ব্যাড ইকোসিস্টেম ।। সাইফুল বাতেন টিটোর ছোটোগল্প
আজকেও কেবিন ম্যানেজ করা সম্ভব হল না। চোখেমুখে একটা শক্ত ভাব এনে আব্বার বেডের পাশে বসে আছে তারেক। ‘তারা কী বলেছে? কেবিন কি আদৌ দেবে না? না এখানেই থাকতে হবে আব্বাকে? এখানে এভাবে থাকলে তো সুস্থ মানুষও মরে যাবে...!’ আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে তারেক আব্বার মাথায় হাত দিয়ে জিগ্যেস করল— আজ আর জ্বর আসছিল? ‘না, কালও আসে নাই। দেখ কাল টেস্টের রেজাল্ট কী পাওয়া যায়। তারপর আমারে তোরা বাড়ি পাঠাইয়া দে। এখানে থাকা সম্ভব না। এটা হাসপাতাল না গোয়ালঘর? টয়লেটে যে কয়বার গেলাম দুর্গন্ধের ঠ্যালায় আমার প্রতিবার বমি হইল। এইহানে থাকলে আমার অন্য কোনো রোগ হইয়া যাইব।’ বলে আব্বা হাঁপাতে লাগলেন।
এসব কথার কোনো জবাব হয় না। আজ চার দিন হল আব্বা হাসপাতালে ভর্র্তি। একটা সরকারি হাসপাতাল। আম্মা সব সময় থাকলেও বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, ওষুধ আনা, টেস্টের জন্য দৌড়াদৌড়ি এসবের জন্য মায়ের সাথে একজন মানুষ থাকা দরকার। বিশেষ করে রাতে। মায়ের নিজের শরীরের অবস্থাও তেমন ভালো না। গত চার রাতের এক রাতও আমি থাকতে পারিনি বলে সবাই আমার ওপর একটু রাগ করেই আছে ভেতরে ভেতরে। আমি আর আমার বউ দুজনেই ব্যাংকে চাকরি করি। দুজন দুই ব্যাংকে। এখন চলছে আমাদের জুন ক্লোজিং। ওদিকে একমাত্র মেয়ের চলছে পরীক্ষা। ফলে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হয়নি। প্রথম দিন থেকেই আমরা আমাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আব্বার জন্য কেবিন ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। আব্বা রিটায়ার্ড শিক্ষক। আমাদের সাথে সাথে আব্বার অনেক হোমড়া-চোমড়া ছাত্রও কম চেষ্টা করেনি, কিন্তু পাওয়া যায়নি। আম্মার থাকতে খুব কষ্ট হয়। ফ্লোরে পাটি পেতে ঘুমানো খুব কষ্টকর। এই ওয়ার্ডে মোট বিশটা বেড। সব বেডেই রোগী আছে। আর প্রত্যেক রোগীর সাথেই একজন-দুইজন করে আত্মীয়স্বজন রয়েছেই। ফলে লোকে লোকারণ্য বলা চলে। সারাদিন হাউকাউ, চিল্লাচিল্লি, কান্নাকাটি, শিশুর চিৎকার সব মিলিয়ে একটা নারকীয় পরিবেশ বিরাজ করে। রাত গভীর হওয়ার আগে আর শান্তি নেই। আগামী দুই দিন আমার ছুটি। তাই আজ আর আগামী রাতে আমি থাকব আব্বার সাথে। আব্বা যখন বুকে ব্যথা আর প্রচÐ জ্বর নিয়ে এসে ভর্তি হয়েছিলেন, তখন আমরা সবাই খারাপ কিছুই আশঙ্কা করেছিলাম। এখন এই চারদিনে তো বেশ সুস্থ হয়েছেন। আগামীকাল কয়েকটি টেস্টের রেজাল্ট হাতে পাব। খারাপ কোনো কিছু না-হলে তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সন্ধ্যার পর আমি আর আম্মা রইলাম আব্বার সাথে। মা আব্বার বেডেই বসে আছে। আমি একটা লাল রঙের টুলে বসে ফেসবুকে মন দিলাম। আব্বা-আম্মা গ্রামেই থাকেন। আমরা তিনভাই ঢাকায় থাকি। মেঝভাই তারেক একটা টিভি চ্যানেলে চাকরি করে আর ছোটটার বিএসএস-এ শিক্ষা ক্যাডারে হয়েছে, নিয়োগের অপেক্ষায় আছে। অনেকদিন পর আমি মা-বাবা আলাদা করে একত্রিত হলাম। মা অনেক কথা বলল। বাবা কিছু স্মৃতিচারণ করলেন, বড় ছেলে হিসেবে আমাকে কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন তাঁর মৃত্যুর পরের সময়ের জন্য। মা শুরু থেকে কতক্ষণ পর পর এটা খা, ওটা খা করছে। আমি হাসপাতালে খেতে পারি না। কেমন যেন ঘেন্না ঘেন্না লাগে। আব্বা হাসপাতালের দেয়া খাবার খায় না। কোনো বেলা আমার বউ, কোনো বেলা তারেকের বউ বাসা থেকে রান্না করে পাঠায়। অন্যদিকে সারাদিনে আব্বার যত ছাত্র আসে সবাই কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসেই। গুঁড়োদুধ, ফল, জেলি, রান্না-করা খাবার কত কী? অথচ আব্বার এমন ডায়াবেটিক যে রেগুলার ইনসুলিন নিতে হয়। ডাক্তারের বেঁধে-দেয়া খাবারের বাইরে কিছু খাওয়ার উপায় নেই। মাও গ্যাস্ট্রিকের রোগী হওয়ায় তার খাবারও নির্ধারিত। ফলে হাসপাতালে-আসা খাবারগুলো নষ্টই হয়। মেডিসিন টেবিলে ফল, আব্বার মাথার কাছে হরলিক্স, পায়ের কাছে দামি কেক, খাটের নিচে ডাবের কাঁদি ইত্যাদি ইত্যাদি। খাবারগুলো ক্রমাগত নষ্টই হচ্ছে। কে খাবে এত খাবার? তারেক যাওয়ার সময় দেখলাম, মা জোর করে ওকে ব্যাগ ভরে কী কী যেন দিয়ে দিল। মা বারবার বলছে— না নিলে নষ্ট হয়ে যাবে। এত দামি দামি খাবার-দাবার নষ্ট করে লাভ কী? তারেকের একমাত্র ছেলের বয়স দেড় বছর। অতটুকু বাচ্চা আর কী খাবে? মাকে বোঝাতে চাচ্ছে তারেক। শেষ পর্যন্ত ওকে নিতেই হয়েছে। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় দেখলাম, মা আমার বউকেও এভাবেই কী কী যেন দিয়ে ছিল। এখন ফলের মৌসুম। না খেলে নষ্ট হয়ে যাবে। আমার বাসায়ও যে খাওয়ার খুব মানুষ আছে তা নয়। মায়ের কথা— ফ্রিজ তো আছে। এগুলো নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচা। ঢাকায় আব্বার ছাত্র-ছাত্রী অনেক। যে-ই আসে কিছু না কিছু নিয়ে আসে। কাউকে তো আর নিষেধ করা যায় না। কে কখন আসবে, কে জানে! মায়ের জোরাজুরিতে আমি একটা আপেল খেতে খেতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বারান্দার শেষমাথায় গিয়ে ডানপাশে বাথরুম। সেখান থেকে দুর্গন্ধ আসছে। হঠাৎ ধুপ করে কোনো কিছু পড়ার শব্দ শুনে আমি বাথরুমে দৌড়ে গেলাম। দেখি, আব্বার বেডের দুই বেড পরে অতিবৃদ্ধ ও অতি-অসুস্থ রোগীর ৮-৯ বছরের অ্যাটেনডেন্ট। মেয়েটি ফ্লোরে পড়ে কাতরাচ্ছে, পাশে একটা সবুজ রঙের বালতিতে একবালতি পানি। ‘আহা ওঠো, কিভাবে পড়ে গেলে’ বলে আমি মেয়েটির বাহু ধরে তুলতে গিয়ে আমার হাতে ঠেকল প্রায় পাটকাঠির মতো হাড়! এত শুকনো মানুষ হয়? মনে হল সেখানে চামড়া ছাড়া কিছুই নেই। দেখলেই বোঝা যায় ভয়ংকর পুষ্টিহীনতায় ভুগছে শিশুটি। এ আবার এক রোগীর অ্যাটেনডেন্ট? এই মেয়ে একবালতি পানি তুলবে কী করে? আমি ওকে আগেও দেখেছি। আজ সন্ধ্যার কিছু পর ও ওর বাবাকে খাওয়ানোর জন্য খুব জোরাজুরি করছিল।
তোমার নাম কী?
সুমি
রোগী তোমার কে হন?
আব্বা।
আমি একটু অবাকই হলাম। এই বৃদ্ধের এত ছোট মেয়ে হয় কী করে? ভাবলাম, হতে পারে তার বয়স যতটা দেখায় ততটা নয়। অসুস্থতা মানুষের বয়সকে বাড়িয়ে দেয় অনেক সময়।
তুমি এই বালতি ভরে পানি নিতে পারবে না, আবার পড়ে যাবে, ব্যথা পাবে। পানি অর্ধেক ফেলে দিয়ে তারপর নাও। —মেয়েটি তাই করল। আমার ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল। আমার মেয়েটার বয়সিই হবে। অথচ কত্ত আদর-যতেœ থাকে আমার রাজকন্যা! দেখতে বরং ওর চেয়ে বড়ই লাগে। আমি ফিরে এসে টুলে বসে ফেসবুকিং শুরু করলাম। আজ সারারাত হয়তো এই করেই আমাকে পার করতে পবে। রাত দশটার মতো বাজে। ওয়ার্ডের কোলাহল খানিকটা কমে এসেছে। মা এশার নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে তসবিহ গুনছে দেখলাম। কিছু সময় পরে একটা সিগারেট খাব বলে উঠলাম। আমাকে বের হতে হলে সুমির বাবার বেড পার হয়ে বের হতে হবে। আমি যাওয়ার সময় দেখলাম, সুমি একটা প্লেটে অনেকগুলো ভাত নিয়ে কী একটা তরকারি দিয়ে বেশ বড় বড় নলা তুলে গোগ্রাসে খাচ্ছে। মুখে ঠেসে ভাত ঢোকানোর কারণে কিছু ভাত আবার প্লেটে পড়ছে। ওর বাবা উল্টো দিকে ফিরে মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে। ওর চোখে আমার চোখ পড়তে কেমন একটু লজ্জা পেল। আমি সিগারেট খেতে চলে গেলাম। ফিরে এসে দেখলাম, নার্স বেডে বেডে ওষুধ দিচ্ছে আর নিয়মকানুন বলছে। কিছু সময় পর মা ফ্লোরে পাটি পেতে শুতে শুতে বলল— পাশে শুয়ে পড়। সারারাত কি টুলে বসে থাকবি?
আচ্ছা আপনি ঘুমান, আমি আছি। দরকার হলে আমি শোব।
আমি আবার টুলে বসে ফেসবুকে ডুবে গেলাম। এই জিনিস মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখতে পারে। আমিও কাজের ফাঁকে থাকি। এই যা। রাত বারোটার দিকে পুরো ওয়ার্ড নীরব হয়ে গেল। ডানপাশের শেষদিকের বেডের এক মুরুব্বি তার ছেলে কিংবা মেয়ের জামাইয়ের সাথে জমিজমা নিয়ে কথা বলছে। হাসপাতালে এই তিন-চার দিনে কয়েকবার আসার ফলে রোগীর বেডের কাছে এই জমিজমা-সংক্রান্ত আলাপ আগেও শুনেছি। দ্বিতীয় দিন আব্বার পাশের বেডের এক মরমর রোগীর ছেলেমেয়েরা দেখলাম মারামারি করার মতো অবস্থা! আমরা তো অবাক! মানুষ এমন কেন হয়? লোভ আমাদের অন্যকে মরতেও বাধা দেয়। হঠাৎ সুমি আর ওর বাবার কথা মনে পড়তেই দেখলাম, ওর বাবা শুয়ে আছে। ক্যাথেটার লাগানো আছে আগের মতো। সুমিও নিচে শুয়ে আছে। আব্বাকে নিয়ে যেদিন হাসপাতালে এসেছি সেদিন থেকে তাকে ওই অবস্থাতেই দেখছি। কতদিন ধরে আছে, কে জানে? এই বেচারার দেখলাম, এই একরত্তি সুমি ছাড়া জগতে আর কেউ নেই। একসময় কোনের মুরুব্বির জমিজমার আলাপ শেষ হল। মোবাইলে দেখলাম রাত দেড়টা। চোখ কেমন যেন লেগে আসছে। বসতে বসতে মাজা ব্যথা হয়ে গেছে। কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়? মা আমার জন্য যথেষ্ট জায়গা রেখেই শুয়েছে। আমি মায়ের পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার মুখ সুমির বাবার বেডের দিকে ফেরানো। পুরো ওয়ার্ডে দুই মাথায় দুটো হলদে লাইট জ্বলছে। সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায় না। শুয়ে ঘুম আসছে না। কানের কাছে মশার প্যানপ্যানানি শুরু হল। পায়ের কাছে একটা আর মাথার কাছে একটা মোট দুটো কয়েল জ্বলছে, কিন্তু মশারা কিছুতেই গ্রাহ্য করছে না। চেষ্টা করছি মটকা মেরে পড়ে থাকতে। একসময় দেখলাম সুমি শোয়া থেকে উঠল। ওর বাবার মাথার কাছ থেকে ওষুধ নিল। অনেক ওষুধ খেতে হয় ওর বাবাকে। আমি ভাবলাম, সুমি হয়তো ওর বাবাকে ওষুধ খাওয়াবে। দেখলাম ওষুধগুলো একটা কাগজে পেঁচিয়ে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেল। ভাবলাম, ও হয়তো খাওয়ানোর নিয়ম ভুলে গেছে বলে নার্সের রুমে গেছে নিয়ম জানতে; কিন্তু খেয়াল করলাম, বেশ কিছু সময় পর সুমি খালি হাতে ফিরে এসে শুয়ে পড়ল। আমার কাছে বিষয়টা একটু খটকা লাগল। আমি ঘুমের আশায় কয়েলটা আরেকটু মাথার কাছে এনে চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে পড়ে রইলাম। এপাশ-ওপাশ করে করে মশার কামড়ে শরীর ফুলিয়ে আজানের কিছু আগে চোখ বুজলাম। দিনের আলো ফুটতেই শুরু হল হাউকাউ। আমি বাসার দিকে রওনা দিলাম। ছুটির দিন, ঘুমাব।
পরেরদিন আমি আর আমার বউ আব্বা-আম্মার জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে আটটার দিকে হাসপাতালে হাজির হলাম। গিয়ে যে সুখবরটা শুনলাম সেটা হল, আব্বার কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। সুতরাং আব্বার ডিসচার্জ হতে কোনো বাধা নেই। এখন ডাক্তার ছুটি দিলেই আব্বা বাড়িতে যেতে পারবে। আমাদের সকলের বুকের ওপর থেকে পাথর নেমে গেল। আব্বা খুব কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। এখন আমরা চাকরি করছি। সামনে আমদের কত সুন্দর সময় আসছে, এখন আব্বা কেন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন? কতই-বা বয়স আব্বার? ৬৫! ৭০! এ আর এমন কী বয়স? আমার দাদা বেঁচে ছিলেন একশ’ আট বছর। সমস্যা হল আমার বউ ফেরার সময়। কাল আব্বার রিলিজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মা হাসপাতালে এখনো যে খাবার আছে তা মলিকে দিয়ে দিতে চাচ্ছে। মলি বলছে, বাসায় খাওয়ার কেউ নেই। আর মা বলছে, এগুলো তাহলে ফেলে দিতে হবে। অগত্যা মলিকে তিনটা হরলিক্স, কেজি পাঁচেক আম, দুই ফানা কলা, আপেল, জেলি ইত্যাদি নিয়ে সিএনজিতে চড়ে ফিরতে হল। মলি চলে যাওয়ার পর আমরা তিনজন বসে গল্প করছি, এমন সময় সুমি এসে মায়ের কাছে লবণ চাইল। দেখলাম, সুমির বাবা খাচ্ছে। তৃপ্তি নিয়েই খাচ্ছে। মনে হচ্ছে আগের চেয়ে খানিকটা সুস্থ হয়েছে। ওর বাবা খাওয়া পুরোপুরি শেষ না করে দেখলাম, ওকে মাখানো ভাতসহ প্লেটটা এগিয়ে দিল। সুমি চেটেপুটে খেয়ে প্লেট আর আরো কিছু তৈজসপত্র নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। ওর ধোয়া-মোছা শেষ হলে আমি ওকে হাতের ইশারায় বারান্দায় ডাকলাম।
তোমার বাবার এখন কী অবস্থা?
আগের মতোই...
একটুও সুস্থ হয়নি?
মাঝেমধ্যে ভালো হয় আবার খারাপ হয়।
তোমাদের বাসা কোথায়?
কড়াইল বস্তিতে।
তোমাদের বাসায় আর কেউ নেই? তোমার মা কোথায়?
মারা গেছে।
সুমি এই রোগীর দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। সে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে জীবনযাপন করত। তার প্রথম স্ত্রীর ছেলেমেয়েরা অনেক বড় বড়। তারা সবাই গ্রামে থাকে। তাদের কারো সাথে যোগাযোগ নেই বৃদ্ধের। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর সে বিয়ে করে সুমির মাকে। সে-ও কবে মারা গেছে তা সুমির জানা নেই। ও জন্মের পর যাকে মা হিসেবে দেখেছে, একটু বড় হওয়ার পর তার নির্যাতন আর অবহেলায় খুব অল্পদিনের মধ্যেই ও বুঝে ফেলে এটা আপন মায়ের আদর না।
তোমার সেই মা কোথায় এখন?
আব্বার অসুখ বাড়ার পর এক রিসকাওয়ালার লগে ভাইগ্যা গেছে।
বুঝতে পারলাম, এখন এই বাবা-মেয়ে একজন অন্যজনের অবলম্বন। আজরাইল আর ডাক্তার দুইজনই তাদের ইচ্ছাপূরণে ব্যস্ত। তবে এটা ঠিক যে, এই বৃদ্ধ চলে গেলে মেয়েটির জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আচ্ছা তখন কোথায় যাবে মেয়েটি? কে নেবে ওর দায়িত্ব? কোথায় থাকবে? কী খাবে? ও একটা কিশোরী মেয়ে। আর বড়জোর বছর তিনেক, তারপরই তো ওর শরীরে নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করবে। তখন কী অবস্থা হবে ওর? এই পৃথিবীতে কি সুমি আদৌ কোনোদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারবে? আগামীকাল আব্বা হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাবে। মা সবকিছু গোছগাছ করে এগারোটার দিকে শুয়ে পড়ল। আমারও শরীরটা বেশ ক্লান্ত। আসার আগে বাসা থেকে খেয়ে এসেছি। আমি গেটের বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে এসে চুইঙ্গাম চিবোচ্ছি আর ফেইবুকিং করছি। মুখের গন্ধ চলে গেলে শুয়ে পড়ব। ঘণ্টাখানেক পর আমার কেমন যেন একটু ঝিমুনি এলো। গতকালের মতো সুমির বাবার বেডের দিকে মুখ করে মায়ের পাশে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু শোয়ার পরে দেখলাম আর ঘুম আসছে না। বেশি জ্বালাচ্ছে মশা। কয়েলগুলো কাছাকাছি এনে আবারও মটকা মেরে রইলাম। সুমির বাবা মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে। সুমি নিচে শুয়ে আছে। ঘুমাচ্ছে না জেগে আছে বোঝা যাচ্ছে না। আমার ভাবনাটা কেবল ঘুরেফিরে ওর ভবিষ্যতের দিকেই যাচ্ছে।
একসময় টের পেলাম সুমি বিছানা ছেড়ে উঠল। আবার গতকালের মতো বাবার মাথার কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আজ আমি চুপি চুপি ওর পিছু নিলাম। ও করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে। আমিও একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব নিয়ে চলছি পিছুপিছু। একসময় ও একটা রুমের সামনে এসে থামল। দরজায় বারদুয়েক টোকা দিতেই এক মহিলা বেরিয়ে এলো, বয়স পঁয়ত্রিশের উপরে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, আমি মহিলাকে কোথায় যেন দেখেছি, কিন্তু মনে করতে পারছি না। দেখলাম, সুমি ওর হাতের কাগজের দলাটা মহিলার হাতে দিল। সে সেখান থেকে দুয়েকটা ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল সুমির হাতে ফেরত দিয়ে বলল— তোরে এইগুলা আনতে একবার নিষেধ করছি না? এইগুলা বাইরে চলে না। এরপর মহিলা ভেতরে চলে গেল আর সুমি দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। মিনিটখানেক পর মহিলা হাতে একটা গোল লাল বাটি নিয়ে এসে সুমির হাতে দিল। তখন আমি করিডোরের হলদে আলোয় মহিলার মুখটা আবার দেখলাম এবং চিনতে পারলাম। আব্বাকে ভর্তি করাতে যেদিন এসেছিলাম, সেদিন এই মহিলা শুভাকাক্সক্ষীর রূপ ধরে এসেছিল আমাদের কাছে। বারবার জানতে চাইছিল আমাদের কিছু এক্সট্রা লাগবে কিনা। এক্সট্রা বালিস, মশারি এমনকি কোনো দুর্লভ ওষুধ দরকার হলেও তাকে জানাতে বলেছে। যখন তারেক জানতে চাইল সে কে, হাসপাতালের সে কী, তখন সে কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারায় শুনলাম তারেক বিড়বিড় করে বলছে, ‘দালাল!’ এদের দৌরাত্ম্য সব হাসপাতালে। একবার সংবাদে দেখেছিলাম, এদের কাছ থেকে নাকি হাসপাতালের মহাপরিচালক পর্যন্ত ভাগ নেয়! সত্য-মিথ্যা জানি না। সুমি বাটিটা নিয়ে ওয়ার্ডের দিকে রওনা দিলে আমি আবার থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। চুপি চুপি মায়ের কাছে গিয়ে সুমির বাবার বেডের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, সুমি সেই মহিলা দালালের দেয়া লালবাটিতে ভাত খাচ্ছে। ক্ষুধার্ত শিশুরা খেলাশেষে মায়ের আদরমাখা বকুনির সাথে যেমন হাপুস-হুপুস করে খায়। আমার বুকটাকে একটা অদৃশ্য গজাল এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল। আমি সহজে কাঁদি না, কিন্তু ওইসময় আর চোখের পানি কোনোভাবেই আটকাতে পারলাম না। হাসপাতাল থেকে যা খাবার দেয়া হয় তা শুধুই সুমির বাবার জন্য। সুমির জন্য তো আর খাবার দেয়ার নিয়ম নেই, কিন্তু সুমিকেও তো খেতে হয়। যেদিন ওর বাবা খেতে পারে সেদিন আর ও পেটপুরে খেতে পারে না। তাই বাবার জীবনরক্ষাকারী ওষুধ দালালের কাছে বিক্রি করে ওকে বেঁচে থাকার খাবার জোগাতে হয়! সারারাত আর দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না। কেন জানি না, বারবার সুমির মুখের সাথে সাথে আমার একমাত্র মেয়ের মুখটাও ভেসে উঠল। সকালবেলা আমি কাউকে কিছু না বলে হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে গেলাম। গিয়ে বাসায় হাসপাতাল থেকে নেয়া যত খাবার ছিল সব একটা বড় ব্যাগে করে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দিলাম। জ্যামের সমুদ্র সাঁতরাতে সাঁতরাতে দশটার দিকে হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম, আব্বা-আম্মা সব গোছগাছ করছে। আমার ছোটভাই গেছে রিলিজের কাগজপত্র আনতে। মা আমার হাতে তারই দেয়া খাবারের ব্যাগ দেখে হায় হায় করে বলল— এগুলো আবার কেন নিয়ে এসেছিস? আমরা তো এখন চলে যাব...
এগুলো তোমাদের জন্য না মা।
তাহলে কার জন্য? —পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে জানতে চাইল বাবা।
সুমির জন্য।
সুমিটা কে? —মা অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে।
ওই তো ওই মেয়েটা... বলে যখন আমি সুমির বাবার বেডের দিকে আঙুল তুলে দেখালাম, তখন দেখলাম সুমির বাবার বেডটা ফাঁকা পড়ে আছে।
যে মেয়েটা কালরাতে লবণ চেয়েছিল সেই মেয়েটা? —মা আবার জিগ্যেস করল।
হ্যাঁ, কিন্তু কই ওরা?
সে পেশেন্ট তো মারা গেছে। ঘুমের মধ্যে মারা গেছে। সকালে আটটার দিকে নার্সের চোখে পড়ল।
এখন কোথায়? —আমি ধরা-গলায় মায়ের কাছে জানতে চাইলাম।
এই তো তুই আসার একটু আগে লাশ নিয়া গেল...
আর সুমি?
দেখলাম তো মেয়েটা হিক্কা দিয়ে কাঁদছে আর বাবার লাশের পেছনে পেছনে ছুটছে আর বলছে— আব্বা আমি এহন কই যামু? আমার দেখে খুব খারাপ লাগল!
আমার হাত থেকে খাবারের ব্যাগটা খসে পড়ে গেল নিজের অজান্তেই।
No comments