Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    যাত্রী ।। ছোটগল্প

    কারিগরি ত্রুটি হয়েছে, এই কারণে বিমান কর্তৃপক্ষ বিশ মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। আমরা বলতে আমরা যারা চিটাগং থেকে ঢাকায় যাব এই বিমানটায়। কানের মধ্যে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছি আর বিশ মিনিট শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। খুব আলতো একটা স্পর্শে আমি আমার বাঁ দিকে ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি ফুটফুটে একটি মেয়ে, বয়স ৮-১০। সে আমাকে কাছেই কাউকে আঙুল নির্দেশ করে দেখাল। তাকে দেখে আমি আক্ষরিক অর্থে স্ট্যাচু না হলেও কাছাকাছি গেলাম। কারণ, আমি তাকিয়ে দেখি নীলিমা।



    বছর দশেক আগের কথা। তেজগাঁও রেললাইনের ওপরে বসে অযথাই কথা বলে চলেছি আমরা। কথার পর কথা, অযথাই কথা। কানের পর্দা আর পায়ের নিচের মাটি কাঁপিয়ে মাঝেমধ্যে ট্রেন যাচ্ছে আমাদের দুপাশ দিয়ে। আমরা বসেছি এদিক-ওদিক দুই লাইনের মাঝখানে, রেল কর্তৃপক্ষের ফেলে দেওয়া অথবা রেখে যাওয়া লোহার পাতের দ্বীপের ওপর। আমাদের ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে মানুষ গিজগিজ করছে। সামনের আর পেছনের বস্তির ঘরগুলো থেকে বৃষ্টিভেজা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ, গাঁজার গন্ধ তীব্রভাবে আসছে, সাথে আসছে মিটিমিটি আলো, হসি ও কান্নার ধ্বনি। মনে হচ্ছে, মাঝেমধ্যে সংগমের শব্দও আসছে। শিশুর কান্নার প্রবল উপস্থিতির করণে বোধ হয় হরিয়ে যাচ্ছে ওটা। প্রায় দিনই অফিস শেষ করে কয়েকজন পুরোনো বন্ধু মিলিত হই। এর মধ্য থেকে কেউ কেউ হারিয়ে যাই একটু ধোঁয়াশার জগতে। ওখানে একধরনের বেদনামিশ্রিত আনন্দ পাই। সবে চিকিৎসক হয়েছে, এমন এক বন্ধুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান না করে রওনা দিই ওর সাথে। বৃষ্টি বলে অনেক কাদা আর পচা আধা পচা মাড়িয়ে হাজির হই। সেই পরিচিত রুম, পরিচিত জানালা, সাথে বেশ কয়েকটি পরিচিত মুখ।


    মাঝারি আকারের একটি রুমে বসে টিভি দেখছে অনেকে। আশপাশে কয়েকটি বিভিন্ন গ্রেডের নারীমুখ। তাদের ওড়না ছাড়া বুক, অতিরিক্ত সাজ, অকারণ গা-ঘেঁষা, ক্ষণে ক্ষণে খলখল- সবকিছু আমাকে অস্থির করে তোলে। আমি নেশায় বুঁদ। তারপরও খুঁজে ফিরি সেই মুখ, সেই হাসি। একজনের কাছে জানকে চাইলাম তার কথা, পাঁচ মিনিটের মাথায় তাকে নিয়ে হজির হলো ছেলেটা। আমি তাকে নিয়ে একটা অগোছালো রুমে প্রবেশ করলাম। আমার দৃষ্টিতে সে সবার মধ্যে অন্যতম। দীর্ঘাঙ্গী সে, একটু লম্বাটে গড়ন, মেদহীন শরীর আর আছে মায়াভরা দুটি চোখ। গায়ের রং অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েদের মতো। উন্নত স্তন আর প্রয়োজনীয় নিতম্বে এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে, যা আমি বাংলাদেশের কোনো গনিকালয়ে পাইনি। নাম নীলিমা। বয়স বাইশ-তেইশের বেশি হবে বলে মনে হয় না। স্কুলমাস্টার বাবা উচ্চমাধ্যমিক অতিক্রম করার পরপরই বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। যার রূপ মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত, তার পাত্র বেশি খুঁজতে হলো না। সহজেই বিয়ে হয়ে গেল ছোটখাটো এক কোটিপতির সাথে। বিয়ের পর এক রাতে নীলিমা জানল, তার স্বামী একজন সমকামী। নারীদেহে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। 


    অনেক চেষ্টা করেছে নীলিমা। কোনো লাভ হয়নি। বিয়ের এক বছরের মধ্যে নীলিমাকে ছুঁয়েও দেখেনি তার স্বামী। বাধ্য হয়ে সে চলে এল বাপের বাড়ি। সবাই অনেক বুঝিয়েও যখন কোনো লাভ হলো না, তখন শুরু হলো পরিবারের সবার জিবের তীব্র আঘাত, যা ওর হৃদয়কে ক্রমেই ফালাফালা করে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ওকে জীবন দিয়ে ভালোবাসত, এমন একজনের হাত ধরে চাকরির খোঁজে পাড়ি জমায় তিলোত্তমা ঢাকায়। অবশেষে ঠাঁই হয় প্রথমে মগবাজারে, এরপর বনানীতে আর আমার সাথে প্রথম দেখা হয় কারওরান বাজারে, আর এখনো এখানেই আছে। আমার সাথে প্রথম দেখা হয় মাসদুয়েক আগে। ওর চোখের দিকে তাকালে মনে হাজারো চিন্তা উঁকি মারে। ইচ্ছা করে ট্রেনলাইনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দৌড়াই, রাতের বেলা অকারণে জাগিয়ে বলি, চলো রাস্তায় হাঁটি। ইচ্ছা করে সে সব সময় পাশে থাকুক। ইচ্ছাটা গলা পর্যন্ত এসে ঠেকে যায়। একদিন নেশায় বুঁদ হয়ে বলেছিলাম, ঘর বাঁধতে চাই তোমাকে নিয়ে। কতক্ষণ হাসল। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এল, আর সেই পানি রূপ নিল বন্যায়। এরপর আর বলা হয়নি। একটা বাজারের মেয়ের কাছে আর বলতে ইচ্ছা হয়নি। তবে হোটেলে গিয়ে ওকেই খুঁজি, না পেলে চলে যাই। জীবনে শত মেয়ের কাছে প্রেম নিবেদন করেছি। নীলিমার মতো হেসেছে সবাই, কাঁদেনি কেউ।


    রাত সাড়ে বারোটার সময় পুলিশ চলে এল। সবাইকে ধরে নিয়ে এল থানায়। আমাকে,নীলিমাকেÑসবাইকে। আমি রাতেই ছাড়া পেয়ে গেলাম। কিন্তু শত চেষ্টা করেও জানতে পারিনি কী ঘটেছিলনীলিমার ভাগ্যে। এরপর দীর্ঘদিন, দীর্ঘ রাত কারও সাথে কথা নেই, দেখা নেই, নেই স্পর্শ কিংবা উষ্ণতা। বাবার কাঁধের জোয়ালটা আমার কাঁধে দিয়ে গেলেন, আর আমিও নিয়ে নিলাম। তার পর থেকে টেনেই চলছি। সংসার নামের সঙ আর করা হয়নি। এখন গিয়ে ঠেকেছি তেতাল্লিশের কোঠায়। শরীরের চাহিদা আগের মতোই মেটাই। মনের চহিদা আছে কিনা, তা পেটের চাহিদার করণে বুঝতে পারিনা কিংবা চেষ্টা করি না।

    কাছে গিয়ে বললাম, কেমন আছ?
    অনেক ভালো, তুমি?
    আগের মতোই।
    আগের মতোই? আগের মতোই মানে কী?
    এই তো একা আছি, চাকরি করছি, মানে তুমি আগে যে রকম দেখেছ,এখনো সে রকমই আছি।
    বিয়ে করোনি?
    বিয়ে করলে কেউ একা থাকে?
    করোনি কেন?
    কোনো মেয়েই তো পছন্দ করল না। আর নিজেও সময় করে উঠতে পারিনি। বাদ দাও, তোমার খবর কী, বলো। মেয়েটা কার? বিয়ে করেছ নাকি?
    হু।
    কাকে?
    চিনবে তুমি?
    না, তা না, তুমি-না বললে বিয়ে করবে না। আর করলেই যখন, তখন আমি কী দোষ করেছিলাম?
    আরে ধুর, বাদ দাও তো।
    আমাদের কথার ফাঁকে বিমান কর্তৃপক্ষ অনেক দুঃখিত হয়ে আরও বিশ মিনিট সময় চেয়ে নিল। আমি অন্যদের মতো রাগ না করে খুশি হলাম। মনে হলো নীলিমাও তাই। মাইক থামতেই আমি আবার বললাম, থাকবে কেন? বলো। তোমার স্বামী কী করে? ওর একটা বায়িং হাউস আছে।
    আর তুমি?
    ঘর-সংসার করি, মেয়ে সামলাই।
    খেয়াল করলাম,নীলিমা অনেক স্মার্ট হয়েছে। বেশ কিছু সময় নীরব থেকে আবার বললাম, আমার সাথে তাহলে এমনটা করলে কেন? কী হতো আমাকে বিয়ে করলে?
    একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না।
    কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল নীলিমা।
    বলো।
    তোমার প্রতি আমার আলাদা একটা দৃষ্টি ছিল। কারণ,তুমি ছিলে আমার বেশ ভালো একজন কাস্টমার। একজন ভালো কাস্টমার যে একজন ভালো স্বামী হবে, তা আমি কখনোই মনে করি না। এখন যাকে বিয়ে করেছি, সে-ও আমার কাস্টমার ছিল।
    বলো কী!
    শোনো, আমি তোমাকে একটা কথা বলি, যা আর কাউকে কোনো দিন বলিনি বা বলবও না। আমি পতিতালয়ে আশ্রয় নেওয়ার বড় কারণ আমার পেটের ক্ষুধা ছিল না,ছিল আমার যৌনক্ষুধা। আর আমি সেখানে এমন একজনকে খুঁজে ফিরেছি, যেকিনা আসলেই আমার চাহিদা মেটাতে পারবে। রায়হান আসলে তা-ই। যা তুমি কখনোই ছিলেনা। ওকে পেয়েছি, বিয়ে করে ফেলেছি।
    সে তোমাকে বিয়ে করতে চাইল?
    মেয়েরা পুরুষদের দিয়ে করাতে পারে না, এমন কোনো কাজ পৃথিবীতে আছে কিনা, সন্দেহ।
    তুমি কতটা সুখী?
    একটা মেয়ে যতটা সুখ চায়।



    নীলিমার মোবাইল বেজে উঠলে। কথা শেষ করে মোবাইলটা রেখে একমুহূর্ত থামলনীলিমা। কিছু একটা খুঁজছে ভ্যানিটি ব্যাগে। কতক্ষণ পর আমার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে এক হাতে লাগেজ, আরেক হাতে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেল, আর যাওয়ার সময় বলে গেল,এখনো সময় আছে, এটা অন্য কাউকে দাও, ভালো থাকো আর গাঁজা খাওয়াটা কমিয়ে দাও, পারলে ছেড়ে দাও।
    ও চলে যাওয়ার পর হাতের মুঠ খুলে দেখি একটা একটাকার চকচকে নোট, যা এখন জাদুঘরে ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। ওটা এক চরম মুহূর্তে ওকে আমি দিয়েছিলাম। আর বলেছিলাম, এটা আমার জীবনের প্রথম উপার্জনের অংশ। তোমাকে ভালোবেসে দিলাম। ভেবে রেখেছিলাম, যাকে ভালোবাসব এবং বিয়ে করব, এটা তাকেই দেব।
    এটা এখন আমি কী করব, বুঝতে পারছিনা। জানি, ভিক্ষুকও এটা নেবে না। আবার নিজের কাছে রাখতেও কেমন যেন লাগছে। অচল জিনিস কেউ নেয় নাকি?

    মাইকে বারবার ঘোষণা দিচ্ছে বিমানে ওঠার জন্য। আমি ধীরপায়ে গিয়ে ওটার পেটের মধ্যেঢুকলাম। আকাশটা খুব ফ্যাকাশে লাগছে। এমন আকাশে থাকতে ইচ্ছা করছে না। আমি ইয়ারফোনটা আবার কানে ঢোকালাম।


    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি প্রথমে মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকায় ছাপা হয়, পরে আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত হয়। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।)
    Image Credit: Artist - 

    No comments