Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    দ্য ডিরেক্টর ।। ঢাউসগল্প

    কত দিন আগের ঘটনা, ঠিক মনে নেই। একদিন সকালবেলা আমি শুয়ে আছি, ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই কিন্তু শুয়ে আছি একটু আলসেমি করে। যেহেতু চাকরি করি না, তাই কোথাও যাওয়ার তেমন তাড়াও নেই। বউয়ের ঘুম ভেঙেছে আমার আগেই। টের পেলাম, সে কিচেনে টুংটাং করছে। আর আমি আছি আধো ঘুম, আধো জাগরণে। এমন সময় আমার ফোনে একটা কল এল। তাকিয়ে দেখি এক স্বনামধন্য নির্মাতার কল।
    স্লমালাইকুম ভাই, এত দিন পরে?
    কোথায় তুমি? তার কণ্ঠে বেশ ব্যস্ততা।
    ভাই, আমি তো বাসায়। কেন, বলেন তো?
    এই মুহূর্তে কি তোমার হতে কোনো কাজ আছে?
    আছে, তবে আজ ফ্রি আছি। বলেন কী করতে পারি আপনার জন্য?
    তুমি এক্ষুনি একটু উত্তরার আশ্রয়ে আসো তো।
    আশ্রয় উত্তরার একটি শুটিং হাউস। মনে হচ্ছে কোনো নাটকের কাজে তিনি সেখানে ব্যস্ত আছেন। আমাকে কোনো একটা হেল্প করতে হবে তাকে। হয়তো কোনো ঝামেলায় পড়েছেন।
    তুমি সিএনজি নিয়ে আসো। আমি তোমার ভাড়া এখানে আসলেই দিয়ে দেব। চিন্তা কইরো না। এক্ষুনি রওনা দাও। আমি লুঙ্গি খুলে প্যান্ট পরে যখন টি-শার্ট পরছিলাম, তখন বউ একটা ট্রেতে দুখানা টোস্ট, একটা ডিম পোচ আর এক কাপ কফি নিয়ে ঢুকল।
    কোথায় যাও?
    একটু উত্তরায় যাচ্ছি ইমার্জেন্সি। এক্ষুনি যেতে হবে।
    নাশতা করে যাবে অবশ্যই। নাশতা না করে এক পা-ও বাইরে রাখবা না। বউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বাধ্য ছেলের মতো সবকিছু গলাধঃকরণ করে কফিতে চুমুক দিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইলাম। তাতে আমার জিব গেল পুড়ে। তারপর আবার মগটা ওর হাতে ফেরত দিতে গিয়ে ফ্লোরে পড়ে হয়ে গেল কয়েক টুকরো। বউ খপ করে আমার হাত ধরে বলল, মগ ভাঙছে তাতে কোনো সমস্যা নাই, তুমি পাঁচ মিনিট বসে তারপর যাও।
    এটা তুমি কী বলছ? আমি সিনেমা-নাটক-বিজ্ঞাপন বানিয়ে খাই। তোমার কি মনে হয় আমার এসবে বিশ্বাস আছে?
    আমি জানি তোমার এসবে বিশ্বাস নাই, কিন্তু আমার তো আছে। তুমি এভাবে এখন বেরিয়ে গেলে আমি সারাটা দিন আর ভালোভাবে কাটাতে পারব না। পাঁচ মিনিট বসে যাও, প্লিজ।
    আমার মা-ও এ রকম ছিলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যদি কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খেতাম বা কিছু পড়ে যেত হাত থেকে, তখন মা-ও এ-জাতীয় কাজ করতেন। আমার বউয়ের যাতে সারা দিন ভালো কাটে, নিশ্চিন্তে কাটে, সে জন্য আমি ঠিক পাঁচ মিনিট বসে তারপর বের হলাম। বাসা থেকে বের হয়েই একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা রিকশা নিলাম কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে আরেক ঝামেলা। আমার কাক্সিক্ষত স্থানে কোনো সিএনজিওয়ালাই যাবে না। কী মুশকিল! অথচ ভাই বলেছেন তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য। শেষমেশ একটা কালো ট্যাক্সিক্যাব রাজি হলো মিটারের চেয়ে ১০০ টাকা বেশিতে। উপায়ান্তর না দেখে তার জুলুমেই রাজি হয়ে গেলাম। পথে যে জ্যাম হওয়ার তা কোনো একটা কারণে ততটা জ্যামে পড়তে হলো না। শেষ পর্যন্ত হাজির হলাম। এর মধ্যেই ভাই কয়েকবার ফোন করে আমার অবস্থান জানতে চেয়েছেন। আমিও কিছুটা সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে বলেটলে হাজির হলাম আশ্রয়ে। গিয়ে দেখি তিনি ডিরেক্টরের চেয়ার ছেড়ে দলবল নিয়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। সবারই মুখ গোমড়া। কাজের সূত্র ধরে এদের সবাইকেই আমি কমবেশি চিনি।



    কী ব্যাপার, ভাই।
    চলো, ভেতরে চলো। কথা আছে। নাশতা করার সময় পাইছ। এই প্রডাকশন, ওকে নাশতা দাও।
    থাক ভাই, আমি নাশতা করে এসেছি।
    শোনো, আমি এখানে এসেছিলাম এক ঘণ্টার একটা প্যাকেজ নাটকের শুটিংয়ের জন্য। সবই ঠিকঠাক ছিল। এখন ক্যামেরা ওপেন হওয়ার কথা কিন্তু ঘণ্টা দুই আগে একটা ফোন এল আমার বাবা মারা গেছেন। এখন বলো আমি কী করতে পারি?
    আমি এ রকম একটা সংবাদের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এখানে সান্ত্বনা দেওয়ার কিছু নেই। ভাইয়ের নিজের বয়সই পঁয়তাল্লিশের ওপরে। আমাদের দেশের গড় আয়ু অনুযায়ী তার বাবার আরও আগে মারা যাওয়ার কথা ছিল। এত দিন হয়তো বোনাস লাইফে বেঁচে ছিলেন।
    বলেন ভাই, আমি কী করতে পারি।
    এই নাও, বলে তিনি আমাকে এক হাজার নোটের দুটি বান্ডিল হাতে দিয়ে বললেন, এখানে এক লাখ ছিয়ানব্বই হাজার টাকা আছে। চার হাজার খরচ হয়েছে। নাটকের বাজেট ছিল দুই লাখ টাকা। ক্যামেরা লাইট ট্রলি খাবার প্রডাকশন সবার বিলই বাকি। তুমি তো খায়েরকে চিনো, খায়ের এদিকে আসো তো।


    খায়ের চলে এল।
    খায়ের আমার প্রডাকশন ম্যানেজার। আমার মনে হয়েছে, এই সময়ে বাংলাদেশে তুমিই আমাকে হেল্প করতে পারবা। তাই অনেক অধিকার নিয়ে তোমাকে কল করেছি, ভাই। বলে তিনি আমার দুই হাত চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন।
    আমি তার এই আচরণে একটু অবাকই হলাম। আমি যখন মিডিয়ায় কাজ করতে নেমেছি, তখন থেকেই আমি তাকে চিনি। মানুষ হিসেবে আমি তাকে বলব এক নম্বর, কথা ও কাজের কোনো অমিল আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। নির্মাতা হিসেবেও তিনি খারাপ নন। তার কাজ আমাকে প্রতিবারই মুগ্ধ করেছে। এ ছাড়া নানা সময়ে তিনি আমার অনেক উপকার করেছেন, যা আমি জীবনে ভুলতে পারব না, এমনকি সময়-অসময় আমিও তার ছোটখাটো উপকার করেছি। আমি বুঝতে পারলাম, নাটকের পুরো কাজই আমাকে, অ্যাজ আ ডিরেক্টর, তুলতে হবে। এমনকি এডিটিংও। আমার তাতে কোনো সমস্যা নেই। এত ছোট একটা উপকার আমি তাকে যেকোনো সময় সানন্দে করতে রাজি আছি। আমাকে আমার কাজের রুটিনে একটু এদিক-সেদিক করতে হবে, এ ছাড়া আর কোনো সমস্যা আমার হবে না। আপনি কাঁদছেন কেন, ভাই। এতে কান্নাকাটির কিছু নেই তো। আমিও তো এমন বিপদে পড়তে পারতাম, তখন আপনি কি আমাকে এ রকম উপকার করতেন না? আপনি কোনো ধরনের দুশ্চিন্তা করবেন না। প্রডাকশনের মাইক্রো আছে? আপনি সেটা নিয়ে এক্ষুনি গাইবান্ধায় রওনা দেন।


    তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, মাইক্রো লাগবে না। ধানমন্ডি থেকে আমার বোন আর ওর হাজবেন্ড আসছে গাড়ি নিয়ে। আমি সেই গাড়িতে করে চলে যাব। তুমি একটু দায়িত্বটা বুঝে নাও, ভাই। এখান থেকে তুমি বিশ হাজার টাকা নিয়ো তোমার রেমুনেরেশন হিসেবে, আমি আর নিলাম না।
    আরে, না না ভাই, কী বলেন, আপনি এসব কথা বাদ দেন। এখন আপনার টাকা দরকার আপনি বরং নিয়ে যান, আপনার দরকার হবে। আমার যখন দরকার হবে, তখন আমি আবার চেয়ে নেব। বলে আমি বান্ডিল থেকে এক হাজার টাকার বিশটা নোট তার হাতে দিলাম। একদম নিতে চাইলেন না। লাগবে না, লাগবে না, ওরা আছে, এই-সেই। তিনি টাকা কামাই করেন কম না। কিন্তু খরচ করেন দুহাতে। এখন এই কাজ হাতে, এখন তিনি এটার ওপর ভরসা করে হয়তো চলবেন আগামী পনেরো দিন। এটা তার হিসাবে ছিল হয়তো। আমি তো তাকে চিনি। একসময় তিনি টাকাটা নিলেন। তারপর আমাকে সেখান থেকে দশ হাজার টাকা জোর করে হাতে গুঁজে দিয়ে মুখে তর্জনী ঠেকিয়ে চুপ করতে বললেন।
    তোমার নিজেরও তো খরচ বলে একটা কথা আছে।
    প্রডাকশন তো আছে।
    কোনো কথা বোলো না। কাজ করো মন দিয়ে, খায়ের সবাইকে ডাকো তো, লাইট, ক্যামেরা, মেকআপ, আর্টিস্টদেরও ডাইকো। চৈতিকেও ডাইকো।
    চৈতি কে ভাই?
    এই নাটকের নায়িকা। এক্কেবারে নতুন না। কয়েকটা কাজ করেছে আগে। মেয়েটি ভালো। অভিনয়ও ভালো করবে বলে আমার বিশ্বাস। তোমাকে তো চিনি তুমি ওকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে। সাথে ওর মা-ও আছে।
    আচ্ছা, ঠিক আছে।



    আস্তে আস্তে সবাই চলে এল। দেখা গেল, দুয়েকজন বাদে আমি সবাইকেই চিনি। কোনো না কোনো সময় এরা আমার সাথে কাজ করেছে। সবার সাথেই আমার ভালো সম্পর্ক। সবাই আমাকে ভালো জানে। নায়কও বেশ ফেমাস আর আমাকে চেনে। একেবারে অচেনা যে সে হলো চৈতি। আমাকে হেসে সালাম দিল। আমি তাকে দেখে মুগ্ধ হলাম। একজন দর্শক কোনো নায়িকাকে যে রকম সুন্দর দেখতে চায়, এই মেয়েটি সেই রকম সুন্দর। এ যদি অভিনয়টা ভালো করতে পারে, তাহলে সে অতি দ্রুতই সুপারস্টার হয়ে যাবে। ভাই সবাইকে পেয়ে বলতে শুরু করলেন, আপনারা সবাই হয়তো জানেন, আজ সকালে আমার...


    আমি তাকে বিদায় দিয়ে কাজে মনোযোগ দিলাম। আমার মনে হলো, আমার নিজেরই সেট। স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করা যাবে। এখন নায়িকা কতটা কো-অপারেট করতে পারবে, সেটাই বিষয়। আমি অ্যাসিস্ট্যান্টকে সেট সাজাতে বলে স্ক্রিপ্টটা নিয়ে বসলাম একটু। আমার পেছনে এক অ্যাসিস্ট্যান্ট দাঁড়ানো। স্ক্রিপ্টের প্রথমে সিনোপসিস দেওয়া আছে। পড়ে দেখলাম লোকেশন দুইটা। আউটডোরের অংশ কোথায় শুট হবে, বুঝতে পারছি না, এখানে লেখা নেই।


    আউটডোর কোথায় শুট হবে, হিমেল? আমি পেছনে অ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে না তাকিয়েই জানতে চাইলাম। হিমেল কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি পেছনে ফিরে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি হিমেল সেখানে নেই। কখন চলে গেছে আমি টের পাইনি।


    গল্পটা খুবই সুন্দর। আমি পেলে হয়তো আগেই বলতাম, ভাই, গল্পটা আমাকে দেন, আমি বানাই। আমি খুব বড় ডিরেক্টর নই। আমার ঝুলিতে অ্যাওয়ার্ড-ট্যাওয়ার্ড নেই তেমন একটা। তবে যারা আমার কাজ দেখেছেন, তারা ভালোই বলেছেন। তিনি বানালে যতটা সুন্দর হতো, আমি বানালে ততটা সুন্দর হয়তো হবে না। তবে যেটা হবে, সেটাও মন্দ হবে না। এটা আমার আত্মবিশ্বাস। আর আমার এখানে করারই বা তেমন কী আছে, প্রডাকশন-ডিজাইন তো তিনিই করে গেছেন। আমি শুধু টেকগুলো নিয়ে নেব আর কি।


    নায়িকাকে নিয়ে আমি যে ভাবনা ভেবেছিলাম, দেখলাম তা একদমই নেই। একদম খোলামেলা-হাসিখুশি একটা মেয়ে। খুব কথা শোনে, কোনো ধরনের পাকামো নেই। ডায়ালগ বলে খুবই সাবলীলভাবে। প্রথম টেকেই বুঝলাম, এ এখানে করে-কেটে খেতে পারবে। কাজ করতে আমার বেশ ভালোই লাগছে। ক্যামেরাম্যান রাকিব তো আমার দশ বছরের পরিচিত। এমনিতে আমি রাকিবকে ছাড়া কাজ করি না। ও আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। ওর কাজ বেশ গোছানো। কাজ সুন্দরভাবে এগোচ্ছে। এর মধ্যেই ডিরেক্টর সাহেব দুই-দুইবার ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন। চৈতি ভালো করছে শুনে বেশ খুশিই হলেন। রাত এগারোটায় আমি যখন শুটিং প্যাকআপ করব, তখন চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট সরফরাজ এসে জানাল যে কালকের লোকেশন তো আউটডোর, জানেন না?
    হুম, কোথায়, সেটা জানব জানব করে জানা হলো না।
    আশুলিয়ায়। এ ব্যাপারে আপনি একটু ভায়ের সাথে কথা বলেন।
    ভাইয়ের সাথে কথা বলার কী আছে? লোকেশন তোমরা দেখোনি?
    না।
    না মানে?


    আমি আঁতকে উঠলাম। আগামীকাল সকালে যেখানে শুটিং, এখনো সেখানের লোকেশন দেখা হয়নি তো কী করে হবে? স্ক্রিপ্টে লেখা একটি গ্রাম্য পরিবেশ। ঢাকা তো আর নয় যে চাইলেই উত্তরার যেকোনো একটা হাউসে কাজ চালিয়ে নেব। সেখানে তো পুকুর-গোয়ালঘর ইত্যাদি আছে।
    কাল শুটিং আউটডোরে অথচ এখনো তোমরা লোকেশন দেখোনি, আমি বুঝলাম না ব্যাপারটা কী? অথচ ভাই আমাকে বললেন যে সব ঠিক করা আছে।


    লোকেশন আমরা দেখিনি বলতে আমি দেখিনি। ভাইয়া নিজে দেখেছেন। তিনিই লোকেশনের লোকের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করেছেন। এমনিতে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু এই ব্যাপারে ভাইয়াই আপনাকে তার সাথে একটু কথা বলতে বলেছেন। কোথায় কী যেতে হবে, কার কাছে যেতে হবে, তা তো আমরা জানি। কিন্তু ভাইয়া এমনিতে একটু আপনার সাথে কথা বলতে বলেছেন।
    ও তা-ই বলো।


    আমার বুক থেকে পাথর নেমে গেল। এদের মাথায় যে কী থাকে, বুঝি না। কোনো কথা একবারে ক্লিয়ার করে বলতে পারে না। কিংবা হয়তো পারে, তারপরও একটু ধোঁয়াশা রেখে কথা বলতে পছন্দ করে। আমি ভাইকে কল করার জন্য ফোনটা হাতে নিলাম। এর মধ্যেই দেখলাম তিনি নিজেই আমাকে ফোন দিলেন।

    সারা দিনে কেমন কী করেছি, হাউসের কাজ সব শেষ করতে পেরেছি কি না, জানতে চাইলেন। চৈতির সারা দিনের পারফরমেন্স কেমন, তা জানতে চাইলেন। সব ভালোভাবে হচ্ছে বা ঠিক আছে শুনে তিনি বেশ খুশিই হলেন।
    শোনো আমরা মাত্র ঘণ্টা তিনেক হলো ফিরেছি। কালকের লোকেশনের ব্যাপারে তোমাকে কিছু কথা বলি। ওখানকার পরিবেশটা পাবে ঠিক স্ক্রিপ্টে যেভাবে লেখা আছে, সেভাবে। খুবই সুন্দর লোকেশন। কোনো সমস্যাই হবে না। আমার এক বন্ধুর ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে পাইছি। যার বাড়ি, সে কোনো এক মন্ত্রীর ছেলে বা ভাইপো, কী যেন। বেশ পাওয়ারফুল লোক সে ওই এলাকার। তোমার কোনো অসুবিধাই হবে না। বুচ্ছ?
    ঠিক আছে, ভাই। আমার আবার অসুবিধা কী?
    না মানে, অসুবিধা, মানে ধর গিয়া, এই যেমন তুমি সেখানে নায়িকাকে নিয়ে যাচ্ছ, গ্রাম্য একটা পরিবেশ, সবাই যে খুব সভ্য, তা-ও না। একটা ভয়ের ব্যাপার থাকে না, সেইটা আর কি।
    হুম।
    মানে নায়িকা, ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়া একটা সিকিউরিটির কথা বলতেছি আর কি।
    জি ভাই, বুঝতে পারছি। ঠিক আছে।
    কোথায় যাবে, তা আমাদের মাইক্রোর ড্রাইভার জানে। তুমি খালি গিয়া ওনারে ফোন কইরা জানাবা যে ভাই আমরা আসছি।
    ঠিক আছে, ভাই।
    আচ্ছা, রাখলাম তাইলে।


    আমি ফোন রেখে সরফরাজের দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, তাহলে সর্পের রাজা, আমি কাল কোথায় কখন কার সাথে দেখা করব, বলো।
    খায়ের পাশ থেকে মুচকি হেসে বলল, কী যে বলেন, ভাই। সকালে আমি আপনার বাসায় গাড়ি নিয়া থাকব।
    ও, তাহলে ভালোই হয়।
    খায়ের আবার বলল, ভাই, গাড়ি এখন রেডি, আপনারে বাসায় দিয়ে আসব।
    বাহ্! চলো তাহলে, আর কে কে যাবে কল্যাণপুরের দিকে।
    আমার বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় একটা বেজে গেল।
    আমি যে পেশায় কাজ করি, তাতে আমাকে দেরি করে ফিরতে হয়, তা বিয়ের তিন মাসের মাথায় বউ বুঝে গেছে। বাসায় ঢুকে দেখলাম তখনো সে আমার জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে। শুটিং কেমন হয়েছে, এসব নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম খাবার টেবিলে।
    কাল শুটিং ঢাকার বাইরে।
    তাই নাকি? কোথায়?
    আশুলিয়ায়। যাবে?
    নাহ্।
    কেন?
    যাবে বড় আশুলিয়ায়। সেখানে আর দেখার কী আছে?
    আমরা না হয় আশুলিয়ায় অনেকবার গিয়েছি বলে আমাদের দেখার কিছু নেই কিন্তু অনেকের তো দেখার অনেক কিছু আছে। আর তুমি তো ফ্যান্টাসি কিংডম দেখতে যাবে না, যাবে অন্য জায়গায়।
    অন্য জায়গাটা কোথায়?
    আমি দেখিনি এখনো, তবে জায়গাটা শুনেছি অনেক ভালো। দেখার মতো। চলো কালকে।
    ঠিক আছে। কখন যাবে?
    ওরা গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে আসবে সকাল সাতটায়। যদি সাড়ে ছয়টার মধ্যে রেডি হয়ে বসে থাকতে পারো, তবে যেতে পারবে। আমাদের ক্যামেরা ওপেন করব ঠিক নয়টায়। আমার কথা শুনে বউ ফিক করে হেসে দিল।
    হাসলে কেন?
    না, এমনি।
    এমনি তো না, কারণ তো অবশ্যই আছে, বলো কেন হেসেছ?
    না, মানে তোমার একটা বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ল তো, তাই। তোমাদের ক্যামেরা ওপেন করার কথা ছিল সকাল নয়টায় আর তোমার ডিওপি লাইট করেছিল একটা পর্যন্ত, সে কথা মনে পড়ল তো তাই হাসলাম।
    আরে, বিজ্ঞাপন আর নাটক কি আর এক? যা-ই হোক, কাল দেখতে পারবে। চলো এখন শুতে চলো। কাল সময়মতো যেতে হলে ঘুম থেকে উঠতে হবে কিন্তু ছয়টারও আগে।
    আচ্ছা, দেখা যাবে কে কখন ওঠে।
    শোয়ার আগে বউ বলল, তোমার ল্যাপটপটা একটু দেবে, আমি জাস্ট মেইলটা একটু চেক করব?
    করো কিন্তু দেরি কোরো না।
    আমি শুয়ে শুয়ে সারাটা দিনের কাজ সম্পর্কে ভাবছি, এমন সময় বউ বলল, কাল তোমাকে একাই যেতে হবে গো। আমার আর যাওয়া হচ্ছে না।
    আমি শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বললাম, কেন, কী হয়েছে?
    কাল সকাল এগারোটায় আমার একটা ইন্টারভিউ আছে।
    এখন জানলে নাকি?
    হুম।
    কোত্থেকে?
    সনোফি এভেন্টিসে যে লজিস্টিক অফিসার পদে দিয়েছিলাম, তারা কাল ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য মেইল করেছে।
    যে কোম্পানি রাত তিনটার সময় চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড মেইল করে, সেখানে তোমার চাকরি করার দরকার নাই।
    আরে, তারা মেইল করেছে আরও ছয় দিন আগে। আমি দেখলাম আজ।
    ও। ঠিক আছে, শুতে আসো।

    সকালবেলা আমার ঘুম ভাঙল আমার বউয়ের ডাকেই।
    কী হয়েছে, এত সকালবেলা?
    সকালবেলা মানে, এখন বাজে সাড়ে আটটা, তুমি নাকি নয়টার সময় আশুলিয়ায় ক্যামেরা ওপেন করো?
    বলো কী, সাড়ে আটটা মানে। আমার মোবাইলটা কই, দাও তো খায়েরকে একটা ফোন করতে হবে।
    খায়ের এসে বসে আছে আধা ঘণ্টা ধরে।
    আমি কিছুটা লজ্জিত হলাম।
    গাড়ি কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে আর যেতে চায় না। জ্যাম, জ্যাম আর জ্যাম। আমাদের ড্রাইভার আমাদের মিরপুর এক-এর মাজার রোডসংলগ্ন একটা রুট থেকে সহজে আশুলিয়ায় নিয়ে যাবে। অনেক কষ্টে আমরা আশুলিয়ার রুটে উঠে যাওয়ার পর আর কোনো জ্যামই পেলাম না। মনে হলো খুব সহজেই চলে এলাম।
    গাড়ি থেকে নেমে দেখি এলাহি কাণ্ড। বিশাল রাজবাড়ির মতো বাড়ি। বাড়ির প্যাটার্ন কিছুটা ডিপজল ভাইয়ের হেমায়েতপুরের শুটিং বাড়িটির মতো।
    সরফরাজ, আমাদের গল্পের সাথে তো এই বাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে নিয়ে এলে কেন?
    ভাই এটা সিনেমার জন্য করা পারমান্যান্ট সেট। আমাদের লোকেশন আরও ভিতরে।
    তাই নাকি?
    জি, চলেন দেখাচ্ছি।
    সবাই আসছে ঠিকঠাকমতো?
    জি।
    চৈতি? চৈতি এসেছে?
    জি।
    ঠিক আছে, চলো তাহলে।


    আমি ভেতরে গিয়ে দেখি স্ক্রিপ্টের সাথে লোকেশনের হুবহু মিল না থাকলেও যতটুকু মিল রয়েছে, তাতে মনে হয় ডিরেক্টর আগে লোকেশন দেখে পরে স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সবই ঠিকঠাক আছে। শুধু সমস্যাটা হয়েছিল একটু ইলেকট্রিক লাইন পাওয়া নিয়ে। তাও দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যে খায়ের ম্যানেজ করে ফেলল। ভোগান্তির শুরু হলো ক্যামেরা ওপেন করার পর। লোকে লোকারণ্য। সবাই এসে জিজ্ঞেস করে নায়িকা কে। অধিকাংশ লোকই আসে তারা অভিনয় করতে চায়। একজন এলেন প্রাইমারি স্কুলের টিচার। তিনিও অভিনয় করতে চান। কলেজলাইফে তিনি অভিনয় করে কাকে কাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন, তা আমাকে শুনতে হলো শট নেওয়া বাদ দিয়ে। এক মেয়ে এসেছে তার মাকে নিয়ে। সে মেয়ে খবর পড়তে চায় টিভিতে। সেখানে আমি কী করতে পারি? গ্রামাঞ্চলে এই যে একটা সমস্যা। বেলা যত বাড়তে লাগল, সমস্যা তত প্রকট হতে লাগল। শুটিংয়ে কেউ কেউ আবার পরামর্শও দিতে লাগল। আমার মেজাজ গেল সপ্তমে চড়ে। আমার অবস্থা বেগতিক দেখে সরফরাজ এসে বলল, বস, এখন শুটিং কিছু সময় অফ রাখেন।
    কী কথা বলছ তুমি? তাহলে তুমি দিনের সিকুয়েন্স শেষ করতে পারবে? তোমার ডে লাইট থাকবে?
    তাহলে কী করবে, দোস্ত? তুমি একটু মনিটরে চোখ দিয়ে দেখো খালি ফ্রেমে লোক আর লোক। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রডাকশনের পোলাপান গেছে লোক সরাইতে সরাইতে পাগলা হইয়া, রাকিব জানাল ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ সরাতে সরাতে।
    আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। এখন কী করি? এই সব মানুষকে তো আর বলে বোঝানো যাবে না।
    কই, ডাইরেক্টর কই? ক্যাঠা ডাইরেক্টর, ক্যাঠা? একটা কর্কশ কণ্ঠ আমার দিকে আসতে লাগল। না জানি এ আবার কোন মাস্তান। এমন সময় সরফরাজ আমার কানে কানে এসে বলল, ভাই, এই হইলো টিপু ভাই।
    কোথাকার টিপু ভাই?
    জুয়েল নামের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট গলার স্বর নামিয়ে বলল, আমরা যে বাড়িতে শুটিং করতে এসেছি, সেই বাড়ির মালিক।
    ও।


    এর মধ্যে সেই টিপু এসে হাজির। লম্বায় ছয় ফুটের ওপরে। গায়ের রং ফরসা না বলে শ্যামলাই বলা ভালো। একটা চোখে একটু সমস্যা আছে বলে মনে হলো। গায়ে একটা কালো শার্ট আর একটা নীলচে জিন্স। এর সাথে সাঙাৎ রয়েছে আরও ছয়-সাতজন। সবার চোখ লাল। বোঝা যাচ্ছে এরা কিছু আগেই কোনো মাদক-টাদক নিয়েছে, বাট আমি কোনো মাদক সেবি নই বলে স্পেসিফিক বলতে পারছি না তারা আসলে কোন মাদক নিয়েছে।
    আমি টিপু নামক অদ্ভুত জীবটাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম।
    আসসালামু আলাইকুল। টিপুই আমাকে আগে সালাম দিল।
    আবে আপনে ডাইরেক্টর, আপনে খাড়ান ক্যালা? খাড়াইয়া থাহুম তো হালায় আমরা। ক্যামন চলতাছে কাজবাজ?
    জি টিপু ভাই, ভালোই চলছে। আগে বলেন আপনি ক্যামন আছেন?
    আমগো আর থাহা, পলিটিচ করি, ভালো-মন্দ লইয়াই আমগো চলতে হয়। আপনেগো অমুক মন্ত্রী তো আমার চাচা, জানেন?
    তাই নাকি?
    জানতেন না, না?
    আমি আসলে অত ডিটেইলস জানতে পারি নাই।
    অসুবিধা নাইক্যা। এহন তো জানলেন। কী খাইবেন, কন?
    না না ভাই, আমরা তো খাবারদাবার নিয়ে এসেছি। আপনি বরং আমাদের সাথে খান। এখন আমাদের খাওয়ার সময়।
    আমার বাড়িতে আইছেন আর খাওয়াইবেন আপনে? এই ছদরুল, হ্যাগো সবাইরে আইজ আমরা কাচ্চি খাওয়ামু। গাড়ি লইয়া ইউনুসরে এহনই পাডাইয়া দে।
    আমি দেখলাম, লুঙ্গি পরা একটা ছোটখাটো হাতির বাচ্চা দৌড়ে গেল একটা পাজেরো গাড়ির দিকে। আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। এটা কেমন কথা। আমি এখানে এসেছি শুটিং করতে। কাজটা ভালোভাবে তুলে নেওয়াই আমার কাজ। আমি তো এখানে ভূরিভোজে আসিনি।
    ভাইয়া, এসব কিন্তু না করলেও পারতেন।
    আরে ডাইরেক্টর সাব, আপনেরা আমার মেহমান। আপনেগো যদি এখন একটু খাতির না করি, তাইলে কি আপনে আমারে আর পরে খাতির করবেন? আর তা ছাড়া আপনে তো আর আমার বাগানবাড়িতে রোজ রোজ আইবেন না, আইবেন?
    না, তা অবশ্য আসব না।
    তাইলে? এইডা তো আমি আর শুটিং পার্টিরে ভাড়া দেওনের লাইগ্যা বানাই নাই। এইডা হইলো আমার আস্তানা। আপনাগো নাটক-সিনেমায় যারে কয় বাগানবাড়ি। হা হা হা।
    আমি বুঝতে পারলাম এই মানুষটা হাসিখুশি একজন প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। আর যা-ই হোক, তার মনে তত ঘোরপ্যাঁচ নেই।
    চলেন আফনেরে আমার বাগানবাড়িডা একটু ঘুরাইয়া আনি।
    ভাই, আমি এখন আপনার সাথে ঘুরতে গেলে সন্ধ্যার আগে কাজ শেষ করতে পারব না। বিপদে পড়ে যাব।
    আরে কিয়ের বিপদ, আপনে আমার রাজ্যে আইছেন, এইহানে আপনার কিয়ের বিপদ।
    সময়ে কাভার করতে পারব না, ভাই।
    সময় কিয়ের আপনার, আমি কি আর আপনার কাছে পয়সা নিতেছি নাকি? আপনার যত দিন ইচ্ছা ছুটিং করেন, নায়িকা লইয়া ব্যাড়ান, মজা করেন, কুনো অসুবিধা নাইক্যা।
    এর সাথে পয়সাপাতির কী ডিল হয়েছে, আমি জানি না। তবে এইটুকু জানি, আজ রাত বারোটা পর্যন্ত আমরা এখানে শুটিং করতে পারব। প্রয়োজনে থাকতে পারব। তবে আমার ইচ্ছা, রাত আটটার দিকে প্যাকআপ করব। তাতেই আমার ডে-নাইট মিলিয়ে কাভার হয়ে যাবে। এখানে ডে-নাইট মিলিয়ে মোট নয়টা সিকুয়েন্স শুট করতে হবে। আসরের দিকেই আমাদের ডে শেষ হয়ে যাবে। তার পর থেকেই আমরা নাইটে ইনডোরগুলো করা শুরু করব। এই আমার হিসাব। এটা আমাদের টিমের সবাই জানে। নায়িকা চৈতিও জানে। চৈতির সাথে রয়েছে তার মা।


    যা-ই হোক, আমি চিন্তা করলাম, যদি এই লোকের সাথে এখন তার বাগানবাড়ি দেখতে যাই, আর সেখানে যদি আমি এক ঘণ্টা সময়ও ব্যয় করি, তাতে আমাকে প্যাকআপ করতে হবে রাত নয়টায়। সবকিছু গুছিয়ে রওনা দিতে দিতে রাত দশটা। এ বড় ত্যাড়া লোক। একে চটানো ঠিক হবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে, চলেন।

    ভাবলাম, এই ফাঁকে যদি উৎসাহিত দর্শক কিছুটা কমে।
    আমি দেখলাম টিপু ভাই ওঠার সাথে সাথে সামনে থেকে ফাঁকা হয়ে গেল। তার পেছনে রওনা দিল সেই লুঙ্গি পরা হাতি, যার নাম বোধ হয় ছদরুল। এ হয়তো টিপুর এখানকার খাস চামচা। ঢাকায় হয়তো অন্য কেউ আছে। কিংবা এমনও হতে পারে যে এই হয়তো এইভাবেই ঢাকায় যায়। সব জায়গায় থাকে নীরবে। ভাইয়ের পেছন পেছন ছায়ার মতো। যেন ভাইয়ের কোনো বিপদ না হয়। দরকার হলে সে জান দিয়ে দেবে। তারপরও ভাইয়ের কোনো বিপদ হতে দেবে না। তার কোমরে বোধ হয় অনেকগুলো চাবি বাঁধা। সে হাঁটতে শুরু করলে ঝনঝন করে শব্দ হচ্ছে। আমরা একটা সরু ইট বিছানো রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম এই বাড়ির যে পুকুর আছে, তার পাশ দিয়ে সোজা। অনেকখানি হাঁটার পর আমাদের সামনে পড়ল একটা ছোট চিকন নালার মতো (খাল যতটুকু চওড়া হয়, তার চেয়ে কিছুটা কম চওড়া), তবে এমন চিকন না যে লাফিয়ে পার হওয়া যায়। কোনো সাঁকোও নেই। দেখলাম ছোট একটা নৌকা নিয়ে একজন বসে আছে। আমরা উঠতেই মাঝবয়সী লোকটা নৌকা বাইতে শুরু করল। আমরা এপাড়ে এসে নামার পর হাঁটতে হাঁটতে বড় স্টিলের গেটওয়ালা বেশ উঁচু দেয়ালঘেরা একটা বাড়ির সামনে এলাম, যার ভেতরে দুইতলা বিল্ডিং থাকলেও তা বোঝা সম্ভব নয়। আমাদের সাথে থাকা লুঙ্গি পরা টিপু ভাইয়ের সাঙাত বা চামচা ছদরুল গিয়ে গেট খুলল। ভেতরে বেশ সুন্দর সবুজ ঘাসে ভরা একটা লন। বোঝা যায়, মাইনে করা মালি আছে এসব ঠিক রাখার জন্য আর মালি যেমন কর্মঠ, তেমনি তার শিল্পবোধ। লনের ঠিক পরেই একটা একতলা বাড়ি, যেটি লম্বা-চওড়ায় অনেক বড়। আর বাড়িটির প্যাটার্ন কিছুটা পাশ্চাত্যঘেঁষা। প্রবেশদ্বারটি ভারী কাঠের। খয়েরি রং করা। ঢুকেই হলঘরের মতো একটা ড্রয়িংরুম। বড় বড় সোফা সেখানে। চারপাশে রয়েছে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় আসবাব। একটা পিয়ানো পর্যন্ত আছে। আমি বসতে গিয়ে বেশি অবাক হলাম। আমার ঠিক সামনে পড়ল এই ঘরটির সবচেয়ে সুন্দর বিষয়টি। খুবই সুদৃশ্য একটি বার কাউন্টার। আমি এমন বার কাউন্টার আগে আর দেখিনি। আমি অভিভূত হয়ে কাউন্টারটির দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার পেছন থেকে টিপু ভাই ঝনঝনে গলায় বললেন, আমার বার কাউন্টারটা সুন্দর না?
    আমি বেশ পুলকিত হয়ে বললাম, অবশ্যই সুন্দর। খুবই সুন্দর। এটার ডিজাইন কে করেছে, টিপু ভাই?
    আমার জার্মানির এক বন্ধু। ওর নাম এলেক্স।

    পুরো কাউন্টারটি মার্বেল দিয়ে করা। দেখলে মনে হবে কাউন্টারজুড়ে অনেকগুলো ছোট ছোট দৃষ্টিনন্দন পরি উড়ে এসে পড়েছে। তাদের হাতেই রয়েছে বোতলগুলো, গবলেটগুলো সাজিয়েছে একটা ট্রেতে। আর সে ট্রেটি ধরে আছে দুটি পরি। দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে। টিপু ভাই এসে একটা রেড ওয়াইনের বোতল নিলেন। আর সাথে সাথে ছদরুল নিয়ে এল দুটি গবলেট। আমরা কাউন্টারের পাশে রাখা সোফায় বসলাম। ছদরুল টিস্যু দিয়ে মুছে গবলেট দুটো সামনের টি-টেবিলে রাখল। হাত চালানো দেখে মনে হয় এ কাজে সে অভ্যস্ত।
    এইখানে ভাই আমি মাঝেমধ্যে সময়-টময় কাটাই। বন্ধুবান্ধব আহে, আমার দিকে একটি ওয়াইনভর্তি গবলেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল টিপু ভাই।

    টিপু ভাই সোফায় বসতে বসতে তার কোমর থেকে একটা নাইন এমএম পিস্তল টি-টেবিলে রাখল। তার সমস্যাওয়ালা বড় চোখটা একটু ছোট করে বলল, ভাই, পলিটিচ করি তো, সাথে রাহন লাগে। বেআইনি জিনিস না। লাইছেন আছে। ছদরুলেরডারও লাইছেন আছে। নানা ধরনের ভালো-মন্দ ব্যবসাপাতি চালাই তো ভাই, নানান ধরনের মানুষের লগে ওঠা-বসা। কার মনে কী, কে কইতে পারে, বলেন?
    জি ভাই, তা তো ঠিক।

    আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এ লোক কি তাহলে আমার ভাবনার মতো নয়? নানা ধরনের ভালো-মন্দ ব্যবসা চালাই, মানে কী? এ স্মাগলিংয়ের সাথে জড়িত নয়তো আবার? কি জানি ভাই, আমার কাজ ভালোয় ভালোয় সারতে পারলেই হয়।

    আমি ওয়াইন গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বললাম, ভাই, চলেন খেতে যাই।
    আরে ভাই, খেতে কোথায় যাবেন। আপনাদের জন্য তো ঢাকা থেকে কাচ্চি আনাইতাছি। এখানে আসবে আপনারটা, আমারটাও। বসেন, আরাম করেন। এত কাজ করে কী হবে, বলেন তো।
    আমি বসলাম। হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠল।
    কী অবস্থা, দ্য ডিরেক্টর? একটা ফোন দেওয়ার সময়ও পান না আপনি?
    হেই, কী অবস্থা তোমার? ইন্টারভিউ কেমন হলো?
    ও বাব্বা, আমার যে ইন্টারভিউ ছিল, তা তোমার মনে আছে?
    আরে, কী যে বলো? মনে থাকবে না কেন? একটু ব্যস্ত হয়তো থাকি, তার মানে এই নয় যে সব ভুলে যাই। বলো কেমন হলো ইন্টারভিউ?
    ধরে নিতে পারো চাকরিটা হয়ে গেছে।
    তাই নাকি? সত্যি বলছ?
    হুম। সত্যিই বলছি। শুরুতে পঁচিশ দেবে। রাজি থাকলে ১ তারিখ জয়েন করতে বলেছে।
    কী ভেবেছ? এত কমে জয়েন করবে?
    কী করব বলো? সংসারের যা অবস্থা, তা তো তুমি আমি দুজনেই দেখছি। আপাতত করতে থাকি, তারপর দেখা যাক।

    আচ্ছা, যা ভালো মনে হয়, করো। দেখো, বিসিএসের পড়াশোনায় যেন ক্ষতি না হয়।
    তোমার কাজের খবর কী? কেমন আগাচ্ছে? নায়িকার সাথে ভাব হলো?
    আরও কিছু সময় বেহুদা কথা বলে আমরা ফোন রাখলাম। এর মধ্যে আরও দুজন লোক এল। তার মধ্যে একজন নিজেকে কোনো এক এসপির ছোট ভাই বলে পরিচয় দিল। নানা ধরনের গল্প শুনতে শুনতে একসময় খুব সুন্দর প্লেটে সাজানো কাচ্চি বিরানি এল। আমরা কাচ্চি বিরানি দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম। ছদরুল টিপু ভাইকে বলল, ভাই, ওইখানে আটাইশ জনের জন্য ত্রিশটা কাচ্চি দিয়া আইছি।
    ভালো করছস। তরা খাইয়া ল।
    ছদরুল কোনো কথা না বলে পাশে সরে দাঁড়াল। আমরা খেয়েদেয়ে বের হয়ে এলাম। টিপু ভাই আমাকে বলল, তাইলে ডাইরেক্টর ভাই, আপনে যান। গিয়া ছুটিং করেন। আবার দেখা হইব। রাইতে আবার দেহা হইব।
    আচ্ছা ভাই। আমি ছাড়া পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমাকে ইউনিটে দেখতে পেয়ে সবাই বেশ খুশি হলো। অল্প কিছু সময় পরই আমরা আবার কাজে লেগে পড়লাম। সন্ধ্যার কিছু পর কারেন্ট গেল চলে। হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। আমার গেল মেজাজ বিগড়ে। আমাদের সাথে জেনারেটর আছে কিন্তু জেনারেটরে কাজ করতে আমার বিরক্ত লাগে। তারপরও উপায়ান্তর না দেখে আমি কাজ শুরু করলাম। এই নাটকের প্রি-প্রোডাকশন ওয়ার্কটা অনেক ভালো থাকায় কাজ দ্রুত নামতে লাগল। নয়টার দিকে সরফরাজ এসে বলল, ভাই, প্যাকআপ বলতে পারেন।
    দুইটা জিটি নেওয়ার বাকি ছিল, নিয়েছ?
    হ্যাঁ।
    ওকে, তাহলে প্যাকাপ বলে দাও।
    আপনি বলেন, আপনি ডিরেক্টর।
    আরে, হইছে, বলো বলো। এই রাকিব দোস্ত, প্যাকাপ। আমি একটু জোরেই বললাম। ইউনিটে একটু গুঞ্জন উঠল। আমার পাশে বসা চৈতি উঠে বলল, ভাইয়া, আমি তাহলে মেকআপটা তুলে ফেলি?
    প্লিজ।
    আমরা তো একসাথে যাচ্ছি, তাই না, ভাইয়া?
    তোমার সাথে তো গাড়ি আছে?
    জি না, ভাইয়া।
    আচ্ছা। ঠিক আছে, সমস্যা নাই।
    চৈতি মেকআপ তুলতে চলে গেল। এখানে কোনো প্রফেশনাল মেকআপরুম নেই। আমরা দোতলার একটা মেকআপ রুম বানিয়ে নিয়েছি। আমি খায়ের আর সরফরাজকে নিয়ে বসলাম হিসাব-নিকাশ করতে। আমাদের হিসাব দেখা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় এক অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে জানাল যে টিপু সাহেব এসেছেন আমার সাথে দেখা করতে।
    আমি আসব, না উনি ভেতরে আসবেন?
    উনিই আসবেন।
    আচ্ছা, পাঠাও পাঠাও। মনে মনে ভাবলাম, লোকটা এসেছে ভালোই হয়েছে, তার কাছ থেকে আসার পর কাজের চাপে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তার কথা। এসেছে ভালোই হয়েছে। যাবার আগে দেখা হলো, বিদায়ও নেওয়া হলো। আমি ভাবতে ভাবতেই টলতে টলতে ঢুকলেন টিপু ভাই। কিন্তু একি? এ লোক আর দুপুরের টিপু ভাই এক নয়। নেশায় চুর হয়ে আছে, চোখ দুটো লাল টকটক করছে। মাথাটা ঝুলে আছে নিচের দিকে। তাকে দেখতে এককথায় ভয়ংকর লাগছে। রুমে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন।
    ছুটিং শেষ?
    জি ভাই, শেষ। চলে যাব এখন।
    এখনই যাইবেন গা? রাইতে থাকতেন না?
    না ভাই, দরকার নাই। এখন মানে এই লাইট-টাইট গাড়িতে উঠাবে, আরও গোছগাছ করবে। করা হলেই রওনা দেব।
    সবাই যাইব গা?
    হ্যাঁ, গেলে তো সবাই যাবে।
    নায়িকা? আপনেগো নায়িকা যাবে না?
    যাবে তো।
    নায়িকারে তো দেখাইলেনই না। তারে একটু ডাকেন, তার লগে কথা কই।
    একটু পরে আমরা চলে যাব তো, এখন ও মেকআপ তুলছে। যখন যাবে, তখন কথা বলবেন, কেমন?
    না, আমি একখন কথা কমু। ডাকেন নায়িকারে। আমি হের লগে একটু আলাদা সময় কাটামু না?
    আমার বুকটা ধক করে উঠল। নায়িকার সাথে একটু আলাদা সময় কাটাবে মানে কী? এর নিশ্চয়ই অন্য কোনো মানে আছে। আর সে মানেটা অবশ্যই ভালো কিছু নয়। তারপরও আমি মনে করি যেন ভালো কিছুই বলেছেন মন্ত্রীর ভাতিজা। মন্ত্রীর ভাতিজা বলে কথা। সে কি আর খারাপ কিছু বলতে পারে? আমি আমার ঠোঁট দুটো কষ্ট করে ফাঁক করলাম, যেন হাসছি, এমন একটা ভাব করে বললাম, আলাদা সময় কাটানোর কী আছে? ছবি-টবি তুলবেন তো?


    এবার গর্জে উঠল মন্ত্রীর ভাতিজা।
    ছবি তুলুম ক্যান? ছবি ধুইয়া কি আমি পানি খামু? মিয়া ফাউল কোহানকার! সব বোঝেন আর এইডা বোঝেন না, না? ঢং করেন আমার লগে? যা কইতাছি তা-ই করেন। আমি এহন নায়িকার লগে আলাদা সময় কাটামু। মানে আমি নায়িকার লগে শুমু। এইবার বুচ্ছেন? মজা করুম, মজা, ইনজয়। আপনে সব মজা একাই করবেন? ভাই-বেরাদার আমরা কি বইয়া বইয়া বাল ফালামু, না আপনেগো বেলুন ছাপ্লাই দিমু? আপনে নায়িকারে বলেন। আমি কইতে গেলে বিষয়ডা ভালো দেহায় না। আপনে মিউচুয়াল কইরা দেন।
    আমি মিউচুয়াল করে দেব মানে? কী সব কথা বলছেন আপনি?
    কী সব কতা কই বোঝেন না? ছদরুল, এই হারামজাদা ছদরুল...
    ছদরুল হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকে বলল, কী ভাই, কথা শোনে না? আপনে খালি বলেন একবার পুবের মাডে পুঁইত্যা রাইখা দিই মাতা নিচে দিয়া। বলে ছদরুল টিপুর পেছনে গিয়ে আগের চেয়ে একটু প্রসারিত হয়ে দাঁড়াল। আমার কাছে এবার আস্তে আস্তে সব পরিষ্কার হতে শুরু করল। এটা তাদের আগে থেকে করা প্ল্যান। আমি ফেঁসে গেছি। কারেন্টের জালে বাইম মাছ যেভাবে ফাঁসে, আমি সেভাবে ফেঁসে গেছি। যত বের হতে চাইব, ততই ফাঁসতে থাকব। একসময় জালের সুতা কেটে ঢুকতে থাকবে আমার শরীরে। তারপর আমি টুকরো টুকরো হয়ে যাব। আমি টুকরো টুকরো হতে চাই। এই মেয়েটি এখানে এসেছে আমার কাজে। তার নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আমার। যে করেই হোক, চৈতির কোনো ক্ষতি আমি হতে দেব না, তা ঠিক করতে আমার বেশি সময় লাগল না। যেকোনো মূল্যেই হোক, আমি নিরাপদে তাকে ঢাকায় পৌঁছে দিতে চাই। শুধু চৈতিকে কেন, ইউনিটের প্রত্যেকে যাতে নিরাপদে-নির্বিঘেœ যার যার বাসায় পৌঁছাতে পারে, তা দেখা আমার অন্যতম দায়িত্ব। কারণ এখন আমি এই প্রডাকশনের ডিরেক্টর। কিন্তু কী করে? টিপু দুপুরবেলা আমাকে নিয়ে তার ক্ষমতার কিছু অংশ ডিসপ্লে করেছে। আইন অবশ্যই তার পক্ষে। পুলিশ তার মানিব্যাগে। আমি কে? আমি যে-ই হই না কেন, এই মেয়েটির বিপদে আমাকে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। তার গায়ে একটা টোকাও লাগতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু তা কী করে? আমি কি ভাবার যথেষ্ট সময় পাব? পাব, কারণ, টিপু তো আর চৈতিকে জোর করে তুলে নিয়ে যাবে না। আমাকে বলছে মিউচুয়াল করে দিতে। এটা কি আমাকে ভাবার সময় করে দেবে না? আমি একটু ডিরেক্টরের সাথে কথা বলতে চাইলাম। টিপু বেশ ভদ্রভাবে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তাতে আমার ভয় আরও বাড়ল। কারণ, টিপু আমাকে এই সময় দেওয়ার মানে এই নয়তো যে তুমি যেখানেই ফোন করো না কেন চান্দু, আমাকে ঠেকানোর মতো কেউই নেই।
    ভাই, আপনি কোথায়?
    আমি কোথায় তুমি জানো না?
    না মানে, কথা বলা যাবে একটু?
    আমি আমার চাচা, চাচাতো ভাই আর অন্য আত্মীয়দের সাথে একটু কথা বলতেছি পারিবারিক ব্যাপারে, যা বলার সংক্ষেপে বলো।
    আমি যত সংক্ষেপে পারলাম বললাম।
    এখন এসব কী বলো তুমি? সেই লোক এখন কোথায়?
    জানি না। মনে হয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি এখন কী করব, ভাই?
    দাঁড়াও, আমি যে বন্ধুর মাধ্যমে ওই বাড়িতে গেছিলাম, তারে ফোন দিচ্ছি।
    আপনি তাড়াতাড়ি ফোন দেন আর আমাকে তার নম্বরটা এসএমএস করে পাঠান এক্ষুনি।
    আচ্ছা আচ্ছা, রাখো, আমি দেখছি।
    আমি ফোন রাখতেই টিপু রুমে এস ঢুকল।
    কতা শেষ হইছে?
    জি ভাই।
    চলেন, নায়িকার কাছে চলেন।
    এখন আমি কী বলব।
    ভাই একটু দাঁড়ান। আপনি বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন।
    আপনি বোঝার চেষ্টা করেন, ডাইরেক্টর সাব। আপনেগো নাটক-সিনেমার মাইয়ারা তো এমনই। তারা তো রেডি। আপনে কইলেই রাজি হইয়া যাইব। আপনে কেন আমার লগে শত্র“তা বাড়াইতাছেন।
    কী বলেন এসব, টিপু ভাই? আপনি যা ভাবছেন, তা একদমই না।
    আপনে কইলে তো আমি বিশ্বাস যামু না। আমি তো আর এ লাইনে নতুন না। আমার বাড়িতে তো নতুন শুটিং হয় না। আমি তো জানি ভাই কে কেমন। আমি কোনো জোরাজুরি চাই না, আমি মিউচুয়াল পছন্দ করি। তা ছাড়া সামনে ইলেকশন। দলের অবস্থা ভালো না, এখন যদি আমি এহান থাইক্যা একটা নাটকের মাইয়ারে তুইলা নিয়া যাইয়া ছয়জনে মিল্যা রেপ করি, তাইলে পার্টির বদনাম হইব। আর আপনে মিউচুয়াল কইরা দিলে বিষয়ডা আর দোষের মধ্যে পড়ল না। বোঝেন নাই ব্যাপারডা? আর না বুঝলে কন ছদরুলরে ডাকি। অয় আবার ভালো বুঝাবার পারে। তয় আমি...


    ভাইয়ের ফোন এল। আমি টিপুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় ফোন ধারার অনুমতি চাইলাম। টিপু আবার রুম থেকে বের হয়ে গেল।
    বলেন ভাই।
    একটু সমস্যা হইয়া গেল তো।
    কী সমস্যা, বলেন ভাই।
    ওই লোক তো শুনলাম ব্যাপক খারাপ। বুচ্ছ?
    আমার মেজাজটা এবার সত্যি বিগড়ে গেল। এত কিছুর পর তিনি আমাকে ফোন করে বলছেন তিনি লোক তো ব্যাপক খারাপ। আমার নাকের সামনে আজরাইল দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তিনি আমাকে বলছেন তিনি লোক তো ব্যাপক খারাপ।
    ভাই, তা তো আমি এখানে বসেই দেখতে পাচ্ছি। আপনার বলার দরকার কী? আপনি বলেন আমি এখন কী করব? আপনার বন্ধুকে কি ফোন করেছিলেন?
    হ্যাঁ করেছিলাম তো। সেই তো বলল ওই লোক ব্যাপক খারাপ। যা বলে, তা-ই করে।
    যা বলে তা-ই করে মানে কী। আমি এখন চৈতিকে তুলে দেব এর হাতে?
    কী সব কথা বলো বোকার মতো, হ্যাঁ? চৈতিকে ওর হাতে তুলে দেবে কেন?
    আমি তুলে না দিলে তো ওরা তুলে নিয়ে যাবে। আর সে জন্য তো আমি আপনাকে ফোন করেছি।
    সে জন্য ফোন করেছ তা তো আমি বুঝতে পেরেছি, তা আবার বলছ কেন?
    রেগে গেলে তিনি বেশ ঠান্ডা গলায় কথা বলেন। এটা তার তীব্র রাগের স্টাইল। আমি চিনি। তিনি এখন রেগে তেতে আছেন।
    আপনি রাগছেন কেন? আপনি কি আপনার বন্ধুকে ফোন করেছিলেন?
    করেছিলাম তো। সে বলল ওই লোক ব্যাপক খারাপ। যা বলে, তা-ই করে। এবার আমার হাসি পেল। আমি অতি কষ্টে হাসি চেপে বললাম, ঠিক আছে, এখন আমাকে বলেন তিনি আর কী বলেছেন? আমরা এখন কী করব, এসব কিছু বলেছে?
    তুমি বিষয়টা কেন বোঝার চেষ্টা করছ না। ওই লোক ব্যাপক খারাপ। যা বলে, তা-ই করে। তার ক্ষমতা অনেক। তারা সরকারি দলের লোক।
    ঠিক আছে ভাই, বুঝতে পেরেছি। ওই লোক ব্যাপক খারাপ। যা-ই বলে, তা-ই করে। তারা সরকারি দলের লোক। সবই বুঝতে পেরেছি, এখন আপনি আমাকে বলেন আমি কী করব? আমি এখন কী করে আপনার ইউনিটের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছাতে পারি তাই বলেন।
    কী করবে তা তো চট করে বলতেও পারছি না। ওই লোক এখন কোথায়?
    বারান্দায়।
    তার সাথে তোমার লাস্ট কী কথা হইছে?
    বলেছে আমি যেন নায়িকাকে বলে তার সাথে শুতে যাওয়ার ব্যাপার মিউচুয়াল করে দিই।
    ছি ছি ছি, কী যে অবস্থা। দাঁড়াও, আমি আমার বন্ধুর ছোট ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে দেখি।
    নম্বরটা আমাকে এসএমএস করে দেন।
    দিচ্ছি, দাঁড়াও, আমার ফোনে আবার নাই চার্জ।
    আপনি চার্জে লাগান এখনই। আপনার সাথে আমার নিশ্চয়ই অনেক কথা বলতে হবে। এখনই চার্জে লাগান।
    আমাদের এখানে কারেন্ট নাই, তুমি জানো না?


    আমার মনে ছিল না। আমার মাথাটা আরেকটু অকেজো হলো। তার ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে তার দিক থেকে কোনো সহযোগিতার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে যাওয়া। ভাগ্য ভালো, তার বউয়ের নম্বর আছে আমার কাছে। কিন্তু কে বলতে পারে সেটাও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে একটু পর। বিপদের সময় এমনটাই হয় বরাবর। আর কারও না হলেও আমার হয়। ভাই ফোন রাখার পরও দেখলাম টিপু নামের লোকটা ঢুকছে না। মনে হচ্ছে কারও সাথে কথা বলছে। আমার মোবাইলের ম্যাসেজ অ্যালার্ট টোন বেজে উঠল। ভাই জিহাদ নামের কারও নম্বর পাঠিয়েছেন। সাথে সাথে আবার তিনি ফোনও করলেন।
    শোনো, এটা আমার বন্ধুর ছোট ভাইয়ের নম্বর। নাম জাহিদ।
    আপনি তো লিখছেন জিহাদ।
    সরি, জাহিদ না, জিহাদই ওর নাম। আমিই বলার সময় ভুল বলেছি।
    তার মানে আপনি তারে ভালোভাবে চেনেনই না।
    ও তো আমার বন্ধুর ছোট ভাই।


    আমি কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিয়ে জিহাদ নামের লোকটিকে ফোন দিলাম। তার ফোন ওয়েটিংয়ে। এদিকে টিপু নামের লোকটাও কথা বলছে। তাহলে কি জিহাদ এই টিপুর সাথেই কথা বলছে। আবার না-ও বলতে পারে। আমি জিহাদকে ফোন দিতেই থাকলাম। টিমের সবাই এখনো বিষয়টি বুঝতে পারেনি। সরফরাজ ও রাকিব ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি। আমি সরফরাজকে বললাম, আমি একটু চৈতির কাছে যাচ্ছি। টিপু আসলে বলবে ম্যানেজ করতে গেছে। বলবে যে ম্যানেজ হলে ডিরেক্টর নিজেই আপনাকে নিয়ে যাবে নায়িকার কাছে। ঠিক আছে?
    ঠিক আছে, ভাই। কিন্তু আপনে কি সত্যি সত্যি ম্যানেজ করতে যাচ্ছেন?
    আমি সরফরাজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম, তোমার কি তা-ই মনে হচ্ছে?
    সরফরাজ কোনো কথা বলল না। আমি গিয়ে দেখি চৈতি তার মায়ের সাথে কী একটা বিষয় নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে। আমাকে দেখেই বলল, ভাইয়া, আর কতক্ষণ? আমার মেকআপ তোলা শেষ।
    আমার লাইট তো এখনো তোলা হয়নি।
    আমি খুবই স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছি, যেন কিছুই হয়নি। ভাবটা এমন, আরে, এ রকম একটু-আধটু দেরি শুটিং ইউনিটে হয়েই থাকে।
    একটু তাড়াতাড়ি করেন, প্লিজ। কাল সকাল নয়টায় আমার ক্লাস টেস্ট।
    আচ্ছা, ঠিক আছে, ওদের শেষ হলে আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। ঠিক আছে? আন্টি, আর বেশি দেরি হবে না।


    আমি চৈতির রুম থেকে বের হয়েই আবার জিহাদকে ফোন দিলাম। এখনো ওয়েটিংয়ে। ওয়েটিং দেখেও আমি ফোন কেটে দিলাম না। কল কন্টিনিউ করলাম। নো এনসার। আবার ফোন দিলাম। ওয়েটিং। কিন্তু এবার ফোন রিসিভ হলো।
    হ্যালো, জিহাদ ভাই?
    ভাই, আমি আপনার ওই বিষয় নিয়েই কথা বলছি, আমি আপনাকে পাঁচ মিনিট পরই ফোন দিচ্ছি।
    আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিল। আমি আবার ফোন দিলাম। এখন বিজি। আমি কল দিয়েই যাচ্ছি। এখন আবার ওয়েটিংয়ে। আমি রাকিব আর সরফরাজকে ফোন দিয়ে দোতলায় ডাকলাম। পরবর্তী ঘটনা আবার সব খুলে বললাম। আমি আবার ডিরেক্টর ভাইকে ফোন দিলাম। তার ফোন বন্ধ। সাথে সাথে ফোন দিলাম ভাবিকে। তার ফোনও বন্ধ। এর মধ্যে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এসে বলল আমাকে টিপু ডাকছে। ছেলেটি চলে যাওয়ার পর রাকিব আমাকে বলল, দোচ, চল ক্যাচালে যাই। আমরা তো আর লোক কম না। লাইটের সব পোলা আমারে পীর মানে। বললে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।


    রাকিব সহজ ছেলে নয়। আমি তাকে কিশোর বয়স থেকে চিনি। ওর মাথা গরম। কিন্তু যতই হোক, টিপুকে ঠেক দেওয়ার মতো শক্তি এখন কোনো দিক থেকেই আমাদের নেই। এটা টিপুর নিজের এলাকা। শুধু এখানে কেন, সারা বাংলাদেশেই সে আমাদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। আমরা তাদের সাথে পারব কী করে?
    তোরা দুজন চৈতির ঘরের আশপাশে থাক।
    আচ্ছা, তুই যা।
    আর তোরা দুজন একটু ভাইকে ফোন দিতে থাক আর সরফরাজ এক কাজ করো, তুমি এই নম্বরটা নাও। জিহাদ নামের এক লোকের নম্বর এটা। ফোন দাও। বলো এখানকার ঘটনা। আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাইকে একবার, তার বউকে একবার আবার জিহাদ নামের লোকটাকে ফোন দিচ্ছি একবার করে। মজার বিষয় হলো, এই যে সবার ফোনই বন্ধ। আমি মনে হয় এখনই উন্মাদ হয়ে যাব। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কার ওপর জানি না। আশ্চর্যের বিষয় এই যে টিপুর ওপর আমার রাগ হচ্ছে না একটুও। আছে প্রচণ্ড ঘৃণা। যেন একটা পাগলা কুক্তা এসেছে আমাকে কামড়াতে। তার জিব লকলক করছে। লালা ঝরছে সেই জিব থেকে। 

    আমাকে এখন নিজের বুদ্ধি আর শক্তি দিয়ে বাঁচতে হবে। এই কুত্তা কামড়ালে আমি বাঁচব না। কিন্তু জীবন থাকতে এই কুত্তার সাথে কম্প্রোমাইজ করা যাবে না। এটা আমার ছোটবেলার শিক্ষা। ছোটবেলা থেকে আমি এ রকম কুত্তার মুখে অনেকবার পড়েছি। আমি নিচে এসে দেখি টিপু বেশ শান্ত হয়েই বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, কী ভাই, রাজি হইছে না?
    তার গলার সর স্বাভাবিক।

    আমি নিজেও একটু স্বাভাবিক থেকে বললাম, ভাই, আমি বলেছিলাম। কিন্তু দেখলাম ও এই ধরনের মেয়ে না। কোনোভাবেই রাজি হচ্ছে না।
    তাইলে আমি নিজেই যাই। কথা বলি তার লগে।
    না না ভাই, আপনি যাবেন না। আমি দেখছি। আমাকে আরও কিছু সময় দেন। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমি আরও চেষ্টা করব। আপনার না যাওয়াটা যে ভালো হবে, তা আপনি নিজে আমার চেয়ে ভালো জানেন। আমাকে একটু সময় দেন।
    আমিও তো যাইতে চাই না। আমি জানি তো আমার যাওয়া ভালো দেখায় না। কিন্তু আপনে তো পারতেছেন না।
    টিপু ভাই, আমার ওপর বিশ্বাস রাখেন, দেখেন আমি কী করি। আমাকে আরেকটু সময় দেন।
    আরেকটু মানে কত? আমি কি সারা রাইত বইয়া থাহুম? আমার কাজকাম নাই? তা ছাড়া পিনিকপুনিক কইরা আইছি, একটা ব্যাপার আছে-না? আপনে যান, তাড়াতাড়ি করেন। পোলাপান বাবাটাবা গালাইব। আপনে তাড়াতাড়ি করেন। আমি বহা আছি। এই বলে সোফায় একটু গা এলিয়ে দিল। ছদরুল দুইজন লোক নিয়ে এসে ঢুকল রুমে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ছদরুল বলল, আপনে কই কই ফোন করেন? এই সব ছাড়েন, ডাইরেক্টার বাই। ওরা আমগোরটা খাইয়া-পইরা বাঁচে। বোঝা গেছে? এখন আবার ফোন দেন, দেহেন বন্ধ করার ব্যবস্থা করছি। আউল-ফাউল কাম বাদ দেন। ভাইয়ে যা কয়, হুনেন। আপনের লইগ্যা ভালা, আমগো লাইগ্যাও ভালা।


    আমি টিপুর দিকে তাকিয়ে দেখি এমনভাবে সোফায় শুয়েছে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন যে করেই হোক, আমাকে এই জানোয়ারদের কাছ থেকে বিভিন্ন ছুতোয় সময় বের করতে হবে। আর ততক্ষণে আমকে এখান থেকে নিরাপদে বের হওয়ার পথ খুঁজে বের করতে হবে। আর আমি এখনো জানি না সেটা আদৌ সম্ভব হবে কি না। দোতলায় গিয়ে দেখি লাইটের সব ছেলে, প্রডাকশনের সবাই, ক্যামেরার ক্রুরা সবাই চৈতির রুমের আশপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রাকিবকে আলাদা করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী, তুই কি ওদের কিছু বলেছিস নাকি?
    দোস্ত, নাচতে নাইমা ঘোমটা দিয়ে লাভ কী?
    এমন সময় লাইটের ইসমাইল এসে বলল, ভাই, আপনার সাথে তো কম কাজ করি নাই। আপনাকে বিপদে ফেলে আমরা কোথায় যাব? লাইটের সব ছেলেপেলে কাটার স্ট্যান্ড খুলে চৈতির রুমের পাশে স্টক করে রেখেছে।
    জীবন থাকতে আপনের নায়িকার কোনো ক্ষতি আমরা হতে দেব না, ভাই।
    এ যেন আমেরিকার টিম সিক্স সিলের সামনে বাংলাদেশের কোনো জোড়াতালি দেওয়া প্লাটুন। তা-ও আবার লাঠি নিয়ে।

    আমরা মাঝেমধ্যে বলি-না মাথায় কাজ করে না। আমার সত্যিই এখন মাথায় কাজ করছে না। আমি ফোন হাতে নিয়ে নম্বরগুলো দেখছি কাকে ফোন দিলে আমার একটু কাজে আসবে। হঠাৎ মোবাইলের একটা নম্বরে আমার চোখ আটকে গেল। জহির মোহাম্মদপুর। ইয়েস হি ক্যান হেল্প মি। মি. জহির। জহির কোনো এক মন্ত্রীর ধর্মপুত্র। আজকাল আসল পুত্রের চেয়ে ধর্মপুত্রদের জোর থাকে বেশি। আর এই জহির মন্ত্রীর যে ধরনের পুত্রই হোক না কেন, সে তার জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমাকে বাঁচাবে। জহির সে বিষয়ে আমার কাছে কমিটেড।

    জহিরের ঘটনাটা একটু খুলেই বলি, নাহলে একটা ধোঁয়াশা থেকে যাবে। জহির আমার কেউ হয় না। জহিরের সাথে আমার যখন দেখা হয়, তখন আমার সময়টা খুব খারাপ। তখন আমি সবেমাত্র বিয়ে করেছি। আমার মাথার ওপর তখন বিপদ আর বিপদ। যেদিকে হাত বাড়াই, কিছুই দেখি না। বাসা বলতে কল্যাণপুরের একটা সাবলেট বাসায় ঘুপচি রুমে থাকি। আমার বউ তখন আমার শার্ট-প্যান্ট পরে দিন কাটায়। তখন আমার হাতেও তেমন কোনো কাজ নেই। তো এ রকম সময় একদিন আমি ফার্মগেট থেকে হেঁটে কল্যাণপুর যাচ্ছিলাম। আমার পকেটে নাই একটাও পয়সা। দারিদ্র্য কাকে বলে তা কাজী নজরুল কত বছর বয়সে বুঝেছিলেন তা জানি না কিন্তু আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম হাড়ে হাড়ে। আর ওই রকম সময়ে অনেকের চরম নৈতিক অবক্ষয়ও হয়ে যেতে পারে। যা-ই হোক, আমি ফার্মগেটের বড় ওভারব্রিজটা পার হয়ে তেজগাঁও কলেজের সামনে থেকে হেঁটে আসছি। হঠাৎ আমার সামনে ক্যাচ করে ব্রেক কষল একটা কালো রঙের টয়োটা হায়েজ গাড়ি। আমি ধরেই নিয়েছি যে এই গাড়ি আমার উদ্দেশে থামানো হয়নি। কারণ, আমি হুমায়ূন আহমেদের চরিত্র হিমু নই আর আমার ঢাকার শহরে বড়লোক খালা-ফুপুও নেই। আমি গাড়িটা পার হয়ে ওপারে যাব, এর মধ্যে গাড়ি থেকে মুখ বাঁধা চার-পাঁচজন লোক এসে আমাকে কিছু বোঝার সুযোগ না দিয়েই চ্যাংদোলা করে নিয়ে তুলল গাড়িতে।

    আমি প্রথমে মনে করলাম আমার কোনো বন্ধু, যে হঠাৎ বড়লোক হয়ে গাড়ি কিনে আমাকে চমকে দেওয়ার জন্য দুষ্টুমি করছে। আমাকে মোট চারজন লোক চেপে ধরে গাড়িতে তুলল প্রকাশ্য দিবালোকে আর আমি হাসছি। তারপর যখন দেখলাম গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে, তখন ভাবলাম, এরা হয়তো ডিবি পুলিশ। কারণ, আমার এমন কোনো বন্ধু নেই, যারা এই ধরনের গালাগাল করে আমার সাথে তামাশা করবে। ঢাকায় অবশ্য বন্ধুরা একে অপরকে একটু অন্যভাবেই সম্বোধন করে। প্রায়ই শুনি একজন অন্যজনকে বলে, আরে খানকির পোলা, তোর মায়রে বাপ, এত দিন কই আছিলি হালায়। আমাদের বন্ধুত্ব এমন নয় একদমই। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ একজন খুব কষে আমার চোখ বেঁধে ফেলল। আমি যেন বোবা হয়ে গেছি। আমার যেন কিছু বলারই নেই। কারণ, এ রকম ঘটনা আমার জীবনে এই প্রথম। আমি কী বলব বা কী করব, কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ আমার মুখ ফুটে বেরিয়ে এল, ভাই, আমাকে চোখ বেঁধে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আপনারা...আপনারা কারা?


    আমি কথা বলে শেষ করতে পারলাম না। এর আগেই আমার চোখে-মুখে-গালে-কানে-মাথায় ধুমাধুম চড়-থাপ্পড়, ঘুষি-কিল পড়তে আরম্ভ করল। আমার চোখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা থাকায় চোখে দেখছিলাম না কিছু ঠিকই কিন্তু এখন আমি চোখে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট জোনাক পোকার মতো আলো দেখতে লাগলাম। হঠাৎ ড্রাইভিং সিটের সামনে থেকে কে যেন সবাইকে ধমক দিয়ে বলে উঠল, কেউ গায়ে হাত দিবি না, খবরদার। আমি এক কথা দুইবার কমু না।
    আমাকে মারা বন্ধ করল। আমি যে আমার মুখে-গালে হাত দেব, তার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আমার হাত দুই পাশ দিয়ে বেশ শক্ত করে দুজন অথবা তারও বেশি লোক ধরে আছে। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ হাস্যকর লাগছে। কারণ, আমার মতো গোবেচারা টাইপের একজন মানুষকে কেউ এ রকম ধরে আছে, ভাবতেই আমার হাসি পাচ্ছে। দুই-চার মিনিট চলার পর আমি বুঝতে পারলাম, গাড়ি এর মধ্যেই কয়েকবার মোড় ঘুরিয়েছে। আমি এমন একজন লোক যে আমার বাসা খুঁজে পেতে আমার প্রায়ই ঝামেলা হয়। এমনটা বেশ কয়েকবার হয়েছে যে আমি বাসার কাছাকাছি কোনো এক গলিতে গিয়ে বউকে ফোন করে বলেছি, আমাকে নিয়ে যাও, চিনতে পারছি না। যাদের জিজ্ঞেস করছি, তারাও ঠিক করে বলছে না। বেশ কিছু সময় চলার পর সামনে থেকে আমার সেই রক্ষাকর্তা বেশ সতর্কতার সাথে হঠাৎ বলে উঠল, এই, সবাই মেশিন গুঁইজ্যালা, সামলে পুলিশ।


    বুঝলাম, এরা আসলে পুলিশের লোকও না। তাহলে হচ্ছে কী এসব আমার সাথে? আমার জানামতে আমার এমন কোনো শত্র“ও নেই যে আমাকে দিনদুপুরে গুন্ডা দিয়ে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাবে। তাহলে ব্যাপারটা কী হচ্ছে? আমি আবার সাহস করে সামনের লোকের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনারা কারা? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?


    সামনে বসে থাকা লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরে অভিনয় করে বলল, আমরা কারা তা তো আপনি জানেন, ভাইজান। আর আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি, তা-ও আপনি জানেন। আপাতত নাটক বন করেন। আগে জাগায় যাই, বহুত নাটক হইব। একটু ধৈর্য ধরেন।
    আমি কিছু বুঝতে পারছি না, ভাই, আপনারা কারা?
    এই প্রশ্ন করার সাথে সাথে পাশ থেকে বেশ জোরে আমার কান বরাবর এক রাম থাপ্পড় দিয়ে বলল, খানকির পোলা, বুঝতে পারছিস না আমরা কারা? একটু পরই টের পাবি, শুয়োরের বাচ্চা।
    মামু একবার কইছি-না নো গায় হাত দেওন্তিজ।
    কী করুম, ক? খানকির পুত কি কম জ্বালাইছে?
    বলেই আবার একটা মারল আগের জায়গায়ই। এবার আমার চোখ বাঁধা থাকা সত্ত্বেও আমি বুঝতে পারলাম আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি। আমার মাথার মধ্যে রেডিও সেন্টার খোলার আগে যে টুউউউউ করে একটানা বিরক্তিকর একটা শব্দ হয়, সেই রকম শব্দ হচ্ছে। আমি অল্প সময়ের মধ্যেই ডিসিশন নিলাম, নো কোশ্চেন। যত কথা, তত মাইর। আমি জানি না আমাকে কারা ধরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবে একটা জানি যে তাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি বরং এদের ডেরায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। সেখানে নিয়ে নিশ্চয়ই সাথে সাথে আমাকে মেরে ফেলবে না।
    ভাই ট্যাকাগুলা কী করছেন, কন। বলল সামনের লোকটা।
    আপনে যে এই তিন দিনেই টাকা খরচ কইরা ফালাইছেন, তা আমরা বিশ্বাস করি না। তয় কিছু খরচ করছেন, তা আমরা জানি। বলেন বাকি টাকা কই রাখছেন, কার কাছে রাখছেন। বিগত দুই দিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। ট্যাকা কই রাখছেন, কার কাছে রাখছেন, কন। মারুম না, ধরুম না, কথা দিলাম। বলল আমার ডান পাশ থেকে একজন।


    আমি বুঝতে পারছি না এরা আসলে কী বলতে চায়।
    ভাই আপনারা কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কিসের টাকা, কার টাকা? আমি কোথায় টাকা পাব? এই কথা বলার সাথে সাথে আবার সবাই মিলে আমাকে মারতে শুরু করল। আমি আর কিছু মনে করতে পারলাম না। দেড় দিন ধরে আমি ও আমার বউ না খেয়েই আছি। আমি সহজেই জ্ঞান হারালাম।


    পানির ঝাপটায় আমার জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার পরপরই চোখ মেলে দেখলাম আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়েছে, আমার সামনে হাতে একটা মেলামাইনের বড় বাটিতে পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন। তার আকার আকৃতি আর গায়ের রং পাকিস্তানি পাঠানদের মতো। মুখের সাথে মানানসই একজোড়া পেল্লাই গোঁফ রয়েছে নাকের নিচে। শুধু মাথায় একটু চুল কম বলে বয়সটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। আটাশ হতে পারে আবার আটত্রিশ হলেও অবাক হব না। আমার চোখের পিটপিটানি দেখে বলল, জহির, এদিকে আয়, জ্ঞান ফিরছে।
    জহির নামে যে আমার সামনে আবির্ভূত হলো সে টকটকে ফরসা, হ্যাংলা স্বাস্থ্যের একটা ছেলে কিন্তু তার উচ্চতা কম করে হলেও ছয় ফিট।


    একটা চেয়ার টেনে আমার সামনে বসল জহির। আমি একটা সোফায় বসে আছি। আমি একটি অভিজাত বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসা আছি। চারপাশের আসবাব দেখে মনে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক যে বাড়ির মালিকের পয়সা-রুচি কোনোটারই ঘাটতি নেই। আর এখানে এখন যারা থাকে, তারা এই বাড়ির মালিক। কারণ, ঢাকা সহরে এত্ত বড় ড্রয়িংরুম আর দামি আসবাব কোনো ভাড়াটে ম্যান্টেইন করবে না। সে ভাড়াটে পয়সাওয়ালা হলেও না। কারণ, এখানকার আসবাবগুলো নড়াচড়া করানোও বেশ কষ্টসাধ্য। একটা পিয়ানো রয়েছে বিশাল ড্রয়িংরুমের এক কোণে। আমার বাঁ পাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির পাশের দেয়ালে একটা দোনলা বন্দুক ঝোলানো রয়েছে। ড্রয়িংরুমের দেয়ালগুলোতে যে ছবিগুলো রয়েছে, তার কয়েকটি হাতে আঁকা পোর্ট্রটে, কয়েকটি সাদাকালো ছবিও আছে, বাকি সব রঙিন আধুনিক যুগের ক্যামেরায় তোলা।
    আমার দিকে তাকান।
    আমি জহিরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাই, আমরা একটু কথা বলি। মারধর একটু পরে করেন। আর না হলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে যদি মারতেই থাকেন, তাহলে মনে হয় সমস্যার সমাধান হবে না।


    ঠিক আছে, বলেন। আমি আপনারে কথা দিলাম, কেউ আপনার গায়ে একটি টোকাও দেবে না। আপনি বলেন, টাকা কী করছেন?
    আমি বুঝতে পারছি না আপনারা কিসের টাকার কথা বলছেন। আমার মনে হয় আপনাদের কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। আপনারা কি আরেকটু ভালো করে খোঁজ নেবেন, প্লিজ।
    আপনার নাম ল্যাংড়া কামাল না?
    জি না ভাই, আমার নামের সাথে কামাল আছে, বাট কামালের সাথে তো ল্যাংড়া নেই। কারণ, আমি তো ল্যাংড়া না।
    তুই তো ল্যাংড়া না, তুই মাইনসেরে ছিনতাই করার পর ল্যাংড়া কইরা দেস, খানকির পুত, তার লাইগ্যা তোর নাম হইছে ল্যাংড়া কামাল।
    এর মধ্যে দেখলাম দোতলার সিঁড়ি বেয়ে এক অতীব সুন্দরী মেয়ে দুই-তিন বছরে একটি ফুটফুটে ছেলেশিশু কোলে নিয়ে নামছে। নামতে নামতেই সে বেশ বাজখাই গলায় বলল, তোমারে না একদিন কইছিলাম এই সব ঝামেলা বাসায় নিয়া আসবা না, পোলায় আমার নষ্ট হইয়া যাইব তোমার কামকাইজ দেখলে।


    আমি একটু অবাকই হলাম। এ রকম সুন্দরী একটি মেয়ের মুখে ঢাকাইয়া মিক্স ভাষা একদমই বেমানান। আমার কেন যেন মনে হলো, এই মেয়েটি শুদ্ধ কথা বলতে পারে এবং বেশ ভালোভাবেই পারে। তবে এই কণ্ঠটি আমার বেশ পরিচিত মনে হলো। কণ্ঠটি খানিকটা বলিউডের নায়িকা রানী মুখার্জি কোয়ালিটির। সেই জন্য পরিচিত লাগছে, না অন্য কোনো কারণে, তা নিরুপণ করা এই মুহূর্তে আমার দ্বারা সম্ভব নয় একদমই। এইটা তো বড় আব্বার কেস। এইটা তো অন্য কোথাও নেওয়া যাইব না, বোঝো না তুমি।
    আমি কী বুঝি, কী না-বুঝি, সেসব তোমার দেখতে হইব না, তুমি এক্ষুনি এই সব নিয়ে বিদায় হও। নাইলে আমি গায়ে কেরোসিন নিয়ে আগুন দিমু।


    বুঝতে পারলাম, এ বেশ ঝাঁজালো মেয়ে। একে এর সন্ত্রাসী স্বামীও ভয় পায়।
    জহির আমার দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, ঠিক তিন মিনিট সময় দিলাম তরে আমি। তার মধ্যে কবি যে সেদিন কে তরে ট্যাকার ইনফরমেশন দিছিল আর ট্যাকাগুলা কই রাখছ। ব্যস, যেইখান থাইক্যা তুইলা আনছিলাম, সেইখানে রাইখ্যা আমু। মায়ের দুধের কসম। আর যদি না কস, তাইলে তিন মিনিট পর চাইর মিনিটের মাথায় তর মাথায় আজমল একটা বুলেট হান্দাইয়া দিবো। ওকে? সময় মাত্র তিন মিনিট, এক শ আশি সেকেন্ড। কাউন্ট ডাউন শুরু। আজমল, ঘড়ি দেখ। সঠিক উত্তর না পাইলে ঠিক এক শ একাশি সেকেন্ডের মাথায় ওরে গুলি করবি।
    এ কথা শুনে আজমল বলল, ভাই, এই জাগায়?
    হ, এই জায়গায়ই গুলি করবি। লাশ লইয়া তগো চিন্তা করনের দরকার নাই।
    আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ভাই, আপনারা কারা আমি জানি না, আমাকে তিন মিনিট দেন আর তিন ঘণ্টা দেন, আমি যা, আমি তো তা-ই বলব। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি ল্যাংড়া কামাল না। আমার নাম আহমেদ কামাল বাবু। আমি একজন লেখক। আমি খুবই ছাপোষা ধরনের মানুষ। আপনারা কিসের টাকার কথা বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি ল্যাংড়া কামাল না। আমি তাকে চিনিও না। আমি আহমেদ কামাল বাবু। আমি একজন লেখক, লেখালেখিই আমার কাজ।
    আমার এ কথা শুনে জহির খুব শান্ত গলায় আজমল নামের মোচওয়ালাকে বলল, শুট দ্য বাস্টার্ড।


    আজমল আমার মাথায় পিস্তল ঠেকাল। আমি চোখ বুজে আছি। মনে হচ্ছে সময় থেমে আছে। এখনই আজমল নামের লোকটা আমার মাথায় গুলি করবে। আমার চোখের সামনে চট করে মায়ের মুখটা ভেসে উঠল একমুহূর্তের জন্য। কেউ একজন দুমদুম করে একটু দূর থেকে দৌড়ে আসছে। আজমল তার পিস্তলের সেফটিকেস অন করল। আমার মুখের সামনে আমার বাবার মুখটা ভেসে উঠল। সে দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসছে। যার অর্থ, বাবা, তোর কিছুই হবে না। আজমল ট্রিগার টেনে দিল। বিকট শব্দ হলো রুমের মধ্যে। আমি সোফার ওপর পড়ে গেলাম। আমি ধরে নিলাম, আমি মরেই গেছি। আমার মাথায় গুলি লাগা সত্ত্বেও আমার মাথা এখনো কেন কাজ করছে, আমি বুঝতে পারলাম না। একটা নারী কণ্ঠ বেশ জোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে। আমার আর কিছু মনে নেই।
    আমার জ্ঞান ফেরার পর আমি যে দৃশ্য দেখলাম, তা দেখে আমি শুধু হতভম্বই হলাম। আমি শুয়ে আছি একটা ধবধবে সাদা বিছানায়। আমার মাথার কাছে বসে আছে সেই ঝাঁজালো কণ্ঠের সুন্দরী আর পায়ের কাছে বসে আছে আমার সব হন্তারক। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই প্রায় সবাই একত্রে বলে উঠল, জ্ঞান ফিরছে, জ্ঞান ফিরছে।


    আমি প্রথমেই উঠে বসতে চাইলাম। আমার গায়ে হাত দিয়ে জহিরের বউ বলে উঠল, ছোট বাবা, উইঠো না, প্লিজ, প্লিজ। ছোট বাবা, আমি ময়নার মা। আর ও জহির, আপনার জামাই। আমার মাথাটা ভনভন করে ঘুরে গেল। এটা কী করে সম্ভব? আমার বর্তমান বয়স ত্রিশের কিছু বেশি। আমার ঔরসজাত কোনো সন্তান নেই। তবে আমি অনেককে বলে বেড়াই, আমার একটি কন্যাসন্তান আছে। আর তারও একটি গল্প আছে।

    প্রখ্যাত প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানের সম্পাদিত মৌচাকে ঢিল (অধুনা লুপ্ত, যায়যায়দিন) পত্রিকার আমি একজন অনিয়মিত পাঠক ও লেখক। সেখানে বিভিন্ন সময়ে আমার ছোট-বড় বেশ কয়েকটি গল্প ছাপা হয়েছে। ২০০৮ সালের ভালোবাসা সংখ্যায় একটা প্রেমের গল্প ছাপা হয়। আমার অনুমতি নিয়েই সম্পাদক শফিক রেহমান আমার মোবাইল নম্বর আমার লেখার নিচে দিয়ে দিয়েছিলেন। লেখাটি বেশ পাঠক প্রিয় হয়েছিল। তখন সারা বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য ফোন আসতে শুরু করল আমার মোবাইল ফোনে। নানা বয়সের, নানা ধর্মের, নানা বর্ণের, নানা জাতের মানুষ সারা বাংলাদেশ থেকে আমাকে ফোন দিত। এমনকি দেশের বাইরে যেসব মানুষ থাকত, তারাও প্রচুর ফোন দিত। অর্থাৎ সারা পৃথিবীর যেখানে বাঙালি আছে আর আমার লেখা পড়েছে, তাদের মধ্যে বেশিসংখ্যক লোকই আমাকে ফোন দিয়েছে। কেউ কেউ আবার শুধু এসএমএসই করেছে। ফোন করেনি। আবার কেউ কেউ ফোন করেনি, এসএমএস করেনি, আমার ই-মেইলে সুন্দর একটি গ্রিটিং কার্ড পাঠিয়ে মোসাহেবি না করেই লেখার গঠনমূলক প্রশংসা করেছে। আবার এমনও হয়েছে স্বামী-স্ত্রী একত্রে এক ফোন থেকে লাউড স্পিকার অন করে আমার সাথে কথা বলেছে। যেই আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে, আমি তার সাথেই কথা বলেছি। আবার কখনো কখনো কাজের চাপে অনেকের সাথে কথা বলতে পারিনি। এই পাঠকদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো আমার সাথে কথা বলতে না পেরে রাগও করেছে, আবার কারও কারও সাথে বেশ ভাবও হয়েছে। নিশাত জাহান মুনিয়া নামের একজনের সাথে এমন ভাব হলো যে তাকে একেবারে জীবনসঙ্গী করে নিলাম।


    সে সময় ময়নার মা বলতে পরিবার-ত্যাগী একটি মেয়ে আমাকে ফোন করত। মেয়েটি ছিল একজন বারবনিতা। সে আমাকে তার নাম বলত না। তবে সে বলেছিল যে সে হিন্দু। অন্য ধর্মের একজনকে ভালোবেসে ধোঁকা খেয়েছে মেয়েটি। বাড়ি থেকে পালিয়েছিল ভালোবাসার মানুষটির ওপর ভরসা করে। আসার পথে প্রেমিক তাকে পূর্বের ঠিক করা দালালের কাছে চৌত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় ২০০৫ সালে। তখন মেয়েটি মাত্র আইএ পাস করেছে। সে মৌচাকে ঢিল পত্রিকাটি আগে থেকেই পড়ত। পতিতালয়ে আসার পরও খদ্দেরের মাধ্যমে সে পত্রিকাটি পড়তে পারত। সেখানে আমার লেখা পড়ে আমাকে ফোন করেছিল। সেই শুরু। তারপর সে প্রতিদিন আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন করত। সুখ-দুঃখের অনেক কথাই শেয়ার করত। আমি তাকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতাম। একদিন হঠাৎ করে আমার চেয়ে মাত্র চার বছরের ছোট মেয়েটি আমাকে বলল, আমি যদি তোমাকে ছোট বাবা বলে ডাকি, তাহলে কি তোমার কোনো সমস্যা আছে?

    আমি একবাক্যে বললাম, না, কোনো সমস্যা নেই। তবে তোর ছেলেমেয়ে যেন আমাকে নানা ডাকে।
    ছোটবেলা থেকে ভালোবাসা খুঁজে ফেরা মেয়েটি ভার্চুয়াল জগতে আমার বুকে মাথা গুঁজে দিল। আমিও হয়তো নিয়েছিলাম খানিকটা। তারপর অনেক কথা। আমি ওর সাথে প্রতিদিন প্ল্যান করতাম কী করে ওকে বের করে আনা যায়। তবে মেয়েটি প্রায়ই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চাইত। এর মধ্যে এক সপ্তাহের জন্য একটি আউট কলে গিয়ে গর্ভবতী হয়ে গেল সে। যখন টের পেল, তত দিনে তার প্রেগনেন্সির বয়স আড়াই মাস। এই ঘটনার আগে থেকেই সে এক মাদক ব্যবসায়ীর প্রেমে পড়ে আর মাদক ব্যবসায়ীও তার প্রেমে পড়ে। মাদক ব্যবসায়ী তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। বাবা হতে চায় মেয়েটির অবৈধ সন্তানের। আর মেয়েটির মধ্যেও মা হওয়ার একটা প্রবল বাসনা তৈরি হয়। সেই সময় আমি তার সাপোর্ট দিয়েছি। আমি বলেছি তাকে যে তোমার চেষ্টা থাকবে তাকে যেন তুমি মাদক ব্যবসা ছাড়াতে পারো। যদি সে তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে, তাহলে সে মাদক ব্যবসা ছেড়ে দেবে। আর জীবন-সংসার বড় মায়ার জায়গা, এই মায়া-মমতার জন্য মানুষ অনেক কিছু ত্যাগ করে নির্দ্বিধায়। তুমি এগিয়ে যাও। আমি আছি তোমাদের সাথে। কিন্তু বাস্তবে আমার আর থাকা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ একদিন ফোন ছিনতাই হওয়ায় ওর সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। আর ও থাকত এমন একটা জায়গায়, যেখানে গিয়ে ওর সাথে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করাটা আমার দ্বারা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। আমি আমার আগের সিমটি আর তুলতে পারলাম না। ময়নার মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটির সাথে আমার বাস্তবে কখনোই দেখা হয়নি। এই প্রথম। আমি তার রূপ দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। এমন মেয়েকে যে ভালোবাসার নাম করে বেচে দিয়েছে, সে কেমন। তাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করে। আমি ওদের নিষেধ না মেনে উঠে বসলাম। ময়নার মা সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস দুধ এনে মুখের সামনে ধরে বলল, নেও বাবা, খাও।



    তারপরের ঘটনাগুলো সাধারণ। মেয়েটি সেদিন আমাকে নাম বলেছিল। তার আসল নাম শিউলি। ওরা দুজন বিয়ে করে এখানে থাকছে। শিউলির সেই পেটের বাচ্চাটা এখন তিন বছরের এক ফুটফুটে শিশু ছেলে। ছেলে হওয়া সত্ত্বেও শিউলি তার নাম রেখেছে ময়না। জহিরের পৃথিবী এক দিকে আর ময়না এক দিকে। জহির এখন রাজনীতি করে। মাদক ব্যবসা সে ছেড়ে দিয়েছে। তবে মাদক ব্যবসার চেয়ে রাজনীতিতে পয়সা বেশি। জহির শিক্ষিত ছেলে। পরে জানলাম, জগন্নাথ থেকে বাংলায় এমএ করেছে। কিন্তু ছাত্রজীবন থেকেই মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিল। পেছনে ফেরার সুযোগ থাকলেও কাঁচা পয়সার হাতছানি তাকে ফিরতে দেয়নি। এখন রাজনীতিতে ঢুকে সব নীতিই হালাল করে নিয়েছে। তাতে শিউলির কোনো আপত্তি নেই। সেই দিন থেকে জহিরও আমাকে ছোট বাবা বলে ডাকে। সম্মানও করে। ওই দিন ফিরে আসার সময় বলেছিল, প্রয়োজনে জহির যেকোনো সময় আমার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। আমি আজ অনেকগুলো মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্নে জহিরের ফোনে এসএমএস পাঠালাম।


    আমি আশুলিয়ায় জীবন শঙ্কায় আছি, ওমুক মন্ত্রীর ভাতিজা টিপু আমার শুটিং ইউনিটসহ তার বাগানবাড়িতে আটকে রেখেছে, সে নায়িকাকে তার শয্যাসঙ্গী হিসেবে চায়, আমাকে বাঁচাও।
    জহির এসএমএসটি পড়েই আমাকে ফোন করল। আমি জহিরকে সব খুলে বললাম।
    সব শুনে জহির প্রথমেই বলল, ও খুবই খারাপ লোক, ছোট আব্বা। তয় আপনে একটুও ঘাবড়াইয়েন না। আমি এহন গাবতলী। আমার লগে পোলাপান-মেশিন-গাড়ি সব আছে। আপনে একটুও ঘাবড়াইয়েন না। ও যেই হউক, আমি ১৫ মিনিটের মধ্যে আপনারে সেইফ করতেছি। আপনি একদমই ঘাবড়াইয়েন না। পারলে পনেরোটা মিনিট একটু যেভাবেই হোক কৌশল খাটাইয়া নিরাপদ থাকেন। দরকার হইলে আমি ওর চাচারেসহ তুইলা নিয়া আমু। আশুলিয়ায় আমার পোলাপান আছে। তারা এখুনি ওর বাড়ি ঘেরাও দিয়া ফেলবে, আমি বইলা দিতেছি। আর আমার আইতে মাত্র পনেরো মিনিট লাগবে।


    আমি নিজেকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করলাম। শরীরটা বেশ হালকা লাগতে শুরু করল। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। মানুষ টেনশনে থাকলে সিগারেট খায়, আমি খেতে পারি না। এখন মনে হচ্ছে আমি টেনশন-ফ্রি, তাই সিগারেট ধরালাম। হঠাৎ বাইরে একটা শোরগোল শুনতে পেলাম। আবার অল্পতেই থেমে গেল। বেশ কয়েকটি কুকুর একত্রে ডেকে উঠল। ছদরুল এসে আমাকে বলল, ভাইজান জানতে চাইছে নাইকা কী কইছে। বিশ মিনিটের মধ্যে রেডি হইয়া আসতেছে। ভাইজানরে জানান।
    এই লাস্ট বিশ মিনিট। তারপর আর এক মিনিট তো দূরের কথা, এক সেকেন্ডও যেন দেরি না হয়। তাইলে কিন্তু টান দিয়া ফার্মের মুরগির মতো ছিঁড়া ফেলামু। বলে ছদরুল দুই হাত দিয়ে টান দেওয়ার ইশারা করল। সাথে সাথে তার বিশাল পেট বেশ হাস্যকরভাবে দুলে উঠল। আমি অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখলাম। বুঝতে পারছি ছদরুল প্রচুর বাংলা মদ খেয়েছে। মুখ দিয়ে কম দামি সিগারেট আর বাংলা মদের গন্ধ মিলে এমন একটা বিশ্রী গন্ধ আসছে যে আমার বমি পেয়ে যাচ্ছিল। 


    হঠাৎ টিপু ছদরুলকে ডাকল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। সবাই নেশা করে আছে। জহির আর তার লোকজনের জন্য এটা একটা বিশাল প্লাস পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াবে। আমি বারবার মোবাইলে সময় দেখছি। পনেরো মিনিট বলেছে জহির। আমি টিপুর কাছ থেকে নিয়েছি বিশ মিনিট। জহির গাবতলী থেকে রওনা দিলে খুব দ্রুতই চলে আসবে। মাজার রোডের পাশ দিয়ে আশুলিয়ায় আসার এখন সুন্দর রাস্তা হয়েছে। আপাতত জ্যামের বালাই নেই। আমি চৈতির রুমে গিয়ে দেখি, চৈতি কার সাথে যেন বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। আমাকে দেখে মোবাইল নামিয়ে বলল, ভাইয়া, আর কতক্ষণ?
    আমরা ঠিক বিশ মিনিটের মধ্যে এখান থেকে থেকে বের হয়ে যাব। ওকে?
    ওকে ভাইয়া। আম্মুর মাথাটা একটু ব্যথা করছে তো। তাড়াতাড়ি যেতে পারলে ভালো হতো।
    মাত্র বিশ মিনিট, কেমন?
    ওকে।
    লাইট, ট্রলি, জিবআর্মের ক্রুরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তারা মারামারি করতে প্রস্তুত। আমাকে বারবার সাহস দিচ্ছে সবাই। রাকিব আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, কী খবর, দোস্ত?
    কোনো চিন্তা করিস না, আর মাত্র বিশ মিনিট পরই আমরা এখান থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাব। একদম চিন্তা করিস না। আমাদের কিচ্ছু হবে না।
    রাকিব আমার কানের কাছে এসে মুখ নিয়ে বলল, কাউকে খবর দিছস, কেউ আইতাছে?
    হুম, মেশিন-টেশিন নিয়া আরেক মন্ত্রীর পোলা আসতেছে। চিন্তা করিস না।
    কস কী, ক্যামনে কী?
    আস্তে, কথা কইস না। কাউরে চিন্তা করতে না কর। আমাদের কারও কিচ্ছু হবে না।
    আচ্ছা, ঠিক আছে।



    আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরদের গিয়ে বললাম সব। সবাই যেন একটু স্বস্তি পেল। এই অবস্থায়ও যে টিমের সবার আমার ওপর ভরসা আছে, সেটাই অনেক।
    আচমকা অনেকগুলো গাড়ির হর্ন বাজা শুরু করল রাস্তায়। বেশ কতগুলো লোক দুমদাম করে ঢুকে পড়ল আমাদের বাড়িতে। আমি দেখতে পেলাম, অনেকের হাতেই সেই মেশিন। পরিস্থিতি খারাপ হলে হয়তো দুয়েকটি লাশও পড়বে। কিন্তু আমি এখান থেকে আমার ইউনিট সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় নিয়ে যেতে চাই। আমি একধরনের নিরুপায়। লাশ পড়লে আমার কিছু করার নেই। আমি টিপুর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে কয়েকজন সশস্ত্র লোক এসে ঘিরে ফেলল টিপু যে রুমে সোফায় শুয়ে ছিল, সেই রুমটা।


    হন্তদন্ত হয়ে সেই রুমে ঢুকল ছদরুল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ওদের সব কথা শুনতে পাচ্ছি।
    ভাইজান, অমুক মন্ত্রী আইছে। রাস্তায় খাড়াইয়া রইছে। আপনের লগে কথা কইবো। একটু চলেন।
    কস কী? এত রাইতে কী চায়?
    কী চায় জানি না বস, তবে খুবই আর্জেন।
    আচ্ছা চল। নায়িকার খবর কী?
    পাঁচ মিনিট আগে ডাইরেক্টর জানাইল আর মাত্র বিশ মিনিট পরে নায়িকা আপনের রুমে আইবো।
    ওই খানকির পোলা তো আরও কয়েকবার টাইম নিল।
    বলতে বলতে টিপু বের হতে লাগল রুম থেকে। দরজার সামনে বেরিয়ে একটা আড়মোড়া ভেঙে লম্বা হাই তুলতে গেল। অমনি টিপুর হাঁ হওয়া মুখে কেউ একজন এসে বেশ বড়সড় একটা পিস্তল ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, খানকির পোলা, একটু আওয়াজ দিবি তো ঘিলু বাইর কইরা দিমু। চল মাদারচোদ।
    ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। বেশ চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে গেল চারদিকে। কেউ ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করছে। আচমকা পরপর তিনটি গুলির শব্দ হলো। হঠাৎ কোত্থেকে যেন জহির আমার কাছে দৌড়ে এসে বলল, আপনের নায়িকা কই, ছোট আব্বা? তারে নিয়া আপনি বাইর হইয়া যান। বাইরে একটা মেরুন প্রাইভেট কার আছে। আপনি সেখানে গিয়ে বসেন। আমি আসতেছি।
    আমি চৈতির রুমে গিয়ে দেখি চৈতি আর তার মা ভয়ে জড়সড় হয়ে রুমের এক কোণে বসে আছে। আমাকে দেখে চৈতির মা বলল, কী হয়েছে বাবা, ডাকাত আসছে নাকি?
    না আন্টি, কিছুই না। আমার সাথে আপনারা দুজন চলেন, যেতে যেতে গাড়িতে সব বলব।





    ওরা আর কথা না বাড়িয়ে আমার সাথে বের হলো। রুমের দরজায় গিয়ে দেখি দুজন সশস্ত্র লোক আমাদের নেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে। বাইরে প্রচণ্ড হাঁকডাক, চিল্লাপাল্লা, খিস্তি, গালাগালি। কে কার সাথে করছে, আমি জানি না। আমি গিয়ে জহিরের নির্দেশনামতো মেরুন গাড়িতে বসলাম। সাথে সাথে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। আমি চমকে গিয়ে বললাম, এই, থামান থামান, আমার টিমের বাকি সবাই কোথায়? ওদের না নিয়ে আমি কোত্থাও যাব না।
    স্যার, সবাইরে নিয়াই যামু। আপনে চিন্তা কইরেন না। জহির ভাই আপনারে নিয়া একটু ফারাকে গিয়া খাড়াইতে কইছে।
    আমরা মিনিট দশেক গাড়ি চালিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় গেলাম। গাড়িতে কেউ কোনো কথা বলছে না। আমি গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। চৈতির মা হায় হায় করে উঠল।
    তুমি বাইরে যাইয়ো না, বাবা।
    ড্রাইভার সাহস দিয়ে বলল, ভয় পাইয়েন না, খালা, এখানে আজরাইল আইতে হইলেও জহির ভাইয়ের অনুমতি নিয়া আইতে হইব।


    আমার সিগারেট অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই দেখতে পেলাম আমাদের পিকআপ আসছে। ড্রাইভার বলল, কাম মনে হয় শেষ। সবাই চইলা আইছে।
    একটি গাড়ি থেকে জহির নেমে এল। তার হতে একটা অদ্ভুত অস্ত্র। আমি আগে কখনো দেখিনি, এমনকি সিনেমাতেও না। জহির এসে আমাকে বলল, ছোট আব্বা, আপনার সব লোক, ক্যামেরা, জিনিসপত্র সব নিরাপদে আসছে। আপনাগো গাড়িতে সবাই নিরাপদে আছে। বলতে বলতে জহির আমাদের গাড়ির সামনের সিটে উঠে বসেই বলল, সোজা মোহাম্মাদপুর আমার বাসায়। পুরা একশোতে টানবি, বাদল।
    গাড়ি ছুটে চলছে মহাসড়ক দিয়ে। আমরা নিরাপদ।
    চারজনেরে গুলি করছি
    বলো কী জহির, মারা গেছে?
    আরে নাহ্। মানুষ মারা কি এত্ত ইজি? আর আমি তো মারার জন্য গুলি করি নাই। তবে দরকার হইলে করতাম।
    চৈতির মা বলল, কী হয়েছিল আসলে?
    আমি লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে সব খুলে বললাম। সব শুনে চৈতির মা হো হো করে হেসে উঠল।
    হাসছেন কেন?
    আরে, হাসব না? এই সামান্য বিষয় নিয়া এত্ত কিছু করার দরকার আছে? তুমি চৈতিকে বলতা....

    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে)

    No comments