Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    সমীকরণ ।। সাইফুল বাতেন টিটো’র ছোটোগল্প


    হেমায়েত সাহেব ছেলের পরীক্ষার রেজাল্টে আদৌ খুশি না। খুশি হবেন কী করে? দিন দিন সে রেজাল্ট খারাপ করেই যাচ্ছে। ক্লাস সিক্সে অ্যাডমিশন-টেস্টে যখন প্রথম হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন— এটা ধরে রাখতে পারবি তো?

    সেই ছেলে যখন ক্লাস সেভেনে উঠেছিল, তখন রোল হল সাত। আর তারই অফিসের ক্লার্ক সিরাজুলের মেয়ের রোল হল এক। এবার আরো বাজে অবস্থা। সিরাজুলের মেয়ে রাবেয়ার রোল এক ঠিকই রইল আর তার ছেলের হল নয়! হায় রে অবস্থা! হেমায়েত সাহেব চেয়েছিলেন, ছেলেকে বৃত্তি দেয়াবেন। সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাবে, তার কি-না রোল নয়! না না না, একদম বাজের পরও বাজে অবস্থা। এভাবে চলতে দিলে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এসএসসি পাস করতে পারবে না! অথচ বড় ছেলেটা কত ভালো। বড় ছেলে হাবিব একবার শুধু ক্লাস থ্রিতে দ্বিতীয় হয়েছিল আর প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম। এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে। কত্ত ভদ্র ছেলে। কোনোদিন বাবা-মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি। আর মাঈনটা হয়েছে বদের হাড্ডি। শুধু মুখে মুখে কথা। দিন দিন যে তার লেখাপড়া গোল্লায় যাচ্ছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আছে শুধু ক্রিকেট নিয়ে। সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, লেখাপড়া তো নেই-ই; আছে শুধু ক্রিকেট আর ক্রিকেট। হেমায়েত সাহেব এপাশ থেকে ওপাশ ফিরলেন। ঘুম আসছে না।

    কি, তোমার ঘুম আসছে না? গায়ে হাত দিয়ে জিগ্যেস করল তাসলিমা।


    না। আবার চিন্তায় ডুবে গেলেন হেমায়েত সাহেব। আজকাল গায়ে-পায়ে বেশ বড় হয়েছে মাঈন। গলার স্বর বদলে গেছে, বয়স পনেরো। বড় সেনসিটিভ সময়। এ সময় উচ্চবাচ্য না-করাই ভালো। উচ্চবাচ্য ওর সাথে অবশ্য কখনোই করা হয়নি। সবার ছোট তো! মাঝখানের মেয়ে বিয়ে দিয়ে মাঈনের প্রতি ভালোবাসা আরো বেড়ে গিয়েছে সবার। কী করা যায় ওকে নিয়ে?

    শেষ-পিরিয়ডের ক্লাস করেনি মাঈন। বইপত্র নিয়ে চলে এসেছে। এসে বসে আছে তোফাজ্জেলের চায়ের দোকানে। দোকানের পেছনে লুকিয়ে সে এর মধ্যেই দুইটা সিগারেট খেয়ে ফেলেছে। অবশ্য সাথে কবিরও আছে। কবির ওদের ক্লাসেই পড়ে, তবে এ বছর নিয়ে সে এইটে তিন বছর। কাল রাত ১২টা পর্যন্ত জেগে মাঈন একটা চিঠি লিখেছে। স্কুলে এসেই চিঠিটা কবিরকে দেখিয়েছে। কবির বলেছে— ভালো হইছে। কবিরকে সে সিগারেটের সাথে চা-বিস্কুটও খাইয়েছে। বিনিময়ে কবির চিঠিটা আফরোজাকে দেবে।

    আফরোজা ওদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। মাঈনের খুব পছন্দ আফরোজাকে, কিন্তু সে আফরোজাকে মুখে কিছুই বলেনি। তার লজ্জা করে। কবির মাঈনের চেয়ে বছর তিনেকের বড় হলেও মাঈন কবিরকে তুই করেই বলে।

    তুই কী বলিস দোস্ত, আফরোজা রাজি হবে? 

    বেশ জ্ঞানী ভঙ্গিতে কবির বলল— আরে ভাই রাজি করানোর চিন্তা আমার। তুই এত ভাবিস না। মাইয়া রাজি তো হইবই, আরো কত কিছু হইব... চিন্তা করিস না তুই। আর একটা সিগারেট খাওয়া। মাঈন আরো


    একটি সিগারেট কিনে কবিরকে দেয়। কবির বড়দের মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে— বাদলে আবার হ্যার পিছে ঘোরে। বাদলরে একটা ঠ্যাঙানি দেওন লাগব।

    কোন বাদল? 

    আরে টেনের বাদল, এক রোল। বয়রাতলা বাসা।

    ও আচ্ছা। কী করা যায় দোস্ত?

    কইলাম না, একটা ঠ্যাঙানি দিতে হইব। ঠ্যাঙানি দিলে পিছু ছাইড়া ভাগব।

    দোস্ত মারামারি করলে আব্বু বাসায় উঠতে দেব না।

    তাইলে বাদ দে। প্রেম করন লাগব না তোর। তুই এমনিতেই পিচ্চি পোলা। বাদল কত্ত বড়। লম্বা-চওড়া, জোয়ান-মর্দ। তোর মতো পুইচকা না। বাদল আর দুই-চাইর দিন ঘুরলে ওর লগেই মইজ্যা যাইব আফরোজা। তোরে আর পাত্তাও দেব না।

    মাঈন পুচকে এ কথা মিথ্যে না, কিন্তু সে বড় হওয়ার জন্য কি কম করছে! নিয়মিত ব্যায়াম করে চলেছে, ছোলা খাচ্ছে, খেতে ইচ্ছা না করলেও খাচ্ছে, রিং-এ ঝুলছে, লুকিয়ে লুকিয়ে শেভও করেছে দুই-তিনবার। হঠাৎ মাঈন কবিরের হাত চেপে ধরল—

    না না দোস্ত। তুই বল কী করন লাগব।

    কী লাগব? বাদলরে একটা কঠিন ঠ্যাঙানি দিবি আর কইয়া দিবি যেন আফরোজার পিছে না ঘোরে।

    ঠিক আছে।

    ঠিক আছে কইলে কাম অইব না। একশ’ টাকা দে, পোলাপান ঠিক করি, বিকালে মাইর দিই।

    এর মধ্যে স্কুল ছুটি দিয়ে দিল। কবির আর মাঈন গাছটার গোড়ায় দাঁড়াল। আফরোজা ওদের কাছাকাছি আসতেই কবির গিয়ে চিঠিটা আফরোজাকে দিল। মাঈন দেখল, চিঠিটা আফরোজা চট করে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে নিল। বেশ খুশি মাঈন। তারপর দুজনে আবার তোফাজ্জল মিয়ার দোকানে গিয়ে দারুচিনি আর এলাচ খেয়ে মুখের গন্ধ মেরে কবিরকে একশ’ টাকা দিয়ে চলে এলো বাসায়। বাসায় ফিরেই ভাবল, সিনেমার ছোট নায়ক-নায়িকারা কিভাবে প্রেম করে...! মাঈন সেভাবে নায়কের জায়গায় নিজেকে আর নায়িকার জায়গায় আফরোজাকে চিন্তা করতে লাগল। নাহ্, কেমন যেন মিলছে না। আফরোজা এখনই অনেকটা বড়। কী করে যে এত বড় হয়ে গেল? মাঈনও তো বড় হওয়ার জন্য কম চেষ্টা করছে না! অবশ্য লম্বা হয়েছে ও অনেকটা। মা তো সেদিন বলেছে— মাঈনের গলা একদম পাইল্টা গ্যাছে। এক্কেবারে হাবিবের মতন হইছে। শুনে বাবা বলছে— হাবিবের মতো গলা হইলেই কী হয়? লেহাপড়ায় তো হাবিবের পায়েরও যোগ্য না।

    মাঈন আফরোজাকেই বিয়ে করবে। দাদাটা বিয়ে করলেই হয়। সিনেমার মতো মাঈনরা গরিব না। মাঈনের বাবা ব্যাংকের ম্যানেজার আর আফরোজারা কী করে? ওর বাবাও অবশ্য গরিব না। বাজারে দুইটা দোকান আছে। তাতে কী?

    মাঈন গোসল করে খেয়ে পড়তে বসল। রেজাল্ট বেশ খারাপ হয়েছে। ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে। পরদিন স্কুল বন্ধ। মাঈন গেল স্কুল মাঠে খেলতে। কবির এসে জানাল— দোস্ত, বাদল গেছে আফরোজাগো পাড়ায়। চল মাইর দিয়া আহি।

    মাঈনও বেশ চঞ্চল হয়ে ব্যাট ফেলে কবিরের সাথে চলল। আফরোজাদের পাড়ায় গিয়ে দেখে বাদল সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। কবির ইশারায় বাদলকে কাছে ডাকল। বাদল কাছে এসে খানিকটা টিটকারির সুরে বলল—

    কী রে কোবরা তুই এইহানে কী চাস?

    কবির কিছু বলছে না দেখে একটু সাহস পেয়ে যায় বাদল। কবিরকে আবার বলে— শোন, আমরে এহন আর তুই তুই করবি না, আপনে কইরা কবি আমি তোর দুই ক্লাস সিনিয়র।

    তুই কইরা কমুনা, আপনে কইরা কমু? তুই গোলামের পুত আমারে কোবরা কইলি ক্যান?

    বাদল আচমকা কবিরের কলার চেপে ধরে বলল— ওই গালি দিলি ক্যান? গালি দিলি ক্যান? কবির ধুম করে বাদলকে এক ঘুসি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। মাঈন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। বাদল মাটিতে পড়ে থাকতেই মাঈন এসে বাদলকে ঘুসি মারতে শুরু করল আর বলতে লাগল— তুই আর আফরোজার পিছে ঘুরবি না হারামজাদা, ঘুরলে জানে খতম কইরা দিমু।

    কবির বাদলকে ক্রমাগত ঘুসি মেরেই চলেছে। নিচে শুয়ে বাদল ছটফট করছে। বাদলের নাক ফেটে রক্ত বের হতেই কবির আর মাঈন পালিয়ে গেল। পরপর তিন দিন মাঈন স্কুলে গেল না। ভয়ে ভয়ে ছিল কখন বাসায় নালিশ আসে। অসুস্থতার ভান করে ঘরে বসে রইল। তিন দিন পর আজ স্কুলে গেল মাঈন। বাদলও নাকি তিন দিন ধরে স্কুলে আসেনি। খবর পেয়েছে মাঈন। বেশ ভালোভাবেই ক্লাস করল। কোথাও কোনো গ-গোল নেই। তবে কবির আসেনি। স্কুল ছুটির পর মাঈন আফরোজার একটু পিছে হাঁটা শুরু করল। স্কুলের ব্রিজটা পার হওয়ার পর আফরোজা ব্যাপারিবাড়ির রাস্তা ধরল। ডাকবাংলোর কাছাকাছি আসতেই ওর গা কেমন ছমছম করে উঠল। কেউ নেই কোথাও। জায়গাটা বেশ নীরব। তাই দিনের বেলাও ভয় লাগে মাঈনের। হঠাৎ একটা গাছের আড়াল থেকে বাদল আর একটা ছেলে এসে ওর সামনে দাঁড়াল। একটা শীতল ¯্রােত ওর মেরুদ- বেয়ে নিচে নেমে গেল। বাদল বলল— কেমন আছ চান্দু?

    অন্য ছেলেটা খপ করে ওর কলার ধরে ওর নাক বরাবর একটা ঘুসি মারল। ভয়ে আর ব্যথায় মাঈন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

    যখন ওর জ্ঞান ফিরল, প্রথমে বুঝতে পারল না ও কোথায় আছে। পাশ ফিরতে গিয়ে টের পেল ওর শরীরের অনেকাংশেই প্রচ- ব্যথা। ঘাড় ঘুরাতে গিয়েও বেশ ব্যথা পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ওর চারপাশে আরো অনেকেই ওর মতো সারা শরীরে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছে। বুঝল এটা হাসপাতাল। একে একে সব মনে পড়ল।

    মাঈন, বাবা, তোর জ্ঞান ফিরেছে? মায়ের ডাকে স্মৃতি ফিরে পেল মাঈন। মা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল— তোকে কারা মেরছে বাবা? মাঈন কোনো কথা বলল না।

    বল বাবা, তোকে কারা এমন মেরেছে? কী করেছিলি তুই? মাঈন এবারও কোনো কথা বলল না।

    কথা বল বাবা। কারা মেরেছ তোকে?

    আমি চিনি না।

    কেমন কথা, চিনিস না। তুই দেখিসনি?

    না, হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে মারতে শুরু করেছে।

    তুই কাউকে চিনিসনি?

    এখন কথা বলো না মা, আমার খুব মাথা ব্যথ্যা করছে।

    আচ্ছা, ঠিক আছে।

    মাঈন মার খেয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিল। পথে যাওয়ার সময় দুজন মাঈনকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালের লোকজন স্কুলড্রেস দেখে ওর হেডমাস্টারকে খবর দেয়। তারা খবর দেয় মাঈনের বাসায়। বেশ মাথা ফেটেছে, ভেঙেছে নাকের হাড়। আর তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। পরেরদিন কবির এসে এক ভয়াবহ খবর দিল।

    দোস্ত, আফরোজার তো বিয়া ঠিক হইছে।

    কী কইলি তুই?

    হ, আফরোজার বিয়া ঠিক হইছে।

    ফাইজলামি করতাছস ব্যাটা?

    না দোস্ত, আল্লাহর কসম। আইজ সন্ধ্যায় বিয়া।

    কী করুম দোস্ত?

    আমি চিন্তা কইরা দেখছি কিছু করার নাই।

    আমি তো ওরে ছাড়া মইরা যামু।

    মাঈন একটা কথা চিন্তা কর— তোর লগে কি ওর বিয়া হওয়া সম্ভব?

    কেন সম্ভব না?

    তুই এহনও কত্ত ছোড, আর তোর বড়ভাইর-ই বিয়া হয় নাই।

    তাতে কী হইছে? সে যদি আমারে ভালোবাসে তাইলে আমার জন্য অপেক্ষা করব।

    দোস্ত, এইডা সিনেমা না। হ্যায় তো তোরে ভালোবাসে না। তুই এহনও ছোড। আর মাইয়া বড় হইয়া গেছে। হের বাপ তো হ্যারে বিয়া দিবই। আর মাইয়ারা আগে বড় হইয়া যায়, এইডাই নিয়ম। কষ্ট পাইস না দোস্ত। তোর লগে যার বিয়া হইব, দ্যাখ হে এহনও হ্যার মায়ের প্যাডে। আর আফরোজাও অত ভালো মাইয়া না। আমার জানামতে হে আরো তিনজনের লগে ভাব করে। তুই অনেক বেরেনি পোলা। বড় হইয়া আফরোজার চাইয়া কয়েকশ গুণ ভালো মাইয়া বিয়া করতে পারবি।

    মাঈন কোনো কথা বলে না। তার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। আফরোজার বিয়ে ঠিক হয়েছে এ কথা সত্যি। আজ সন্ধ্যায় বিয়ে। ছেলে ঢাকায় ব্যবসা করে। বেশ পয়সাওয়ালা। তিন-চার দিন পর মাঈন বাড়িতে এলো। মাথায় ছয়টা সেলাই দিয়েছিল, যা এখন প্রায় শুকিয়ে এসেছে; কিন্তু মনের ঘা শুকায়নি। তার কিশোর মনে দগদগ করছে এক বিরাট ঘা। সে-বছরে মাঈন আর ঘা শুকিয়ে উঠতে পারল না। নিয়মিত সিগারেট খেতে শুরু করল। বইপত্র ছুঁয়েও দেখছে না। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় তিন সাবজেক্টে ফেল করল। বাবা-মা মাঈনের চিন্তায় প্রায় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। হাবিব ঢাকা থেকে বারবার চিঠি লিখছে মাঈনকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য। মাঈনও যেতে ইচ্ছুক। অবশেষে সকলের সম্মতিতে ফাইনাল পরীক্ষার দুই মাস আগে মাঈনকে ঢাকায় নিয়ে গেল হাবিব। নিয়ে একটা কোচিং-এ ভর্তি করে দিল। বেশ মন দিয়ে পড়াশোনা শুরু করল মাঈন। আর ঢাকার নামকরা স্কুল বিএএফ শাহীন স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়ে গেল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুবছর পর শাহীন স্কুল থেকে ঢাকা বোর্ডে চতুর্থ হল সে। আর যেদিন রেজাল্ট দিল, সেদিনই কবিরের চিঠি পেল। চিঠির সবশেষে লিখেছে আফরোজার একটা বাচ্চা হয়েছে। পুরনো কথা মনে করে মাঈন দুঃখ করার বদলে একা একা হাসল। কী বোকাই-না ছিল তখন। এখন ভাবলে বেশ হাসি পায়। খুব সহজেই মাঈন নটর ডেম কলেজে চান্স পেয়ে গেল। আর সেখানে এসএসসি’র চেয়েও ভালো রেজাল্ট করল। মাঈন ঢাকায় এসে জানতে পারে হাবিব একটা হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। বাবা-মা কেউ মেনে নেবে না এই ভয়ে কাউকে জানায়নি। মেয়েটা বেশ সুন্দর। আগে নাম ছিল অঞ্জলি। হাবিবের সাথে বিয়ে করার পর নাম ধারণ করেছে খাদিজা। হাবিব-খাদিজা দুজনেই এখন ইন্টার্নি করছে। যে টাকা পাচ্ছে তা দিয়ে ভালো করেই তিনজনের সংসার চলে যাচ্ছে। খাদিজা মা হবে। মাঈন ভাবির প্রেরণায় বেশ ভালো করে লেখাপড়া শুরু করল।

    আজ মাঈনের ফ্লাইট। সে স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডন যাচ্ছে। কিন্তু বারবার দুচোখ ভিজে উঠছে। সবার কথা মনে পড়ছে। সবার কথা, বিশেষ করে হাবিবের মেয়েটার কথা। সে বারবার বলছে—

    কাকা তুমি কবে আসবা?

    এই তো মা কয়েকদিন পরেই।

    অবশ্যই ১২ই জুনের আগে আসবা। আমার জন্মদিনে তুমি না থাকলে আমি কেক কাটব না।

    সামনের ১২ই জুন ওর তিন শেষ হয়ে চার শুরু হবে। মাঈন সবাইকে কাঁদিয়ে আর নিজে কেঁদে চলে গেল। লন্ডনে গিয়ে দেখে সেখানকার জীবনকে যতটা সহজ ভেবেছিল ততটা সহজ না। দিনরাত শুধু পরিশ্রম করতে হয়। তবে এরা শ্রমের বেশ মূল্য দেয়। সরকার-স্বীকৃত যেকোনো প্রতিষ্ঠানে ১ ঘণ্টা কাজ করলেই সর্বনি¤œ সাড়ে পাঁচ পাউন্ড পাওয়া যায়। আর সর্বোচ্চের সীমা নেই। যা পায় তাতে ওর দিন খারাপ চলে না। একদিন দেশ থেকে বাবার চিঠি এলো। চিঠির সারসংক্ষেপ এরকম যে,

    মাঈনের বাবা মাঈনের ওপর প্রচ- রাগ করেছে; কারণ, মাঈন জানত যে হাবিব এক হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে, তারপরও কেন সে বাবাকে জানায়নি। মাঈনের বাবা হাবিবের সাথে সকল সম্পর্ক ছেদ করেছে। লোকে কী বলবে এই জন্য সে বড় ছেলেকে কাগজে-কলমে ত্যাজ্যপুত্র করেনি, কিন্তু মনেপ্রাণে ঠিকই করেছে। সে আর জীবনে কখনো ছেলের মুখ দেখতে চায় না। মাঈন যদি ওরকম কিছু করে তবে সে মাঈনেরও মুখ দেখবে না।

    মাঈন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল— সে আর জীবনে বাংলাদেশে যাবে না।

    ১৫ বছর পর...

    মাঈন গাড়ি নিয়ে হিথ্রো এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় করছে। বাংলাদেশ থেকে হাবিব আসবে দুই মেয়ে আর বউকে নিয়ে। কলেজে আজ তার দুটো ক্লাস ছিল। মাঈন এখানে একটা কলেজে পড়ায়। প্রায় পনেরো মিনিট হয়ে গেল ও এয়ারপোর্টে এসেছে, কিন্তু এখনো বিমান আসেনি। ল্যান্ড করার কথা আরো ১০ মিনিট আগে। এরকম তো কখনো হয় না। আবহাওয়া তো খারাপ না। হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ একজন ওর চোখ চেপে ধরল, হাতটা নরম। নিশ্চয়ই মেয়ে। কে হতে পারে?

    বল তো কে? একদম পরিষ্কার বাংলা। ও কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারল এটা আর কেউ না, চন্দ্রিমা।

    তোরা এসে গেছিস?

    চন্দ্রিমা হাবিবের বড় মেয়ে। এই ১৬ বছরে একদিনও এই মেয়ে মাঈনের সাথে কথা না বলে ঘুমায়নি। তাই কণ্ঠ শুনে চিনতে একটুও কষ্ট হয়নি।

    কোথায় সবাইকে দেখে মাঈন আনন্দ করবে তার বদলে মরাকান্না জুড়ে দিল। অবশ্য ও একা না, সবাই কাঁদল। বাসায় গিয়ে খাদিজার চোখ ছানাবড়া।

    তুই তো একদম সংসার পেতে বেশ সুখেই আছিস?

    কেন, তুমি কী ভেবেছিলে?

    না তোর ভাই ছাত্র অবস্থায় যেভাবে থাকত, আমি সেরকমই ভেবেছিলাম।

    মাঈন মেয়েদুটোকে দেখে একদম স্থির হয়ে গেল। কী সুন্দর হয়েছে! বড়টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসিতে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে। ছোটটা ভিকারুননিসা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করল। আর বাবা-মা দুজনেই বেশ বড় ডাক্তার। বেশ সুখের সংসার। শুধু এই সুখে নেই বাবা-মায়ের স্বীকৃতি। বাবা-মা এই দীর্ঘ ১৬ বছরে অগণিত চিঠি লিখেছে। তার মধ্যে লক্ষবার লিখেছে মাঈনকে বাংলাদেশে যেতে। মাঈনের একই কথা। বাংলাদেশে সেদিনই যাবে, যেদিন দুই ভাই সম্মানের সাথে স্বীকৃতি পাবে। রাতে খেয়ে-দেয়ে সবাই বসেছে। স্যাটেলাইটের সুবাদে সবাই মিলে বাংলাদেশের একটা চ্যানেল দেখছে। হঠাৎ চন্দ্রিমা বলে উঠল—

    কাকা, তোমার জন্য মেয়ে দেখে রেখেছি; এবার বাংলাদেশে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করাব।

    আচ্ছা মা। বিয়ে করব। কিন্তু আমি তো দেশে যেতে পারব না।

    কেন?

    তোর বাবাকে জিগ্যেস কর।

    ফাইজলামি বাদ দাও। যাবে তুমি... বাবা কী জানে? বাবা তুমি কী জানো?

    মাঈন এবার চল। কারণ, মা অসুস্থ। হাবিব বেশ মিনতি করে বলল।

    ঠিক আছে, যাব; কিন্তু বাবা তোমার কোনো অসম্মান করলে তো আমি সহ্য করতে পারব না।

    তোরা দুই ভাই যা না জানিস তার চেয়েও বেশি বোঝার চেষ্টা করিস এজন্য খারাপ লাগে। তোকে কে বলেছে অসম্মান করবে? বেশ রোষের সাথে বলল খাদিজা ।

    বেশি কথা না বলে পরশু চল।

    মাঈন অবাক হল, পরশু মানে? তোমরা কি পরশু যাওয়ার প্ল্যান করেছ নাকি?

    কিছু করার নেই ভাই। চন্দ্রিমার ভার্সিটি খোলা। যুথির কোচিং চলছে, আমাদের দুজনের কথা না হয় বাদ দিলাম।

    বাংলাদেশে ফিরে মাঈন একদম বোকা বনে গেলে। কী বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে। রাস্তাঘাট অনেক উন্নত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জ্যাম কমেনি।

    এয়ারপোর্টের কাছাকাছি থাকার কারণে মাঈনের বাসায় আসতে তেমন দেরি হল না। বাসায় যে এত বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তা মাঈন কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। বাসার দরজা খুলে দিয়ে মাঈনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন মাঈনের মা তাসলিমা বেগম। এরকম একটি ঘটনার জন্য মাঈন কোনোক্রমেই প্রস্তুত ছিল না।

    কেমন আছিস বাবা? কত্ত বড় হয়েছিস।

    এই তো ভালো, তুমিও তো একদম বুড়ি হয়ে গেছ। বাবা কোথায়? কেমন আছে বাবা?

    ভালো আছে। সবাই আছে। তুই আয়, ভেতরে আয়। ছেলের হাত ধরে ভেতরে নিতে নিতে তাসলিমা বেগম বললেন— কী রে হাবিব, তোর মুখটা এমন শুকনা লাগছে কেন?

    শোনো, মা যতবারই তার ছেলেকে দেখে ততবারই মনে হয় ছেলে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, নয়তো মুখটা শুকনা লাগছে।

    তোর অত পাকা পাকা কথা বলার দরকার নেই। চল তোর বাবার কাছে যাই।

    মাঈনের বিস্ময় ক্রমশ বাড়ছে। এত বড় বাড়ি। বাড়ির সাজসরঞ্জাম দেখে বোঝা যাচ্ছে, এরা চারহাতে টাকা কামায়। ঢাকার অভিজাত এলাকায় প্রকা- এক দোতলা বাড়ি। সদর দরজা ২৪ ঘণ্টা পাহারায় থাকে উর্দি পরা প্রহরী। উপরতলা আর নিচতলা মিলিয়ে ১৬-১৭ ঘর। বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজ-পড়–য়া দুই নাতনিকে নিয়ে হেমায়েত সাহেব আর তাসলিমা বেগম উপরতলায় ৩ ঘর জুড়ে থাকেন। খাওয়া-দাওয়া করতে তিনবেলাই ছেলে আর ছেলের বউ উপরে যায়। বৃদ্ধ দম্পতি কালেভদ্রে নিচে নামেন। হাবিব, খাদিজা, ড্রাইভার, কাজের লোক নিচতলায় আর গ্যারেজে থাকে। মাঈনের বিস্ময়ের প্রধান কারণ— সে জানত না যে, বাবা-মা ভাই-ভাবির সাথে থাকেন। বাবা-মায়ের থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হয় না যে, মাঈনকে বাবা-মাকে স্থায়ীভাবে থাকতে বলতে হবে, মনে হয় দীর্ঘদিন ধরেই তারা আছেন। হাবিবের স্ত্রী-সন্তানও যে পাকা অভিনেতা তা স্বচক্ষে না দেখলে সে বুঝতেই পারত না। পিতা-পুত্রের মানসিক মিলন হয়েছে তাও বছর গড়িয়েছে। আর এই মিলন ঘটিয়েছে হাবিবের কন্যাদ্বয়, কিন্তু এর মধ্যেও কমপক্ষে পাঁচশ’বার মাঈনের সাথে দুপক্ষেরই কথা হয়েছে, কিন্তু কেউই কিছু বলেনি। মাঝারি সাইজের রুমের ভেজানো দরজা ঠেলে মাঈন ভেতরে চোখ রেখে বিস্মিত হয়ে গেল। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে আধশোয়া হয়ে যিনি আছেন, তার সাথে মাঈনের দেখা হয়েছিল ১৬-১৭ বছর আগে। বাবার মুখশ্রী ছাড়া আর তেমন কোনো মিল নেই। এক-মুখ দাড়ি আর আধ-মাথা চুলের সবই পাকা। আর পেটটি অস্বাভাবিক রকমের বড়। ভুঁড়ির সাথে শরীরের অন্যান্য অংশের চর্বিও বৃদ্ধি পেয়েছে বেশ। তারপরও মুখের দাড়ি, মাথার টাক, ভুঁড়ি আর ১৭ বছরের দূরত্ব, রাগ, ক্ষোভ, অভিমান সবই পিতৃত্বের কাছে পরাজিত হল। মাঈন গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবাও তাকে বুকে জড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ অশ্রুপাত করল।

    তোমার পায়ে এ কী হয়েছে বাবা?

    আরে তেমন কিছু না, সিঁড়ি দিয়ে পড়ে মচকে গিয়েছে।

    মুখে তেমন কিছু না-বললেও পঙ্গু হাসাপাতালের অর্থোপেডিকের কাছ থেকে ঠিকই জেনেছে যে, হেমায়েত সাহেবের টিবিয়া দুইভাগ হয়েছে তার ফিবুলায় চিড় ধরেছে। আর সেই জোড়া লাগানোর ডাক্তার যখন নিজের সন্তান অবশ্যই সে বাবাকে বাড়িয়ে তো বলেইনি বরং হেমায়েত সাহেবের ধারণা পারলে খানিকটা কমিয়ে বলেছে।

    মাঈনের দিন-পনেরো চলে গেল ঢাকায় ওদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করতে করতে। দুই ভাতিজিকে নিয়ে সন্ধ্যায় ঢাকা শহর টই টই করে। প্রায় সপ্তাহ-দেড়েক পরে বসল পারিবারিক আলোচনা সভা, যার মধ্যমণি বা প্রধান অতিথি যা-ই বলি না-কেন সে আমাদের বিলেতফেরত মাঈন আর আলোচনার বিষয়বস্তু তার বিয়ে। লন্ডনে যাওয়ার পরে মাঈনের সাথে পরিচয় ঘটে সোফিয়া নামের এক আরব্য যুবতীর সাথে। দুইজনের ধর্ম, অধ্যয়নের বিষয় এক আর আবাসস্থল কাছাকাছি হওয়ায় তাদের বন্ধুত্ব হয় দ্রুত। আর এই বন্ধুত্বই একসময় দুইজনকে ভিন্ন স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্ন দেখায় সারাজীবন দুজনে পাশাপাশি থাকার, একজনের সুখে অন্যের সুখী হওয়ার কিংবা দুঃখে দুখি হওয়ার। চলছিলও বেশ ভালো।

    কোনো এক রাত্রিকালীন আহারের আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে মাঈন নারীজাতির আরেক রূপ দেখে সত্যি সত্যি প্রেম-ভালোবাসা চিরদিনের জন্য বিদায় দিয়েছে। হাজার পাউন্ড বেতনের কথা চিন্তা করে পড়ালেখায় আবার মন দেয় মাঈন; কারণ, সেদিন ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের প্রধান অতিথি মাঈন নয়, ছিল আসাদুল্লা নামের এক আরব্য তৈলকূপের মালিক। সোফিয়া পরে নিজমুখে স্বীকার করেছে যে, লন্ডনের এই কাঠখোট্টা যান্ত্রিক-জীবনে খানিকটা সময় ভিন্নভাবে কাটানোর উদ্দেশ্যেই সে মাঈনকে বেছে নিয়েছিল। বাল্যকালের প্রেমের অপমৃত্যু আর যুবক বয়সের প্রেমের পরিহাসের কারণে মাঈন মনে মনে ঠিক করেছিল বাকি জীবনটা নারী ছাড়াই কাটাবে। কিন্তু বাবা-মা যা বললেন তাতে মাঈন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। বাবা-মার কথাটা ছিল এরকম— অর্থের দৈন্যের কারণে মেয়েটার বিয়ে ধুমধাম করে দিতে পারেনি। বড় ছেলের বিয়ের খবর তো বাবা-মায়ের চেয়ে মাঈনই ভালো জানে। এখন শেষ ইচ্ছা তারা মারা যাওয়ার আগে মাঈনের বিয়েটা ঠিকঠাকমতো দেয়া। আর এতে যদি মাঈনের কোনোপ্রকার অনীহা থাকে তবে বুড়োবুড়ি দুজনেই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার আগেই নিজেদের ইচ্ছায় ইহধাম ত্যাগ করবে। অর্থাৎ আত্মহত্যার হুমকি!

    ঠিক আছে, তোমরা মেয়ে দেখো।

    সবার মধ্যে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। চন্দ্রিমা সবার আগে বলল— মেয়ে দেখতে হবে না। আমরা মেয়ে দেখে রেখেছি।

    কোথায়?

    ঢাকাতেই। চশমাটা মুছতে মুছতে বললেন হেমায়েত সাহেব।

    মেয়ে আমরা সবাই দেখেছি। দেখলে তোমারও পছন্দ হবে। আর তুমি এটা ভেবো না যে, তোমার জন্য একটা বদসুরৎ মেয়ে এনে সারাজীবন কথা শুনব। বলে একটু মুচকি হাসল খাদিজা।

    চন্দ্রিমার পছন্দ আছে বটে। এরকম আরো বিবিধ মন্তব্যে বিয়ের আলোচনা এগিয়ে চলল। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, একমাত্র মেয়ে নওশিন কুমিল্লা থেকে কাল এলেই সবাই মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে যাবে। আর সেইদিন মেয়ের বাড়িতেই বিয়ের দিন ধার্য হবে।

    পরেরদিন দুপুর বারোটায় নওশিন তার চুয়েটে পড়–য়া ছেলে জামিল আর স্বামী লে. কর্নেল বাসেদকে নিয়ে হাজির। এসেই কান্নাকাটির রোল। পরেরদিন সকাল ৯টায় সবাই রওনা দিল মেয়ে দেখতে। কিন্তু বাদ সাধল মাঈন। সে মেয়ে দেখতে যাবে না, যাবে না তো যাবেই না।

    তোমরাই যাও। আমি আবার গিয়ে কী করব?

    তুই বিয়ে করবি আর তুই মেয়ে দেখবি না, এটা কেমন কথা? নওশিনের কণ্ঠে রাগ ও বিস্ময় দুটোই প্রকাশ পেল।

    একসময় চন্দ্রিমাও অনুরোধ করতে এলো।

    চলো কাকা প্লিজ। আর তুমি না গেলে আমিও যাব না।

    তোর যাওয়ার দরকার আছে বলে তো আমি মনে করি না। তুই-ই নাকি সবার আগে মেয়েকে দেখেছিস।

    আচ্ছা ঠিক আছে, যাব না।

    শেষপর্যন্ত জামিল বলল— সেও যাবে না। উপায় না দেখে পা ব্যথার কারণে হেমায়েত সাহেব আর গোঁয়ার্তুমির কারণে বিয়ের পাত্র, ঘটক চন্দ্রিমা, ও ভাগনে জামিল বাদে সবাই ২টি গাড়িতে পাত্রীর বাড়িতে রওনা দিল। সবাই চলে যাওয়ার পর মাঈন হঠাৎ চন্দ্রিমার চুল ধরে বলল—

    কী ব্যাপার হ্যাঁ? কাল জামিল আসার পর এত খুশি কেন? তুই যাবি না, অমনি জামিলও যাবে না। বলি, ব্যাপারখানা কী হ্যাঁ?

    কই কাকা? কিছু না তো। তুমি আবার কিসের মধ্যে কী খুঁজছ? চন্দ্রিমার কণ্ঠে কৃত্রিম বিস্ময়।

    আমার সাথে মামদোবাজি না? সত্যি কথা বল।

    আরো জোরে চুলে টান দিল মাঈন। তিনজন মিলে এরকম খুনসুটিতে কাটিয়ে দিল সারাদিন। আসরের কিছু আগে সবাই হাজির। ভাবভঙ্গিতে বোঝা যচ্ছে সবাই বেশ খুশি। সবারই মেয়ে পছন্দ হয়েছে। এখন মাঈন ডানে-বাঁয়ে নয়, তার মাথা উপর-নিচ করলেই কেবল বিয়ের তারিখ দেয়া সম্ভব।

    মাঈন তুই যদি মেয়ে দেখতে চাস তো দেখতে পারিস। আর না হলে এবার সবাই মিলে তারিখ দিয়ে দিই। বললেন কর্নেল। তবে একটু তাড়াতাড়ি করলে খুশি হব; কারণ, আমি থাকতে খুবই আগ্রহী; কিন্তু আমি সরকারি চাকরিজীবী। হাতে কোনো ছুটি নেই।

    আমি আর কী বলব। আপনারাই দিন দেখে ঠিক করুন।

    সবার মধ্যে আনন্দের বন্যা পুনরায় প্রবাহিত হল ঠিকই কিন্তু নওশিন শুরু থেকেই খুঁতখুঁত করে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর চা খেতে খেতে নওশিন বলল— মেয়ের বয়স তো খুবই কম। চন্দ্রিমার সাথে পড়ে। মাঈনের অর্ধেক। মানতে পারবে ওরা শেষপর্যন্ত?

    আরে ধুর এটা একটা বিষয়? আজকাল কেউ ভাবে নাকি এসব? বললেন তাসলিমা বেগম।

    এমনিতেই রাজি হয় না, তুই আবার একটা ফাও ইস্যু তুলিস না নওশিন।

    ঠিক আছে, তোমরা যা ভালো মনে কর।

    রাতে খাওয়ার টেবিলে সিদ্ধান্ত হল পরশু অর্থাৎ শুক্রবার বিয়ে। সারা বাড়িতে উৎসবের আমেজ। সবাই এদিক-সেদিক ফোন করে যাকে দরকার দাওয়াত দিচ্ছে। সেই রাত্রেই নওশিন, কর্নেল আর খাদিজা গেল কার্ড ছাপাতে। মাঈনের ভাতিজি, ভাগ্নি যে যেভাবে পারছে ঘরদোর সাজাচ্ছে। হাবিব ফোন করে উত্তরার একটা অভিজাত চায়নিজ রেস্টুরেন্ট ঠিক করল। শুক্রবার সকালে গায়েহলুদ হয়ে গেল। জুমার পরে সবাই গেল মেয়ের বাড়িতে। সেখানেও আরেক উৎসব। যে যেভাবে পারছে আনন্দ-ফুর্তি করছে। চন্দ্রিমা গেল মুক্তার কাছে, গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল— কী রে দোস্ত, বলছিলাম না তোরে আমার চাচি বানাব। কি এবার হল তো? 

    মুক্তা কেঁদে ফেলল।

    আরে কাঁদছিস কেন? বিস্মিত হল চন্দ্রিমা।

    আমার মা কোথায় চন্দ্রি?

    নিজের বান্ধবী ও চাচিকে কিভাবে চন্দ্রিমা সান্ত¡না দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। মুক্তার মা তিন বছর হল ওকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। যা আজও মুক্তাকেই শুধু না, নিকটস্বজন সবাইকে কাঁদায়। মরার বছর-দুয়েক আগে ব্লাডক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথম থেকেই চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হয়নি। শেষপর্যন্ত মাদ্রাজে মারা গেলেন। এত অল্পবয়সে প্রস্থান কেউই সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। বিয়েবাড়ির উৎসবে হঠাৎ যেন একটি শোকের ঢেউ উঠল।

    সেদিন সন্ধ্যায় এক আলোকসজ্জিত মনোরম পরিবেশে বিয়ে সম্পন্ন হল। বিয়ের একপর্যায়ে যখন আয়নায় একে-অপরের মুখ দেখাদেখির পালা তখন মাঈন চন্দ্রিমার কানে কানে বলল— সে বাসরঘরে ছাড়া তার বউ দেখতে চায় না। তথাস্তু। রাত দুইটায় পুষ্পসজ্জিত মোটরযানে নতুন বউ নিয়ে মাঈন বাড়ি ফিরল। বাসরঘরের সব ধরনের রসিকতা ও আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন মাঈনের বাসরঘরে প্রবেশের সুযোগ ঘটল, তখন রাত তিনটার কাছাকাছি। এবার সে বউ দেখবে। সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত এখন। সেই মুহূর্তের জন্য হয়তো সকল পুরুষই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। মাঈন বাসরঘরে প্রবেশ করতেই মুক্তা এসে মাঈনের পা ছুঁয়ে সালাম করে আবার গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল। মাঈন কিছু বুঝে উঠতে পারল না। মনে মনে ভাবল বাসররাতে মনে হয় এটাই নিয়ম। মাঈনেরও উচিৎ মুক্তাকে সালাম করা? মাথার পাগড়িটা ওয়ারড্রোবের উপরে রেখে পাশে গিয়ে বসল।

    কেমন আছ তুমি?

    ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?

    হ্যাঁ।

    এরপর মাঈনের কী বলা উচিৎ বুঝতে পারছে না। সে যতদূর জানতে পেরেছে তার স্ত্রী নাকি তার ভাতিজির বান্ধবী। অর্থাৎ মাঈনের কাছে নিতান্তই বালিকা। মাঈন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে বলল— 

    তুমি কি তোমার ঘোমটা একটু সরাবে?

    মুক্তা কোনো কথা বলল না। মাঈন আরো কাছে গিয়ে নিজেই ঘোমটা সরাল। এরপর হাত দিয়ে মুখটা তুলতেই একটা ৩৩০০ ভোল্টেজের শক খাওয়ার মতো ছিটকে সরে এলো। মুক্তাও হতভম্ব হয়ে গেল। মাঈন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ কিভাবে সম্ভব? মাঈন আবার ফিরে তাকাল নতুন বউয়ের দিকে। নাহ্, ওই একই মুখ। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? মাঈনের নতুন বউয়ের আসনে বসে আছে তার কিশোর-বয়সের প্রেম, যার জন্য ওই সময়ে সবকিছু করতে পারত। মনে মনে ভেবেছিল যে, তাকে বিয়ে করতে না পারলে হয়তো বাঁচবে না। কিন্তু ও এখানে এলো কী করে? আর ভুলও তো হওয়া সম্ভব না। মাঈনের বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না কিছুতেই। সেই নাক, সেই চোখ, সেই ঠোঁট, সেই চাহনি...

    আবার তাকিয়ে দেখল মাঈন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসরঘরেও মাঈন ঘামতে শুরু করল। নাহ্, আফরোজাই বসে আছে ওর বউয়ের আসনে।

    আচ্ছা, তোমাদের দেশের বাড়ি কোথায়?

    ময়মনসিংহ ফুলপুর।

    তোমার বাবার নাম কি আনিসুজ্জামান জোয়ারদার?

    কী বলছেন আপনি? তিনি তো আমার নানা হন।

    ওহ্ মাই গড। তোমার মায়ের নাম কি আফরোজা ইসলাম?

    হ্যাঁ, কেন?

    না, এমনি। 

    মাঈন হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল। বারান্দায় গিয়ে নিজেকে ইজি চেয়ারে সঁপে দিয়ে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করতে লাগল।

    হঠাৎ আজানের শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেল মাঈন। কিছু সময় পর একটা হাতের স্পর্শে ও চমকে উঠল।

    আজকাল শেষরাতে ঠা-া বাড়তে শুরু করেছে, চলুন ভেতরে চলুন।

    মাঈন বাধ্যছেলের মতো মুক্তার পেছনে পেছনে পুনরায় বাসরঘরে প্রবেশ করল।

     


    No comments