নিজে ভূত-প্রেতে বিশ্বাসও করি না আবার অবিশ্বাসও করি না। বিশ্বাস করি না, কারণ নিজের চোখে কোনো দিন কিছু দেখিনি। আর অবিশ্বাস করি না, কারণ এত লোকে যে বলে, তারা কি কোনো প্রকার কারণ ছাড়া বলে? রাতে আমরা খাবারদাবার খেয়ে যখন টিভি দেখতে বসলাম, তখন আবার গত রাতের মতো পানি ফোটার শব্দ আসতে লাগল। এবার আমার আর জেসমিনের সত্যিই ভয় লাগা শুরু করল। আমি উঠে কিচেনে দিকে পা বাড়ালে জেসমিন আমার টি-শার্ট খামচে ধরে বলল, আমি একা থাকতে পারব না। অগত্যা দুজন মিলেই গেলাম। গিয়ে দেখি আবারও সেই একই দৃশ্য, কোথাও কিছু নেই। নেই কোনো শব্দ। আমরা আবার টিভি দেখা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হলো। খুব অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন, পানি ফোটার শব্দও যে অত জোরে হতে পারে, তা আপনি ভাবতেও পারবেন না। ধীরে ধীরে শব্দ বাড়তে থাকল তো বাড়তেই থাকল। একসময় অসহ্য হয়ে উঠল সে শব্দ। আমাদের প্রচণ্ড ভয় লাগা শুরু করলে আমরা আমাদের রুমের দরজা লাগিয়ে দিলাম। জেসমিন প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। ভয় আমারও করছে। কিন্তু আমি ভয় প্রকাশ করলে জেসমিন আরও ভয় পেয়ে যাবে বলে আমি আমার ভয়কে চেপে রাখার চেষ্টা করছি। আস্তে আস্তে একসময় শব্দ একেবারে থেমে গেল। ঘরের অবস্থা স্বাভাবিক। একসময় আমরা শুয়ে পড়লাম। যত ভয়ই থাকুক আর যা-ই থাকুক, সারা দিন পরিশ্রম করে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেওয়ার পর ঘুম চলে আসে। আমি অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। জেসমিন কখন ঘুমিয়েছে জানি না। হঠাৎ জেসমিনের ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল। আমি উঠে বসলাম। হতভম্ব জেসমিন বলল, তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ?
    কই, না তো।
    একটু খেয়াল করে শোনার চেষ্টা করো।
    কী হয়েছে, বলো? বললেই তো হয়।
    তুমি শুনছ কি না, তা-ই বলো।



    আমি কান পেতে শুনলাম, আমাদের রুমের বাইরে থেকে একটা ক্ষীণ কান্নার শব্দ আসতে লাগল। একটা শিশুর কান্না। শুনলে মনে হয় শিশুটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। একবার মনে হলো আমাদের রুমের সামনে, একবার মনে হলো কিচেনে। আবার মনে হলো অন্য কোথাও। বিষয়টা কী, দেখার জন্য আমি রুমের বাইরে যেতে চাইলাম। জেসমিন আমাকে কিছুতেই যেতে দেবে না। মোবাইলে দেখলাম রাত তিনটা উনিশ। দিনের আলো ফুটতে এখনো বেশ দেরি। এরকম হলে এই বাসায় আর থাকাই যাবে না। ওটা আমাদের কোনো ক্ষতি না করুক কিন্তু আমরা তো মানুষ। আমাদের মস্তিষ্ক এসব নেওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত নয়। নিজেদের অজান্তেই দুজন দুজনকে জড়িয়ে আমরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাইনি। ঘুম ভেঙে দেখি পুরো পরিস্থিতি একদমই স্বাভাবিক। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিকঠাক। দেখলাম সাড়ে দশটা বাজে। আমার অফিস থেকে চৌত্রিশবার কল করেছেন জিএম স্যার। আমি কলব্যাক করে স্যারকে সব খুলে বললাম। স্যার শুনে খুবই আশ্চর্য হলেন। বললেন বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলতে। এগারোটার দিকে আমি গেলাম বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করতে।



    বাড়িওয়ালা থাকে দোতলায়। বাসার সামনে কলাপসিবল গেট দেওয়া, তারপর মোটা পুরু কাঠের দরজা। সেই দরজায় দুই ধরনের লক, দুটি হুড়কো, কী আছে বাড়িতে? তাদের আচার-আচরণ খুবই রহস্যময় মনে হলো। বাসায় কোনো পুরুষ মানুষ নেই। আমরা কলিং বেল দেওয়ার অনেক পর ভেতর থেকে জানতে চাইল আমরা কারা। পরিচয় দেওয়ার পর ২৩-২৪ বছর বয়সের কাজের মেয়ে উঁকি দিল দরজার ফাঁক দিয়ে। দরজার সাথে একটা শিকলের মতো ঝুলে আছে মেয়েটির মাথা বরাবর। কী বলবেন বলেন। মেয়েটা ওই ফাঁকা জায়গাটুকু থেকেই বলল।
    বাসায় কেউ নেই? জানতে চাইলাম আমি। মেয়েটা খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলল, খালুজান তো বাসায় নাই।
    কখন আসবে?
    সে তো দেশের বাইরে।
    আর কেউ নেই?
    খালাম্মা আছে, সে অসুস্থ।
    আর কেউ নেই।
    না।
    কিন্তু একটু জরুরি কথা ছিল যে।
    কী কথা, আমারে কন।
    তোমাকে বলা গেলে তো বলতামই। অনেক কথা। খালুকে বা খালাকে বলতে হবে। তাদের ছেলেমেয়েরা হলেও চলবে।
    তার এক ছেলে অস্টুলিয়া তাহে, আর মেয়ে অসুস্থ।
    খালাও অসুস্থ?
    জে।
    এ সময় হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা মেয়ের আর্তনাদ আমাদের কানে এল।
    তাহলে কথা বললে কি তোমার সাথেই বলতে হবে?
    হ। আপনেগো বাসায় কোনো সমস্যা হইলে খালাম্মায় আগামী মাসে বাসা ছাইড়া যাইতে কইছে।
    তাই নাকি?
    হ।
    খালাম্মার সাথে একটু কথা বলা যাবে না?
    আচ্ছা, খাড়ান দেহি।
    মেয়েটি চলে যাওয়ার পর আমরা একে অপরের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলাম। আবার হঠাৎ শুনলাম একটা মেয়েকণ্ঠ প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বলছে, তালা খুলে দে, নইলে এখনই গায়ে আগুন ধরিয়ে দেব।
    অল্প সময় পরই মেয়েটি ফিরে এসে জানাল, আফনাগো কাইলকা আইতে কইছে। খালাম্মার গায়ে জ্বর ১০২।



    আমরা বাসায় ফিরে এলাম। বাসা একদম ঠিকঠাক। কোথাও কোনো সমস্যা নেই, নেই কোনো দুর্গন্ধ। আজ যেহেতু আমি আর অফিসে যাব না, জেসমিন চেষ্টা করছে ভালো-মন্দ কিছু রান্না করার। রেজালা আর পোলাও আমার খুব পছন্দ।


    আমরা আড়াইটার দিকে খেতে বসলাম। জেসমিনের রান্না অত্যন্ত চমৎকার। প্রথমে আমি বেগুনভাজা দিয়ে কয়েক লোকমা খাওয়ার পর জেসমিন আমার প্লেটে রেজালা তুলে দিল। সুন্দর গন্ধে আমার ক্ষুধা আরও বেড়ে গেল। আমি ঝোল দিয়ে খেয়ে মাংসসহ এক লোকমা ভাত মুখে দেওয়ার সাথে সাথে হড়হড় করে বমি করে দিলাম। জেসমিনও বমি করে দিল। মাংসের টুকরা থেকে ইঁদুর পচা গন্ধ আসছে। আমরা দুজনেই ভীষণ ভড়কে গেলাম। খাবার টেবিলে ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম আমি। জেসমিনের বমি থামছেই না। বিকাল চারটা পর্যন্ত জেসমিন নয়বার বমি করার পর আমি আমার ডাক্তার বন্ধু আরিফকে ফোন করলাম। ও যা বলল, তাতে খুশিই হলাম। জানাল, নতুন গাড়ি কিনেছে, আমাদের অসুবিধা না থাকলে বাসায় আসতে চায়। এমন সময় যদি ডাক্তার বন্ধু বাসায় আসতে চায়, তাহলে কি কেউ আর না করে? সাড়ে ছয়টার দিকে আরিফ তার রিকন্ডিশন টয়োটা এক্স কারিনা থেকে নেমে আমাকে ফোন দিল। আমি তিনতলায় উঠে আসতে বললাম। আরিফ এসে জেসমিনের পালস, ব্লাডপ্রেশার ইত্যাদি চেক করে বলল শরীর দুর্বল। এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা নেই। এখুনি কিছু খাওয়াতে হবে। আমি পুরো সমস্যাটা ওকে বললাম। ও শুনে তেমন গা করল না। নানা সাইকোলজিক্যাল-বায়োলজিক্যাল যুক্তিটুক্তি দেখাল। শেষে জেসমিনকে ওষুধ কোম্পানির ফ্রি দুটো বমির ট্যাবলেট দিয়ে যেতে উদ্যত হচ্ছিল, তখন ওকে সব খুলে বললাম। সার্ভেন্ট টয়লেটের দরজা খোলা থেকে আজ পর্যন্ত। এসবের অনেক কিছুর সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা না দিতে পেরে শেষমেশ বলল, আমি তোর ওই টয়লেটটা দেখতে চাই।



    জেসমিনের দুর্বল নিষেধ থাকা সত্ত্বেও আমি আরিফকে নিয়ে কিচেনের দিকে রওনা হলাম। টয়লেটের দরজার সামনে থেকে খালি কার্টনগুলো সরিয়ে টয়লেটের দরজার হুড়কো খুলে হাতল ধরে টান দিতেই দরজা খুলে গেল। সাথে সাথে আমরা নাক চেপে ধরলাম। তীব্র মাংস পচা গন্ধ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল কিচেনে। আরিফ নাকচাপা অবস্থায়ই বলল, এই দুর্গন্ধ এখানে এল কোত্থেকে?
    আমি কী করে বলব? এটা কিসের দুর্গন্ধ?
    তুই চিনিস না এই গন্ধ? আরিফ জানতে চাইল আমার কাছে।
    ইঁদুর-বিড়াল পচা গন্ধ ছাড়া আর কী?
    আরিফ নাক চেপে ধরে আমাকে ড্রয়িংরুমে যাওয়ার জন্য টান দিল। আমি টয়লেটের দরজাটা লাগিয়ে ওর পেছন পেছন এসে যা শুনলাম, তা ভয়ংকর। আমরা বুঝতে পারছিলাম না যে কত বড় ভয়ংকর বাস্তবতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি নাক থেকে হাত সরিয়ে টের পেলাম, গন্ধ আমার সারা ঘরে ছড়িয়েছে। আরিফ আমাকে ড্রয়িংরুম থেকে টেনে পাশের রুমে নিয়ে বলল, দরজাটা লাগা।
    কেন? আমি বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম।
    আগে লাগা, তারপর বলছি। আমি দরজা লাগিয়ে ওর কাছে যেতেই ও গলা খাদে নামিয়ে বলল, তুই কি এই গন্ধ সত্যিই চিনিস না, নাসির?
    চিনি মানে প্রাণী পচা গন্ধ, এ ছাড়া আর কী?
    প্রাণী পচা তো ঠিক আছে। কিন্তু কোন প্রাণী, সেটা বুঝতে পারছিস?
    নাহ্।
    আরে বলদ, এটা মানুষ পচা গন্ধ। 



    আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য জাস্ট জমে গেলাম ওর কথা শুনে। সংবিৎ ফিরে পেয়ে বুঝতে পেলাম, আমার জিব ভারী হয়ে গেছে। আমি আরিফকে কী বলব, বুঝতে পারছি না। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কারো লাশ লুকানো আছে ওই টয়লেটে।
    কীক-কী-কী বলছিস তুই, আরিফ। লাশ আসবে কোত্থেকে? তোকে তো বললামই যে ওটা পেরেক দিয়ে আটকানো ছিল। তারপর থেকে তো আমরাই ছিলাম বাসায়। লাশ আসবে কোত্থেকে?
    সে তুই যা-ই বলিস। এটা মানুষের পচা গন্ধ, সে ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত, নাসির। ভুলে যাসনে আমি একজন এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার, এখন সার্জারিতে পড়ছি। আমি মানুষের মাংস পচা গন্ধ চিনব না?
    আরিফের কথার দৃঢ়তা আমাকে আরও বিচলিত করে দিল। 



    দেখ দোস্ত, আমি তোকে মিথ্যে বলব কেন বা তোকে ভয় দেখিয়ে আমার লাভ কী? ভাবির সমস্যা আমি বুঝতে পেরেছি। খাওয়ার সময় হঠাৎ বাতাসে বাথরুমের দরজা খুলে গিয়ে থাকতে পারে। খাওয়ার মধ্যে হঠাৎ ওই বাতাস এসে তোদের নাকে লেগেছে। তোদের মাথা-শরীর সেটাকে খুব বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করে রিফিউজ করেছে। ভূত-ফুত কিচ্ছু না। অন্য কেউ হলে বলতাম পুলিশে খবর দে। তুই বন্ধু, তাই তোকে এমন পরামর্শ দিচ্ছি না। এখানে খুন বা অপঘাতে মৃত্যু ও লাশ গুম করার ঘটনা ঘটেছে। এ গন্ধ সেই লাশের, যার সাথে হয়তো বাড়িওয়ালার লোকজন জড়িত। এই জন্যই তারা তোদের এড়িয়ে গেছে, আমি বুঝতে পারছি।
    বিষয়টি ঘটলেও ঘটতে পারে। ঢাকা শহরে অনেক লোকের বাস। হাজার হাজার বিল্ডিং, লাখ লাখ ফ্ল্যাট। কোন ফ্ল্যাটে কী ঘটে, তা কী করে বলব? মিডিয়ার কল্যাণে যা সামনে আসে, আমরা সেটুকু দেখি। এর বাইরেও যে অনেক অজানা ঘটনা থাকে, তা হয়তো এই বাসাটা ভাড়া না নিলে জানতে পারতাম না। আমি ছাপোষা মানুষ। বলতে গেলে দিন আনি দিন খাই। এক মাস চাকরি না থাকলে আমার বাসাভাড়া, খাওয়ার খরচ চালানোর জন্য কোনো ব্যাকআপ নেই। আমি মানে মানে বাঁচতে পারলে হয়।



    আরিফ চলে যাওয়ার পর আমরা বাইরে খেতে গেলাম। বাসায় ফিরতে সত্যি ভয় লাগছে। আরিফ যা বলেছে, যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা খুন কেসে ফেঁসে যেতে পারি। কিন্তু এই ভৌতিক ঘটনার আমি কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। রাতে আমরা বাসায় ফিরে ভাবলাম, আজ ঘরের সব লাইট জ্বালিয়ে রাখব। জেসমিন বেশি ভয় পাচ্ছে। ওর মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে দরজাটা খুলিয়েছিল বলে। সবচেয়ে খারাপ সংবাদ হলো, যে দরজা খুলেছিল, সে দারোয়ান বজলুর অবস্থা খুবই খারাপ। আইসিডিডিআরবিতে তার অবস্থার কোনোই উন্নতি হয়নি। সে কিছুই খেতে পারছেন না। সবকিছুতে নাকি পচা মাংসের গন্ধ পায়। গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে রক্তবমি।



    বাসায় ঢুকে দেখি সবকিছুই ঠিক আছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। আমরা কিছু সময় টিভি দেখে বারান্দায় গিয়ে কফি নিয়ে বসলাম। আমরা কোথায় কেমন বাসা নিতে পারি, সেসব নিয়ে কথা বলছিলাম। এমন সময় শুনলাম আবার সেই পানি ফোটার শব্দ। আমি উঠতে চাইলে জেসমিন আমার হাত ধরে বলল, যা হয় হোক, তুমি এখানে বসে থাকো।


    যা ঘটার তা এখন কিচেনেই ঘটছে, আমাদের বারান্দা থেকে কিচেন খুব দূরে নয়। একসময় গতকালের মতো শব্দ বাড়তে থাকল। আবার আগের দিনের মতো একসময় শব্দ থেমেও গেল। আমরা শোয়ার আয়োজন করছি, এমন সময় মনে হলো একটু পানি খেয়ে শুই। আমি ডাইনিংরুমে এলাম পানি খেতে। সেখানে ঢোকার সাথে সাথেই আমার নাকে এসে লাগল সেই পচা গন্ধ। আমি বেশ ভড়কে গেলাম। কারণ, জেসমিন যে আমাকে বলেছিল, মনে হচ্ছে আমার দিকে কেউ চেয়ে আছে, ঠিক ওই মুহূর্তে আমার ঠিক ওরকম একটা ফিল হতে শুরু করল। আমি আর পানি খেতে পারলাম না। আমার বেশ ভয় করতে শুরু করল। মনে হলো খুব অশুভ কিছু একটা আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা অস্বস্তি আমি তা বোঝাতে পারব না। আমি রুমে ফিরে যাওয়ার জন্য যেই টার্ন করলাম, আমার দৃষ্টি আটকে গেল কিচেনের দরজায়। আমি আমার নিজের চোখে যা দেখলাম, তা মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমার মনে থাকবে। আমি কেন, পৃথিবীর কোনো মানুষের পক্ষেই ওই দৃশ্য দেখে আর সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। আমিও ছিলাম না। সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম। আমি দেখলাম চার-পাঁচ বছরের একটি শিশু সেখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু শিশুটির চোখে কোনো পাতা নেই। সারা শরীরে দগদগে ঘা। খণ্ড খণ্ড মাংস খসে পড়ে গিয়ে সেখান থেকে সাদা সাদা পুঁজ পড়ছে। মাথাও খাবলা খাবলা মাংস ওঠানো। আমি দেখে চার-পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলাম। এরপর শুধু একবার এই যাহ্ বলতে পেরেছিলাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।



    পরদিন খুব ভোরে আমি দেখলাম জেসমিন আমার পাশে আমার মতো পড়ে আছে। আমি ওকে জাগালাম। ও জেগেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। কী এক আতঙ্ক ওর চোখেমুখে। আমার সামনে আয়না নেই বলে বুঝতে পারছি না যে আমার অবস্থা কী। ও তোতলাতে তোতলাতে বলল, ওট-ওট-ওটা চলে গেছে?
    আমি বুঝতে পারলাম ও কিসের কথা বলছে। আমি বললাম, হ্যাঁ। চলো আমরা এখুনি বাসা ছেড়ে চলে যাই। মালপত্র পরে নেব।
    কোথায় যাবে? কারও সাথে কথা বলেছ?
    কথা বলার দরকার নেই। আগে চলো বাসা থেকে বের হই।
    আমরা বাসা থেকে বেরিয়ে প্রথমেই ফোন দিলাম আমার বাল্যবন্ধু ড. আরিফকে। আমি সংক্ষেপে রাতের ঘটনা বললাম। ও তক্ষুনি আমাকে ওর বাসায় যেতে বলল। আমরা বনশ্রী থেকে দিলু রোডের রিকশা ঠিক করলাম। জেসমিনের চোখেমুখে এখনো ভয়ের ছাপ। আরিফের বাসায় গিয়ে আমরা সবাইকে রাতের ঘটনা বললাম। আরিফের শালা ওর বাসায় বেড়াতে এসেছে। সে আমাকে বলল, আপনার অসুবিধা না থাকলে আমি বিষয়টি পুরোপুরি জানতে চাই। 
    আমি একনিশ্বাসে তাকে শুরু থেকে বলে গেলাম। সব শুনে শুধু বলল, অন ন্যাচারাল ডেথ। সম্ভবত মার্ডার।
    মাই গড! বলেন কী? আরিফও বলেছিল কাল।
    তাই নাকি? দুলাভাই তো এসব বিলিভ করেন না।
    বিলিভ করে না, তা আমিও জানি। ও আমাকে শুধু গন্ধ পেয়ে বলেছিল যে এটা মানুষ পচা গন্ধ।
    আপনার আপত্তি না থাকলে আমি বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চাই।
    তাই নাকি? আপনি কি ওঝা নাকি? 


    আমার কেমন যেন একটু লাগল। আধুনিক ছেলে। ল্যাপটপ নিয়ে নেট ব্রাউজ করছে। বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোটই হবে। এই ছেলে ভূত-প্রেত নিয়ে কিসের চর্চা করে?
    ওঝা না। ও যদি চায়, তাহলে তুই ওকে নিয়ে যা। ও এসব একটু চর্চাটর্চা করে। ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল আরিফ। আরিফের শালার নাম সায়মন। বয়স ত্রিশ-বত্রিশের বেশি হবে বলে মনে হয় না। এত দিন লন্ডনে ছিল শুনেছি। সেখানে পড়াশোনা করেছে। দেখতে সাধারণ একটা ছেলে। বলে কিনা ভূত-টুত নিয়ে চর্চা করে। আমি অনেক ভয় পেলেও কৌতূহল তো আর দমে যায়নি। বিষয়টি কী, তা জানার জন্য আমারও মন আঁকুপাঁকু করছিল। জেসমিন এখন আরিফের দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। আজ আমার ছুটি। পড়াশোনা শেষ করেই তো চাকরিতে ঢুকলাম। অ্যাডভেঞ্চার করার সুযোগ আর পেলাম কই? এই ফাঁকে যদি একটু অ্যাডভেঞ্চার হয়, মন্দ কী? আমি বললাম, ঠিক আছে, চলেন। 
    সায়মন একটা ব্যাগ নিয়ে আমার সাথে বাসায় এল। বাসায় ঢুকেই প্রথমে ও যেটা বলল তা হলো, ও মাই গড! ভেরি পাওয়ারফুল অ্যান্ড ব্যাড সোল।



    সায়মন তার ব্যাগ খুলে কয়েকটা যন্ত্রপাতি বের করে সেট করল। তারপর বলল, চলেন সার্ভেন্ট টয়লেটটা আগে একটু দেখি। টয়লেটের সামনে গিয়ে ও নিজেই দরজা খুলল। খোলার সাথে সাথে সেই ভোঁটকা গন্ধটা আবার ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। আমরা দুজনেই নাক চেপে ধরলাম। সায়মন ওর পকেট থেকে ছোট্ট একটা টর্চ বের করল, যার আলো সবুজ। লাইটটা টয়লেটে মারতে যাবে, এমন সময় আমি বললাম, লাভ নেই, কেটে যাবে।
    এ লাইট কাটবে না, চিন্তা করবেন না। 
    লাইটটা বাথরুমে মারার আগে আরও একবার চেক করে নিল সায়মন। তারপর বাথরুমে লাইট মেরে বলল, এদিকে আসুন, দেখে যান। 
    আমি নাক চেপে ধরে গিয়ে দেখলাম, ওর লাইটের আলো যে স্থানে পড়েছে, সেখানে ছোট ছোট হাত-পায়ের দাগ। দেখলে মনে হয় ছোপ ছোপ রক্ত!
    এটা কি এর আগে আপনারা দেখেছেন?
    না।
    এটা একটা স্পেশাল রে-লাইট। এটার আলোয় অনেক কিছু দেখা যায়, যা খালি চোখে দেখা যায় না। চলুন। 




    আমরা দুজন ড্রয়িংরুমে আমাদের নতুন কেনা সোফায় বসলাম।
    আপনি বসুন। আমি আপনার জন্য চা বানিয়ে আনছি।
    তাহলে খুব ভালো হয়। সরলভাবে হাসিমুখে বলল সায়মন। আমি চা করে এনে দেখি সায়মন তার ল্যাপটপ অন করে ছোট ছোট মাইক্রোফোনের মতো বেশ কয়েকটি যন্ত্র বের করে কী যেন করতে লাগল। ম্যাচের মতো সাইজের একটা ক্যামেরা দেখতে পেলাম। ইলেকট্রনিকস যন্ত্র সারাইয়ের দোকানে যেরকম মিটার, সেরকম একটা মিটারও রয়েছে দেখলাম, তবে সায়মনেরটা অনেক আধুনিক। মনিটরটা স্মার্টফোনের মনিটরের মতো দেখতে।
    এসব দিয়ে কি আত্মা ধরবেন নাকি? আমি খানিকটা কৌতুক মাখিয়েই প্রশ্নটা করলাম।
    ঠিক তা নয়। 
    চায়ের কাপ নামাতে নামাতে বলল সায়মন। ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসি দেখে বুঝলাম, আমার কথায় রাগ করেনি। 
    আমি আসলে একটা সংকেত বা কোড ধরার চেষ্টা করি।
    মানে?
    মানে হলো, আমি একটা কোড জানি, যেটা ওদের সাথে লিঙ্ক করতে আমাকে হেল্প করে। মানে বলতে পারেন, ওদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।
    সেটা কী করে?



    এই যে এত সব যন্ত্রপাতি দেখছেন, এর সাহায্যে আমি একধরনের সিগন্যাল রিড করব। ওই সিগন্যালটাকে যদি কোডে রূপান্তর করতে পারি, দেন, চেষ্টা করব কোডটা ভাঙাতে।
    ও আচ্ছা। আমি মুখে ও আচ্ছা বললেও ওর কথা বুঝতে পারলাম না। সায়মন উঠে ছোট একটা ডিজিটাল মিটার দিয়ে একটা রিডিং নিয়ে টেপ দিয়ে মেপে মাইক্রোফোনগুলো লাগাল। আমিও ওকে হেল্প করতে লাগলাম। একসময় এ জায়গায় তার, ও জায়গায় ক্যামেরা, এই রুমে মাইক্রোফোন, ফ্লোরে বিশেষ চিহ্ন ইত্যাদি দিয়ে আমরা ঘরের সমস্ত লাইট অফ করে দিয়ে ওর পিসির মনিটরের সামনে বসলাম।
    এখন কী হবে?
    দেখি কী হয়। সকল আত্মার সিগন্যালই যে ধরা যায়, তা নয়। আবার সেই ধরা পড়া সব সিগন্যালই যে কোডে রূপান্তর করতে পরব, এমন নয়; এমনকি সেই সব কোড ভাঙিয়ে অর্থ বের করতে পারব, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
    এটা কি ধরা যাবে?
    বলতে পারছি না। আমাকে কাজ করতে হবে, বলতে পারেন, অনেকটা অনুমানের ভিত্তিতে।
    আমরা যে কথাবার্তা বলছি, তাতে কোনো অসুবিধা হয় না?
    আসলে সোলদের সবকিছু আমাদের সাথে মেলে না। বলতে গেলে কোনো কিছুই মেলে না। ওটা একটা ভিন্ন জগৎ, যা আমার-আপনার পরিচিত জগতের চেয়ে একদম অন্য রকম, আলাদা। যেটা মিল, সেটা হলো, ওরা একটা পাওয়ার, আপনিও একটা পাওয়ার কিন্তু আলাদা।
    ও আচ্ছা।



    সায়মন একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্ট বের করে সেখানে অনেকগুলো প্রশ্ন লিখল। লেখালেখির একপর্যায়ে ল্যাপটপে ছোট একটা শব্দ হলো, যা শুনে মনে হচ্ছে কোনো সংকেত। সাথে সাথে ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটা গ্রাফ উঠল। তার পাশেই একটা ম্যাপের মতো রেখা টানা। মাইক্রোফোনের সাইন আর নম্বর দেখে বুঝলাম, এটা ও যে মাইক্রোফোন আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি বসিয়েছে, তার লে আউট। ও সেই মিটারটা একটা ক্যাবলের মাধ্যমে ল্যাপটপে জুড়ে দিল। একটা কিটকিট আওয়াজ শুরু হলো কোথাও। সাথে সাথে সায়মন দুই আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল, ইয়েস, গড ইট। ওর সিগন্যাল আমি রিড করতে পারব মনে হয়, ভাইয়া।
    আমি সায়মনের এসব কিছুই বুঝতে পারছি না ঠিকই কিন্তু একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করছি ভেতরে ভেতরে।
    ভাইয়া, এটা তো একটা শিশুর সোল বলে মনে হচ্ছে। এখানে একটা শিশু অপঘাতে নিহত হয়েছে।
    মাই গড! বলেন কী!
    হ্যাঁ। সম্ভব সে আগুনে পুড়ে বা পানিতে ডুবে মারা গেছে।
    তাই নাকি?
    হ্যাঁ। 
    সায়মন তার ল্যাপটপে দ্রুত কিছু টাইপ করে গেল, যার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।
    বিষয়টা কি, জানেন? সে কিন্তু ব্যাড সোল হয়ে গেছে এবং সে অবশ্যই প্রতিশোধ নেবে, যা কেউ ঠেকাতে পারবে না। সায়মন কাজ করছে আর আমার সাথে কথা বলছে।
    কী রকম প্রতিশোধ?
    তা তো বোঝা যাচ্ছে না। তবে... 



    এরপরই থেমে গেল সায়মন। আরও কিছু টাইপ করার পর বলল, তবে আপনারা ওই টয়লেটের দরজাটা খুলে মারাত্মক ভুল করেছেন। এর খেসারত আপনাকে বা কাউকে না কাউকে দিতেই হবে।
    আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। কী খেসারত দিতে হবে আমাকে? এই অশুভ আত্মা কী ক্ষতি করবে আমার? 
    আমার কী খেসারত দিতে হবে? আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম ওর কাছে।
    দেখুন, আমি আপনাকে আগেই বলেছি, ওদেরও একটা জগৎ আছে। সেখানেও কিছু সিস্টেম আছে। আপনাকে-আমাকে যেমন কিছু সিস্টেম মানতে হয়, ওদেরও তেমন মানতে হয়। এই শিশুটির আত্মা যখন ওর দেহ ছেড়ে যায়, তখন ও কিছু দুষ্ট আত্মার সাথে গিয়ে মেশে। তারা ওকে নিজেদের জন্য খারাপ শক্তিতে শক্তিশালী করতে থাকে। একসময় ও এখানে উৎপাত শুরু করলে ওকে বন্দী করে রাখা হয়। সেটা আবার আরেকটি আত্মা দিয়ে। ফলে ও মুক্তি পেয়েই একটা হত্যা করবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেকটি আত্মাই সে খারাপ হোক কি ভালো, তার মুক্তির একটা ইচ্ছা থাকে এবং মুক্তি পেতে তাদের নানা রকম কাজ করতে হয়। এই শিশুটিকে যদি প্রথমেই আটকানো না হতো, তাহলে সে হয়তো তার হত্যাকারীকে খুন করে মুক্তি পেয়ে যেত। কিন্তু ও মুক্তি পেতে চাইলে ওর দুটি আত্মা লাগবে। অর্থাৎ কমপক্ষে দুটি খুন করবে ও।
    কী বলছেন এসব আপনি?
    জি, ভয়ংকর শোনালেও এই কথাটি সত্যি। কিন্তু কথা হলো, শিশুটিকে হত্যা করল কে, কেন? নাকি কোনো দুর্ঘটনায় মারা গেছে, এটা জানা ভীষণ জরুরি।
    এসব প্রশ্নের উত্তর আপনি বের করতে পারবেন?
    জানি না। তবে ওকে এখানে যে বন্দী করে রেখেছে, সে অনেক শক্তিশালী কেউ। আর এটি যদি হত্যাকাণ্ড হয়ে থাকে, তবে আমি পরামর্শ দেব, পুলিশে খবর দিন। 
    আমরা আরেক দফা চা খেয়ে দারোয়ানকে ইন্টারকমে কল করলাম সায়মনের জন্য কিছু খাবার আনাব বলে। অনেকবার কল বাজার পরও যখন কেউ ধরল না, তখন আমি নিজেই নিচে গিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভিড়। দারোয়ানের ভাই একটা টুপি মাথায় দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। একসময় জানতে পারলাম, আমাদের দারোয়ান রশীদ আইসিডিডিআরবিতে মারা গেছে। আমি বিস্কুট, কেক, পানি নিয়ে এসে দেখি সায়মনকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।
    কোনো সমস্যা, সায়মন?
    হ্যাঁ। সমস্যাই বলতে পারেন এবং বড় ধরনের সমস্যা।
    কী, আমাকে বলা যাবে?
    আপনার বাসার শিশুটির আত্মা আরও শক্তিশালী হয়েছে। শিশুটি এখন তার খুনিকে খুঁজে খুন করে এ বাড়ি ছাড়বে, তার আগে নয়।
    কী বলেন? এর মধ্যেই আত্মাটা আরও শক্তিশালী হয়ে গেল?
    হুম, আরেকটি কথা, শিশুটিকে খুন করা হয়েছে এবং খুনি এই বাড়িতেই রয়েছে, তা বলতে পারেন মোটামুটি শিওর।
    কী বলছেন আপনি, সায়মন? এটা কী করে সম্ভব? খুন করে খুনি এই বাড়িতেই থাকবে কেন? তার তো পালিয়ে যাওয়ার কথা।
    আমার মনে হয় খুনি যে-ই হোক আর যে কারণেই ওকে খুন করা হোক না কেন, খুনি কিন্তু এই বাড়িতেই রয়েছে। আত্মাটির এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য একটা বাধা ছিল... 
    সায়মন ওর পুরো কথা শেষ করতে পারল না; এর মধ্যে কেউ একজন দরজায় নক করল। আমি গিয়ে দরজা খুলে দেখি কেউ নেই। সায়মন জানতে চাইল, কে?
    কেউ না। হয়তো বাচ্চাকাচ্চা। কাউকে তো দেখছি না। 



    আমি ফিরে এসে সোফায় বসলে সায়মন আবার বলতে শুরু করল, ওর এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কয়েকটি বাধা ছিল। মনে হয় এখন আর অতগুলো বাধা নেই। আর দুটো বাধা আছে, সে বাধা দুটো অতিক্রম করার পর ও এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওর খুনিকে খুন করতে যাবে এবং খুন করবে।
    কোনোভাবেই এই খুন এড়ানো যাবে না?
    যাবে, যদি ওকে এখানে আটকে রাখা যায়। কিন্তু সেটা মনে হয় না আর সম্ভব হবে। আপনারা সার্ভেন্ট টয়লেটটা খুলে একটা বড় ধরনের ভুলই করেছেন।
    আমার নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হতে লাগল। যদিও আমি কাজটা করিনি। আর জেসমিনই বা কী করে বুঝবে এমনটা হতে পারে? আমি সায়মনকে বললাম, আচ্ছা শুনুন, আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমাদের দারোয়ান আইসিডিডিআরবিতে মারা গেছে একটু আগে।
    ওই যে দারোয়ান দরজা খুলেছিল বলেছিলেন?
    হ্যাঁ।
    ও মাই গড! বলে আরও চঞ্চল হয়ে উঠল সায়মন। 
    কী হলো? আমি ওর ল্যাপটপের দিকে একটু ঝুঁকলাম।
    একটু আগে কে নক করেছিল, জানেন?
    কে?
    হতেও পারে ওই দারোয়ানের আত্মা। এই এদিকে আসুন, দেখে যান।
    আমি আরেকটু ঝুঁকে ওর ল্যাপটপে সেই গ্রাফটা দেখলাম। আগে যেখানে একটা লাল বিন্দু ছিল, এখন সেখানে দুটি বিন্দু। তবে একটা লাল, আরেকটা কালো। এর মানে কি দারোয়ানের আত্মা এই ঘরে প্রবেশ করেছে? এমন সময় কিচেনের দিক থেকে খুব জোরে একটা দরজা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝতে পারলাম, সার্ভেন্ট টয়লেটের দরজা।
    আমাদের কি এখানে এখনো থাকা ঠিক হবে? আমি ভয়ে ভয়ে সায়মনকে জিজ্ঞেস করলাম।
    আমি থাকতে পারব, আপনার কথা জানি না।
    আপনি থেকে কী করবেন?
    অন্তত একটা হত্যাকাণ্ড ঠেকানোর চেষ্টা করব।
    কীভাবে?
    আমাকে প্রথমে জানতে হবে ওর খুনি কে, কীভাবে ওকে খুন করা হয়েছিল।
    এসব জেনে আমাদের লাভ কী? বরং চলুন আমরা চলে যাই।
    গেলে তো যাওয়াই যায়, ভাইয়া। কিন্তু আমি যদি জানতে পারি কে এই শিশুটিকে হত্যা করেছিল, তাহলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারি। আগামীকাল অমাবস্যা রাত। তিথি পরিবর্তনের সময় ওর আত্মা আরও শক্তিশালী হবে। সে তার প্রতিশোধ নেবেই। আরেকটি বিষয় হলো, শিশুটিকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা জানতে পারলে লাভ হতো। কারণ, শিশুটির আত্মা তার খুনিকে ওইভাবে বা কাছাকাছি কোনো পদ্ধতিতে খুন করবে। এটা ওরা করে থাকে।
    আপনি কীভাবে রক্ষা করবেন ওই খুনিকে আর কেনই বা বাঁচাতে চাইছেন?
    দেখুন ভাইয়া, আমি খুনিকে বাঁচাতে চাই না। আমিও চাই খুনি যে-ই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হোক। কিন্তু একটা অশুভ আত্মাকে আর আমরা সেই খুনের বিচারের ভার দিতে পারি না।
    আমরা ভার দেব কেন? আপনি তো বললেন ওই আত্মা নিজেই অনেক শক্তিশালী। সে তো নিজেই যা করার করবে।
    আমি ঠেকানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করব। আপনি পুলিশে খবর দিন। না হলে আরও ঝামেলা হবে।
    সায়মন, দেখুন, আমি ফেঁসে যাব, আমার স্ত্রী ফেঁসে যাবে। পুলিশ, কেস-মামলাÑএসব যে কত্ত ভয়ংকর, আপনার কোনো ধারণাই নেই।
    আপনার কোনো ধারণা নেই। সরি দুলাভাই, আপনার সাথে বেয়াদবি করছি। আপনি আমাকে আগে থেকে চিনতেন না, তাই হয়তো জানেন না। আমি একজন লইয়ার। ব্রিটেনে বার অ্যাট ল করেছি। আমি আইনকানুন সব জানি। আপনি শান্ত হোন। আমার বন্ধু সাউথের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার। ওর সাথে আমি কথা বলি, ও সিভিল ড্রেসে বাসায় আসুক। আমরা কথা বলি। টেইক ইট ইজি ম্যান। আপনি ও আপনার স্ত্রী যাতে কোনোভাবেই কোনো রকম উটকো ঝামেলায় না জড়ান, তা দেখার দায়িত্ব আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিন। যদি মনে করেন কিছু হয়, তাহলে আমি নিজে মাগনা লড়ব আপনার কেস। আপনি নিশ্চিত থাকেন, ভাই। আমাকে দেখতে দিন সব। আরেকটি কথা। এই আত্মার কাছ থেকে কিন্তু আপনার স্ত্রীও নিরাপদ নন। তিনিও কিন্তু দরজা খোলার সময় ছিলেন। 



    এবার আমি মারাত্মক ভয় পেলাম। আমাদের কী ক্ষতি করতে পারে? আমরা তো কোনো অন্যায় করিনি। আমার মনে হলো, আমি এখন একধরনের নিরুপায়। কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। সায়মনের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তো এখানে যে মামলা-মোকদ্দমা হবে, তা খুন-বিষয়ক। আমি কী করব, বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি আরিফকে ফোন করে সব জানালাম। ও বলল, সায়মন যা বলে, তা-ই কর। ও তোর ক্ষতি নয়, বরং উপকার করবে, নাসির। তুই নিশ্চিত থাক, দোস্ত। 


    আমি দীর্ঘ সময় কথা বলে সায়মনকে বললাম, আচ্ছা, আপনার পুলিশ বন্ধুকে ফোন করুন।
    সায়মন ফোন করার ঘণ্টাখানেক পর যে লোকটি এল, তাকে দেখলে যে কেউ বলবে মোবাইল কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার ম্যানেজার। আর যা-ই হোক, পুলিশ বলে মনে হবে না। কিন্তু যখন তার বগলের নিচ থেকে পিস্তলের বাঁট উঁকি দিল, তখন আর সন্দেহ রইল না। সব শুনে এসি ইকবাল সায়মনকে বললেন, এখন তাহলে আমি কী করতে পারি, বন্ধু?
    তুই বাড়িওয়ালাকে চাপ দিয়ে জানবি এখানে আগে করা থাকত? কী হয়েছে এখানে। আমি হয়তো তোকে কিছু কিছু জায়গায় হেল্প করতে পারব খুনিকে ধরার জন্য। তুই খুনি ধরে আইনের আওতায় আনবি।



    আমরা তিনজন মিলে বাড়িওয়ালার বাসায় গিলে কথা বলতে চাইলাম। নিচের দারোয়ান মারা যাওয়ায় বাসার মধ্যে অনেক লোকজনের যাতায়াত ছিল। আমি এক ফাঁকে বাড়িওয়ালার ভাতিজাকে দেখতে পেয়ে ডাক দিলাম। একটু আড়ালে নিয়ে আমি বললাম, পাভেল ভাই, উনি আমাদের বন্ধু। পুলিশের এসি। আপনি একটু ওনার সাথে কথা বলুন। 


    পুলিশের কথা শুনে পাভেল কেমন চমকে উঠল। তার ভীতি চেষ্টা করেও ভেতরে লুকিয়ে না রাখতে পেরে বলল, কেন কেন? পুলিশ কেন?
    এসি ইকবাল পাভেলের পিঠে একটা হাত দিয়ে স্মিত হেসে বললেন, আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন, পাভেল সাহেব? আমি এনাদের বন্ধু। পুলিশি কাজে আসিনি, আমার ব্যক্তিগত কাজে কিছু তথ্য জানার ছিল।
    কী তথ্য, বলুন? পাভেলের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
    দাঁড়িয়ে বলব, বসতে দিবেন না? চা-বিস্কুট দেন কিছু। আর লোকজন সবাইকে যেতে বলেন। শুধু আমরা এই তিনজন কথা বলব।
    ঠিক এমন সময় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কোনো একটা মহিলা কণ্ঠ চিৎকার করে বলল, ছাড় আমাকে, ছাড়, নইলে গায়ে আগুন দিয়ে দেব।
    পাভেল বাদে আমরা সবাই চমকে গেলাম। পাভেল বড় বড় চোখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ইকবাল বললেন, কে চিৎকার করছে?
    আমার কাজিন জারা। ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
    কবে থেকে?
    বছরখানেক।
    ট্রিটমেন্ট করাচ্ছেন না?
    জি, করাচ্ছি তো। কোনো কাজ হয় না।
    আচ্ছা, আপনাদের এই বিল্ডিংয়ে মোট কয়টা ফ্ল্যাট?
    আটটা স্যার। হঠাৎ করে দেখলাম পাভেল ইকবাল সাহেবকে স্যার বলা শুরু করল। ইকবাল সাহেব কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার বললেন, চারদিকে এত জঙ্গি হামলা, সে জন্য তো ভাড়াটেদের সব কাগজপত্র নিয়ে চুক্তিটুক্তি করে আপনারা বাসা ভাড়া দেন, তাই না?
    জি স্যার।
    এর আগে যেসব ফ্ল্যাট ভাড়া হয়েছে, সবার কাগজপত্র আছে?
    আছে স্যার।
    নাসির সাহেব যে ফ্ল্যাটে আছেন, সেই ফ্ল্যাটে ওনার আগে কারা ছিল, তাদের কাগজপত্র আছে না?
    স্যার ওনারা ওঠার আগে ফ্ল্যাট খালি ছিল।
    কোনো বাসায় কোনো ভাড়াটে উঠলে তারা তো খালি বাসাতেই উঠবে, নাকি? আমি বলছি ওনাদের আগে কারা ছিল?
    কোনো ভাড়াটে ছিল না। বেশ কয়েক মাস খালি ছিল।
    সেই খালি থাকার আগে কারা ছিল? তাদের কোনো কাগজপত্র আছে?
    দেখতে হবে, স্যার।
    যান, দেখুন। আর আমরা এতগুলো মানুষ আপনাদের বাসায় এসেছি, কেউ একটু চা, এমনকি এক গ্লাস পানি পর্যন্ত দিল না।
    সরি স্যার, সরি। আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি। 




    বাসার সব লোক চলে গেছে। ইকবাল উঠে নিজে হাতে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে বসলেন। অল্প একটু সময় পর সে দিনের সেই মেয়েটা একটা ট্রেতে একটা সুন্দর কাচের জগ আর চারটা গ্লাস এনে রাখল। যখন চলে যাচ্ছিল, তখন ইকবাল বললেন, তোমার নাম কী?
    রাহেলা।
    এই বাসায় কত দিন ধরে কাজ করছ?
    আট-নয় মাস।
    তার আগে কোথায় ছিলা?
    আমাগো গেরামের বাড়িতে।
    তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
    কিশোরগঞ্জ।
    আচ্ছা, ঠিক আছে, যাও তুমি। পাভেল সাহেবকে পাঠিয়ে দাও।
    আইচ্চা স্যার।
    দশ-পনেরো মিনিট পর পাভেল ফিরে এসে বলল, স্যার ওই সব কাগজ তো অনেক আগের, খুঁজে পাচ্ছি না।
    তাহলে এক কাজ করুন, গত দুই বছরের এই বিল্ডিংয়ের যত প্রকার ইউটিলিটিস বিল আছে, সব নিয়ে আসুন।
    হঠাৎ বাসার মধ্যে আবার সেই নারী কণ্ঠ চিৎকার করে বলছে, আমাকে ছাড়, এখুনি দরজা খোল, নাইলে গায় আগুন ধরাইয়া দিমু।



    পাভেল চলে যাওয়ার পর ভেতরের ঘরে কিছু চাপা স্বরে কথাবার্তা শুনতে পেলাম আমরা। একটু পরই ষাটোর্ধ্ব এক মহিলাকে নিয়ে ঢুকল পাভেল। তার চেহারা, বেশভূষায় আভিজাত্যের ছাপ থাকলেও উদ্বিগ্নতা ঢাকতে পারেননি। উনি এসে আমাদের সালাম দিলেন। আর পাভেল বলল, আমার চাচিজি। এই বাড়ির মালিকের বউ। ওনার সাথে কথা বলেন, স্যার।
    মহিলা আমাদের সামনের সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। আমাদের সবার দিকে তাকালেও কারও চোখের দিকে তাকালেন না। বললেন, সরি বাবারা, আমি একটু অসুস্থ। হয়তো আরও আগেই আসা উচিত ছিল।
    না, ঠিক আছে ম্যাম, সমস্যা নাই। বললেন ইকবাল।
    এর মধ্যে সেই কাজের মেয়েটি আরেকটি ট্রেতে নুডলস, মিষ্টি, কাটা আপেল আর বেশ কিছু আঙুর এনে রাখল টি-টেবিলে। সবকিছু নামিয়ে রাখার পর ভদ্রমহিলা কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, চায়ের পানি দিয়েছ না?
    জে খালাম্মা।
    ঠিক আছে, যাও। আচ্ছা বলো, তোমরা কী জানতে চাও?
    ইকবাল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি শুরু করুন। 


    আমি শুরু থেকে বলা শুরু করলাম। যখনই বললাম বাথরুমের দরজা খুলে ফেলেছি, তখনই মহিলা চমকে উঠলেন। মনে হলো ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল তার।
    এটা কেন করতে গেলেন আপনারা? ওহ্ গড। বলেই মহিলা দুই হাতে মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলেন। আমরা তিনজনই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। একে অপরের মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে ভয়ংকর একটা নীরব সময় পার করতে লাগলাম আমরা। উনি কিছুক্ষণ পর শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছে আমার দিকে ফিরে বললেন, তারপর?
    এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি নতুন করে কথা শুরু করতে একটু বিব্রত বোধ করছি দেখে ইকবাল বললেন, বলুন নাসির সাহেব, সব বলুন। 



    আমি এবার বিনা বাধায় সব বললাম। আমার কথা শেষ হলে ইকবাল বললেন, দেখুন খালাম্মা, ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে ভূত-প্রেত, অশরীরী আত্মাÑএসবে বিশ্বাস করি না। তবে মি. নাসির যেসব কথা বলেছেন, তা সত্যি হলে সেটা খুবই ভয়ংকর। উনি আর ওনার স্ত্রী নিশ্চয়ই অনেক ভয় পেয়েছেন। ওনাদের হয়তো পারিবারিক বন্ধু সায়মন একটু এই সব আত্মাটাত্মা নিয়ে চর্চা করেন। উনি সবকিছু শুনে ওনার জায়গা থেকে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলছেন, ওই ফ্ল্যাটে একটি শিশুর অপমৃত্যু হয়েছে, যেটা ছিল আসলে খুন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য শুনতেই আমরা এসেছি। আমার নাম মো. ইকবাল হুসাইন খান, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অব পুলিশ।
    এ কথা শোনার পর মহিলা একটু ঘাবড়ে গেলেন মনে হলো। টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেয়ে আঁচল দিয়ে মুখে মুছে নড়েচড়ে বসলেন। ষাটোর্ধ্ব মহিলার মুখটা হঠাৎ কেমন রক্তশূন্য মনে হলো। আমরাও সবাই ওনার কথাবার্তা শোনার জন্য নড়েচড়ে বসলাম।
    আমি ওই ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে নিষেধ করেছিলাম পাভেলকে।
    কেন? জানতে চাইলেন ইকবাল।
    ওই ফ্ল্যাটে ঝামেলা আছে।
    কী ঝামেলা, আমরা সেটাই জানতে চাচ্ছি, খালাম্মা। আমাদের হেল্প করলে আপনাদেরই লাভ হবে।
    বলছি। অবশ্যই বলব। আজ তোমাদের আমি সবকিছু বলে দেব। আমরা এক পা কবরে। আমি আর কোনো কিছু চাপিয়ে রাখতে চাই না। 
    কথার এই পর্যায়ে চা নিয়ে এল কাজের মেয়েটি। তিনি কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, জারা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
    জে।
    আজাদকে বলো ওকে ঘুমের মধ্যে আরও দুটো ইনজেকশন দিয়ে দিতে। আমি অনেকক্ষণ ওদের সাথে কথা বলব।
    ইকবাল জানতে চাইলেন, জারা কে?
    বলছি, সবই বলছি। নাও চাটা শেষ করো। 


    শুধু আমি নই, মনে হয় সায়মন আর ইকবাল- আমরা তিনজনে দ্রুত চা শেষ করলাম এ ঘটনা শোনার জন্য। একটু সময় নিয়ে মহিলা বলতে শুরু করলেন, নাসির সাহেব ওই ফ্ল্যাটে ওঠার আগে বছরখানেক ফাঁকাই ছিল। ওরা ওঠার আগে ওই ফ্ল্যাটে আমরাই ছিলাম। আমার স্বামী একটা সরকারি চাকরি করতেন। দুর্নীতির দায়ে তিনি পাঁচ বছর আগে চাকরি হারান। কিন্তু তিনি চাকরি থাকতে যা করেছেন, তা হয়তো আরও তিন পুরুষ বসে বসে খেতে পারতেন। চাকরি হারিয়ে আমার স্বামী একপ্রকার পালিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়া। সেখানে আমাদের একমাত্র ছেলেকে আমরা আগেই পাঠিয়েছি। এ পাশে আমি মেয়েকে নিয়ে একা হয়ে যাই। নগদ অর্থ হাতে পেয়ে আমাদের একমাত্র মেয়ে হয়ে যায় এক চরম উচ্ছৃঙ্খল, নেশাখোর আর স্বেচ্ছাচারী। তার নামে তার বাবা আগেই ব্যাংকে প্রচুর টাক রেখে গিয়েছিলেন। অত টাকা আর অভিভাবকহীন মেয়েটা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে এক ভয়ংকর নেশাখোর। শুরু করে যৌন স্বেচ্ছাচারিতা। 


    আমি কিছুই করতে পারছিলাম না। মাত্র দুবছরের মাথায় তার বাবার রেখে যাওয়া আড়াই কোটি টাকা একেবারে জিরো ব্যালেন্সে নামিয়ে ফেলে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কেস চলতে থাকে। একে ক্রোক হয় আমাদের চার-চারটা বাড়ি। ভাগ্যিস, এই বাড়িটা আমার নামে করা হয়েছিল। দুর্নীতি দমন কমিশন আর আমার মেয়ের নির্যাতন দুটোই একসাথে চলছিল একত্রে। একসময় আমি মেয়েকে জোর করে রিহ্যাবে দিলাম। ছয় মাস থেকে বেরিয়ে এসে আবার যেই সেই। একসময় ওর সব টাকার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ও ঘরের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে বেচা শুরু করল। মোবাইল, ঘড়ি, ল্যাপটপ, বইপত্র, যা যা হাতের কাছে পেত, সব। যখন কিছুই আর বেচার জন্য পেত না, তখন আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলত টাকার জন্য। টাকা না দিলে শুরু করত নারকীয় তাণ্ডব। হাতের কাছে যা পেত, তাই ভাঙা শুরু করত। চোখের সামনে যা পেত, সব ছুড়ে মারত সারা ঘরে। বাধ্য হয়ে একসময় টাকা দিতাম। প্রায়ই ওর যন্ত্রণায় ভাড়াটেরা চলে যেত। আমাদের নিচের ফ্ল্যাট থেকে, মানে আমরা এখন যে স্থানে বসে আছি, এই ফ্ল্যাট থেকে রেগুলার চিল্লাফাল্লা করত। একদিন সন্ধ্যাবেলা ও ওইভাবে সারা ঘরে তাণ্ডব চালাচ্ছিল। 


    ঘটনার দিন জারার যন্ত্রণা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। আটটা-সোয়া আটটার দিকে আমি বাসা ছেড়ে ই ব্লকে আমার বোনের বাসায় চলে গেলাম। যাওয়ার সময় দেখে গেলাম জয়ফুল রান্নাঘরে কাজ করছে। চুলায় একটা বেশ বড় ডেকচিতে খাবার পানি ফুটছিল টগবগ করে। আমাদের বাসায় তখন জয়ফুল নামে একটা অল্পবয়সী বিধবা মেয়ে কাজ করত। আমাদের বাসায়ই থাকত, খেত। ওকে আমরা খুব পছন্দ করতাম, ভালোবাসতাম। ওর সাথে ওর তিন-সাড়ে তিন বছরের ছেলে মইনুলও থাকত আমাদের বাসায়। ছেলেটা দেখতে বেশ মিষ্টি ছিল। আমরা সবাই ওকে খুব আদর করতাম, এমনকি জারা নিজেও ওকে খুব আদর করত। আমি রাত দশটার দিকে ফিরে দেখি বাসা বেশ সুনসান, নীরব। কোথাও কেউ নেই। জারাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি ঘরের মধ্যে লাইট বন্ধ করে গুম মেরে বসে আছে। 


    আমি জয়ফুলকে ডেকে দেখলাম সে কোথাও নেই। জারার কাছে জানতে চাইলাম জয়ফুল কোথায়? সে বলল, জয়ফুলকে সিগারেট আনতে পাঠিয়েছিলাম, এখনো ফেরেনি। বললাম, মইনুল কোথায়? বলল, মইনুল জয়ফুলের পেছন পেছন গিয়ে নাকি আর ফেরেনি। কী অদ্ভুত কথা! আমি খুবই অবাক হলাম। জয়ফুল এরকম মেয়েই নয়। আমার দুশ্চিন্তা শুরু হলো। জয়ফুল দেখতে-শুনতে বেশ ভালো ছিল। এত রাতে সে বাইরে থাকলে তার নিশ্চিত কোনো বিপদ হবে। আমি যত দূর সম্ভব দারোয়ান আর পাভেলকে পাঠিয়ে মা-ছেলেকে খুঁজতে পাঠালাম। কিন্তু ওরা রাত একটা পর্যন্ত খুঁজেও মা-ছেলে কাউকেই পেল না। ভাবলাম, পরদিন থানায় জিডি করব। কিন্তু রাত একটার পর বেরিয়ে আসতে শুরু করল আসল ঘটনা। শরীরে অসম্ভব জ্বলুনি শুরু হয়ে গেল। সময়মতো মাদক না নিতে পারলে এমন অস্থিরতা ওর মধ্যে আগেও দেখেছি। আমি ভেবেছি সেরকম কিছু। কিন্তু সেদিনকার যন্ত্রণা ছিল একেবারে ভিন্ন রকম। বলছে, সারা শরীর জ্বলছে। টিকতে না পেরে বাথটাবে গিয়ে গলা ডুবিয়ে বসে থাকে কতক্ষণ, বরফ ডলে, এসি ১৬-তে দিয়ে ফ্লোরে শুয়ে থাকে কিন্তু শরীরের জ্বলুনি আর কমে না ওর। তারপর একসময় টিকতে না পেরে বলল, মম, আমি একটা ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি। জানতে চাইলাম, কী অন্যায় করেছিস? বলল, জয়ফুলকে সিগারেট আনতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে তো কোনো টাকা ছিল না। বাকিতে আনতে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক সময় যাওয়ার পরও জয়ফুল যখন ফিরছিল না, তখন আমি রাগে মইনুলকে ফুটন্ত সেই ডেকচিতে ছেড়ে দিয়েছি।




    একমুহূর্তের মধ্যে আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমরা কে কী বলব, কী করব, বুঝতে পারলাম না। ইকবালই শুধু সেই ভয়ংকর নীরবতাটা ভাঙলেন। বললেন, তারপর?
    নিজের আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় মহিলা বললেন, এরপর সে নিজের রুমে গিয়ে শান্তভাবে টিভি দেখতে শুরু করে। যখন মনে হলো জয়ফুল এসে তার ছেলেকে ডেকচির মধ্যে দেখবে, তখন জারা মইনুলকে পানি থেকে তুলে সার্ভেন্ট টয়লেটে লুকিয়ে রাখে। ওর মা সিগারেট নিয়ে আসার পর মইনুলের কথা জিজ্ঞেস করলে জারা তাকে বলল, মইনুল তো তোমার পেছন পেছন নিচে গেল। জয়ফুল সেই যে তার ছেলে খুঁজতে গেল, আজ পর্যন্ত সে আর ফিরে আসেনি। জয়ফুল দেখতে অনেক সুন্দরী ছিল। না জানি কী ঘটেছে মেয়েটার ভাগ্যে।



    মহিলা আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কান্না থামিয়ে আবার বলা শুরু করলেন, আমি তখনই দৌড়ে সার্ভেন্ট টয়লেটে গিয়ে দেখি খালি। সেখানে কিচ্ছু নেই।
    বলেন কী? কোথায় গেল? বিস্ময়ে জানতে চাইলেন ইকবাল।
    কী করে বলব, বলুন?
    কিন্তু এত সব আপনাকে কি আপনার মেয়ে জারাই বলেছে?
    হ্যাঁ।
    ও যে সত্যিই বলেছে, তার প্রমাণ কী?
    কেউ কি খুন করে মিথ্যে বলে, অফিসার?
    তারপর?
    তার পর থেকে বাসায় শুরু হলো দুই অশুভ আত্মার অত্যাচার।
    দুই অশুভ আত্মা মানে? প্রথম কথা বললেন সায়মন।
    দুই অশুভ আত্মা মানে মৃত মইনুলের আত্মা আর আমার মেয়ে জারার জীবিত আত্মা। কোনো ভালো আত্মা কারও মধ্যে থাকলে সে কি একটা শিশু হত্যা করতে পারে?
    কী শুরু হলো, বলুন তো। ইকবাল আরেকটু ঝুঁকে জানতে চাইলেন।



    মহিলা পুনরায় চোখ মুছে বলা শুরু করলেন, শিশুটির আত্মা যা করত, তা তো আপনারা দেখেছেনই। আর জারা তার সকল প্রকার নেশা নিজে থেকে বাদ দিয়ে দিল। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত তার শরীর জ্বালা করা শুরু করল। খালি বলে, ওর শরীরে যেন কেউ ফুটন্ত পানি ঢেলে দিয়েছে। খালি মরতে চায়। কত ডাক্তার-কবিরাজ, দেশ-বিদেশ করলাম, কিছুতে কিছু হয় না। ঠান্ডা বরফের মধ্যেও রেখেছি, কিছুই হয় না। দিন দিন জ্বালা বাড়ে। ও যা করে, তা যদি দেখেন, তাহলে বলবেন, ওর মারা যাওয়াই ভালো। এত কষ্ট পায়, যা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। শত হলেও আমি তো ওকে নয় মাস পেটে ধরেছি। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। নাসির সাহেব, আপনি সার্ভেন্ট টয়লেটটা খুলে বরং ভালোই করেছেন।
    মানে? আমি জিজ্ঞেস করলাম মহিলাকে।
    আত্মার যন্ত্রণায় আমরা যখন অতিষ্ঠ হয়ে যাই, তখন এক তান্ত্রিক এনে ওই টয়লেটটায় মইনুলের আত্মাকে আটক করার ব্যবস্থা করি। তান্ত্রিক আমাদের ওই টয়লেটের দরজা খুলতে নিষেধ করেছিল বারবার। সে বলেছিল, দরজা খুললেই নাকি আত্মাটি বাইরে বেরিয়ে আসবে আর খুন করে ফেলবে ওর খুনিকে।


    আমরা দুজনেই একত্রে সায়মনের দিকে তাকালাম। সায়মন বললেন, আপনাদের দারোয়ান যে ওই আত্মাটি দ্বারা খুন হয়েছে, তা কি জানেন?
    হ্যাঁ, আপনারা বলার পর আমি বুঝতে পেরেছি।
    সায়মন সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন শিশুটির আত্মা আরও শক্তিশালী হয়েছে। এখন সে চাইলেই প্রতিশোধ নিতে পারবে।
    জারাকে বাঁচানোর কি কোনো উপায় নেই? সায়মনকে প্রশ্নটি আমি করলেও সবাই উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইল। সায়মন খুন শক্ত আর নীরবভাবে বললেন, না। একেবারেই না।
    আমি যদি ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আমাদের বিশেষ হেফাজতে রাখি? সায়মনের কাছে জানতে চাইলেন ইকবাল।


    তা রাখতেই পারিস, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। আত্মার কাজ করার পদ্ধতি আর ডাকাত-খুনিদের কাজ করার পদ্ধতি এক নয়। ওরা আবেগতাড়িত নয়। মানুষের সাথে ওদের অনুভূতি মেলে না। ওরা খেলে পাওয়ার ভার্সেস পাওয়ার। ওদের সাথে ওদের লেভেলের পাওয়ার দিয়ে লড়তে হয়। তোর কামান-বন্দুক কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। তারপরও তুই যেটা ভালো মনে করিস, সেটা করতে পারিস।
    ওই শিশুর আত্মার বিপরীতে শক্তিশালী কাউকে দাঁড়াতে হলে সে কেমন পাওয়ার হতে হবে?
    সে হতে হবে ওর চেয়ে শক্তিশালী কোনো শুভ আত্মা, যার পাওয়ার ওর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু সেটা হতে হবে পজেটিভ এনার্জি।



    কিন্তু কোথায় পাব সেই পজেটিভ এনার্জি? কোথায় আছে সেই শুভ আত্মা? উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন জারার মা। সায়মন আমতা আমতা করে বললেন, সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই আমার। আজ রাতে অমাবস্যা। আজ রাতের পর যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। আপনারা অবশ্যই সাবধান থাকবেন। তবে মনে হয় না সাবধান থেকে কিছু হবে।

    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে)

    No comments