Header Ads

CODESMITE
  • সাম্প্রতিক লেখা:

    ছোবল ।। ঢাউসগল্প

    শেফালীর সাথে আমার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। হবে না যে সেটা আমিও জানতাম। যখন প্রেমে পড়েছিলাম, তখনই জানতাম। শেফালীর সাথে আমার প্রেম হয় যখন আমি ওদের বাড়িতে লজিং মাস্টার ছিলাম। সে কি আজকের কথা! যখন আমি আইএ পড়ি, তখনকার কথা। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা চলার সময় যখন আব্বা মারা গেল, তখনই আমাকে শেফালীর বাবা ছোমেদ কন্ট্রাক্টর নিজের বাড়িতে নিয়ে গিলে বলল, আইজ থাইক্যা তুই এইহানে থাকবি। লেহাপড়ার খরচ যা লাগবে, সব আমার। তুই খালি শেফালীরে নিজের বুইনের মতো কইরা মানুষ করবি।


    শেফালীর মতো অত সুন্দরী মেয়েকে বোনের দৃষ্টিতে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এলাকার সব ছেলের কামনার মেয়ে ছিল শেফালী। গোলগাল চেহারায় শেফালীর গভীর কালো চোখে কী যেন খুঁজে পায় ছেলেরা। শেফালী চেহারা-সুরতে যেমন দশগ্রামের সেরা ছিল, ঠিক তেমনি লেখাপড়া আর বোধ-বুদ্ধিতে ছিল দশগ্রামের নিকৃষ্টতম। কোন ক্লাসে যে কয়বার পড়েছে, তা নিজেই বলতে পারে না। পড়ালেখার কোনো বিষয়ই তার মাথায় ঢোকে না। এমন নয় যে শেফালী লেখাপড়ায় খারাপ, কিন্তু অন্য একটা বিষয়ে বেশ ভালো। তা মোটেই নয়। আমার ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ল সেই গবেটকে খানিকটা মানুষ করবার। বিনিময়ে আমি শেফালীদের কাচারিঘরে শোয়ার জায়গা পেয়েছি। তিন বেলা ভাত পাই, বিকেলে নাড়–-মুড়ি, চা-ও পাই কোনো কোনো দিন। বিড়ি-সিগারেট কোনো কিছুর অভ্যাস আমার কোনোকালেই ছিল না বলে হাতখরচা বাবদ আমার কোনো টাকাপয়সা না লাগলেও ম্যানেজার শফিক একটা রসিদে সাইন নিয়ে দুটি এক হাজার টাকার ফরসা নোট দেয় মাসের ১ তারিখেই। কিন্তু আমার সবকিছুতেই লজ্জা লাগে। খেতে লজ্জা লাগে, ওদের দেওয়া কাপড় পরতে লজ্জা লাগে, মাসে মাসে দেওয়া টাকা নিতেও ভীষণ লজ্জা লাগে। মায়ের হাঁপানির টান অত না থাকলে হয়তো টাকা দুই হাজার আমি নিতাম না। এত লজ্জার কারণ ওই শেফালী।


    Artist: Prashanta Nayak





    শেফালী যখন ক্লাস এইটে পড়ে, তখন থেকে ওর ম্যাট্রিক পরীক্ষা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আমি আইএ পাস করেছি, অনার্স পাস করেছি। কিন্তু শেফালী আর ম্যাট্রিক পাস করতে পারল না। সে প্রথম দিনও হরকে বলত লব আর জোড় সংখ্যা বিজোড় সংখ্যা চিনত না, আজও চেনে না। কিন্তু আমি তাকে চেনাতে চেষ্টা করেছি। ভীষণ বোকা আর সহজ-সরল মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলি একসময়। টের পাই, মনে মনে অনেক কিছু সাজাচ্ছি এই বোকা মেয়েটাকে নিয়ে। কিন্তু ভুলেও ওর কাছে প্রকাশ করি না। কারণ, ও বোকা মেয়ে। কোনোভাবে বাবাকে জানালে আমার সবকিছু হারাতে হবে। এই আশ্রয়টুকু হারালে মাকে নিয়ে আমাকে সত্যি গাছতলায় থাকতে হবে। কারণ, শুধু ঘরের যে জমিটুকু ছিল আমাদের, তা-ও শেফালীর বাবার কাছে বন্ধক রেখে নব্বই হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে। আর সে খবর আমি অল্প কিছুদিন হলো শুনেছি। মায়ের মৃত্যুর আগে যদি টাকা দিতে পারি, তাহলে আমি হয়তো জমি ছাড়িয়ে দলিল নিতে পারব, না হলে আর পারব না। কাগজপত্রে ওই ভিটাটুকুর মালিক নাকি ছোমেদ কন্ট্রাক্টর। মায়ের কোথাও থাকার জায়গা নেই বলে মরার আগপর্যন্ত মা ওই বাড়িতে থাকতে পারবে। অর্থাৎ আসলে আমরা মা-ছেলে দুজনেই ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের দয়ায় বেঁচে আছি।





    কিন্তু প্রেম আর আগুন এই দুই তো চাপা দিয়ে রাখার নয়। যতই বোকা হোক, রক্ত-মাংসে গড়া শেফালী নিজেও আমার ব্যাকুলতা টের পেল। সাড়া দিতে দেরি করল না। কিন্তু তখনই আমার মনের কোথায় যেন কেউ একটা জং ধরা পেরেক দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলেছিল, শেফালী তোমার নয়। সেই জং ধরা খোঁচা থেকে ধনুষ্টঙ্কার হলো, ক্যানসার হলো, আমার প্রেমের মৃত্যু হলো। আমার অনার্সের ফল দেখে শেফালীকে নিয়ে দেখা স্বপ্নটা আরও গাঢ় হয়েছিল। হাঁটু পর্যন্ত কাদা ভেঙে উপজেলার কলেজ থেকে আসতে ফিতে মাপা চৌদ্দ মাইল। সেই চৌদ্দ মাইল সেশন জটের ফলে আটাশ মাইল হওয়ায় আমার সরকারি চাকরির বয়স পালাই পালাই করছিল। তার পরও যখন সমাজবিজ্ঞানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেলাম, সবাই বলছিল, সরকারি চাকরি না হোক, এনজিওর মোটা বেতনের চাকরি ঠিকই মিলবে। ঠিকই মিলল, তবে হাজার লোকের প্রাণ যাওয়ার পর।




    ঘটনাটা খুলে বলি। ২০০৭ সালে সিডর হওয়ার পর আমাদের এলাকায় বেশ কয়েকটি নামকরা আন্তর্জাতিক মানের এনজিওর প্রবেশ ঘটে। আমার প্রভু ছোমেদ কন্ট্রাক্টর মাতুব্বর গোছের লোক হওয়ায় জানতে পারে, সুইডেনভিত্তিক এনজিও ‘হ্যান্ড ফর ম্যান’ নামক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এনজিওতে মোটামুটি ‘ইয়েস, নো, ভেরিগুডের’ চেয়ে একটু ভালো ইংরেজি জানা কাউকে চায়। কিন্তু তারা তিন দিন যাবৎ হারিকেন ধরে খুঁজেও কাউকে পায়নি। আমার প্রভু খবরটা আমাকে দেওয়ার সাথে সাথে আমি কাঁসার থালায় আগুন দিয়ে একমাত্র শার্ট আর একমাত্র প্যান্ট ইস্তিরি করে সেভ করতে গিয়ে নাকের বারান্দা কেটে ফেললাম। তখন বাজারে রাবারের কিছু বার্মিজ জুতা পাওয়া যেত, যা একটু দূর থেকে দেখলে ভালো চামড়ার শু মনে হতো। সেই শু এক জোড়া কিনেছিলাম ১২০ টাকা দিয়ে। তিন জায়গা দিয়ে ছাল উঠে যাওয়া বেল্ট পরে যখন আমি সেই অফিসে হাজির হলাম, তখন আমাকে দেখেই এক বড় বুকের টি-শার্ট গায়ে দেওয়া মেয়ে বলে উঠল,He Looks Like a Joker. আমার অসম্মানিত বোধ করলে চলবে না। কারণ, আমার জমির দলিল ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের কাছে। অফিসের সবাই সাদা চামড়ার লোক। যে একজন আমার দেশি, সে ইশারা-ইঙ্গিত ছাড়া তাদের কথা কিছুই বোঝে না। আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করেই তারা বুঝতে পারল, আমাকে দিয়ে তাদের দিব্যি চলে যাবে। তৎক্ষণাৎ আমার সেখানে চাকরি হয়ে গেল রোজ দশ ইউএস ডলার হিসেবে। আমি খুব কষ্ট করে নিজের উত্তেজনা চেপে রাখলাম। ডেইলি দশ ডলার মানে সাত শ টাকা। মানে মাসের ত্রিশ গুণ সাত শ। একুশ হাজার টাকা। আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। স্বপ্ন না বাস্তব, বিশ্বাস করতেই আমার বেশ কিছু সময় কেটে গেল। আমি যাওয়ার সময় আমার সার্টিফিকেট, কাগজপাতি নিয়ে গিয়েছিলাম। সব দেখে তারা অনেক খুশি হয়েছে বুঝতে পারলাম। আমাকে তারা নিয়োগের কোনো কাগজপত্র না দিলেও পাঁচ দিনের অগ্রিম পঞ্চাশ ডলারের সমান তিন হাজার পাঁচ শ টাকা দিয়ে একটা সবুজ রঙের কাগজে সাইন নিল, যার ওপরে একটু মোটা করে লেখা- পেমেন্ট ভাউচার। মেয়েটা হাতে টাকা দিতে দিতে বলল, তুমি যে বডি স্প্রেটা ইউজ করছ সেটা মেয়েদের। কাল থেকে ভালো বডি স্প্রে দিয়ে আসবে।




    সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমার মনে হলো, এখানে হাসলেই ইজ্জত বাঁচবে। তাই বহু কষ্টে দাঁত বের করে গলা দিয়ে হে হে জাতীয় শব্দ বের করলাম। মেয়েটি আরও বলল, অবশ্যই দুই সেট ভালো জামাকাপড় আর এক জোড়া ওয়াকিং কেডস কিনবে। যে জুতোটা পরেছ, তা আসলে সুইপারদের শু। 

    এ কথায় কেউ হাসল না। তবে ছোট চুলওয়ালা বুড়ো দেখতে লোকটা বলল, ওর কথায় কষ্ট পেয়ো না। ও আমাদের টিমের সবচেয়ে জলি মেম্বার। যাকে ওর পছন্দ হয়, তার সাথে ও এভাবেই কথা বলে। 
    টাকা দেওয়ার সময় মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, Lily Hopkins. . আমি কী করব, বুঝে উঠতে পারলাম না। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুয়েকজন নিজেদের মায়ের ভাষায় কী যেন বলে হেসে উঠল। আমি কী মনে করে মেয়েটার হাত ধরে বললাম, I am Ruhul Amin..
    বিদায় নেওয়ার আগে শুনলাম পেছন থেকে আমাকে বলল, কাল দেখা হবে মি. রাহুল। 



    বিদেশিদের মুখে নিজের নাম মি. রাহুল শুনে খুব ভালো লাগল আমার। আমি তাদের অস্থায়ী অফিস থেকে বের হয়ে যাত্রীটানা ভ্যানে চড়ে উপজেলা সদরের বাজারে গিয়ে পুরো তিন হাজার টাকা খরচ করে দুইটা শার্ট, দুইটা প্যান্ট আর এক জোড়া বাটা কোম্পানির শু কিনলাম। পরদিন অফিসে গেলে সবাই আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। লিলি মেয়েটা বারবার বলছে, আমাকে কোনো এক ইন্ডিয়ান হিরোর মতো লাগছে। কিন্তু নামটা মনে করতে পারছে না। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বুঝতে পারলাম কাজের চাপ কাহাকে বলে। ওরা যেমন কেউ বাংলা জানে না, তেমনি দুর্গতরাও কেউ ইংলিশ জানে না। কেনাকাটা থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ এবং কাজের মধ্যস্থতা আমাকেই করতে হয়। ফলে এলাকার অনেক গণ্যমান্য সরকারি-বেসরকারি লোকজনের সাথে আমার ওঠা-বসা, আলাপ শুরু হলো। সবাই আগের চেয়ে আমাকে গুরুত্ব দেওয়া শুরু করল। এই এনজিওটির কাজ দুর্গতদের পুনর্বাসন করা। ঘর নির্মাণ থেকে সাময়িক আয়ের ব্যবস্থা পর্যন্ত সব এই এনজিও করছে। আর চেয়ারম্যান, মেম্বার, টিএনওর সাথে যোগাযোগ করে দুর্গতদের তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে সব কাজ আমাকে করতে হয়। উদয়াস্ত কাজ করলেও ফুরায় না। তবে কাজের প্রতি আমারও ভীষণ ভালো লাগা শুরু হলো। সিডরের রাতে মাকে যে ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের বাড়ি এনে উঠিয়েছি, সিডরের পরের দিন ঘরের অস্তিত্বও আর খুঁজে না পাওয়ায় মা এখনো ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের বাড়িতেই আছে। কয়েক দিন আগে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রেখেছে। পাশে আধা পাকা হারুন চাচার ঘরে জিজ্ঞেস করায় তারা জানাল, ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের লোকেরাই নাকি বেড়া দিয়েছে। বুঝতে পারলাম, আবু ইসহাকের জোঁক আমাকে চুষে পুরোটাই খেয়ে নিয়েছে। নিজের নতুন ঘর না হলে মাকে আর ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের বাড়ি থেকে নামানোর উপায় নেই।




    ঠিক এক সপ্তাহ পর তারা আমাকে দশ ডলার করে সপ্তাহে পাঁচ দিনের বেতন আর শুক্র-শনি দুই দিন ওভার টাইম করার জন্য বিশ ডলার করে চল্লিশ ডলার, অর্থাৎ মোট নব্বই ডলারের সমপরিমাণ টাকা দিয়ে বলল, আমাদের সাথে তোমার ডেইলি চুক্তির কাজ শেষ। আমরা আর তোমার সাথে ডেইলি চুক্তিতে কাজ করব না। 

    আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। মুহূর্তেই চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলাম। তাহলে? এখন কী হবে? কী অন্যায় করেছি আমি? হাসিখুশি টমাস বলল, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমাকে আমরা মাস চুক্তিতে নেব আগামী ছয় মাসের জন্য। মাসে তোমাকে আমরা বেতন দিতে পারব নয় শ ডলার। এটা আমাদের জোনাল ম্যানেজারদের বেতন স্কেল। তোমাকে আমরা এখানকার জোনাল ম্যানেজারের পদে চাকরির অফার করছি। তুমি রাজি?
    আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার গলা ব্যথা করছে। ঝরঝর করে পানি পড়ছে দুচোখ দিয়ে। মনে হলো আমি কথা বললেই হাউমাউ করে কান্না চলে আসবে। সুখের কান্না। রাতে ওদের ডাকবাংলোয় আমাকে ডিনারের দাওয়াত দিল। আমাকে ওরা ওদের প্যাডে ছাপানো একটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে দুটো কপির একটা আমাকে দিয়ে দিল, একটা ওরা রেখে দিয়ে আমাকে একটু আগে আগে ছেড়ে দিয়ে বলল, যাও, বাড়ির জন্য কিছু কেনাকাটা করে নিয়ে যাও।



    আমি বাজারে গিয়ে সাধ্যমতো সবার জন্য কেনাকাটা করলাম। এমনকি ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের জন্য পাজামা আর পাঞ্জাবির কাপড় নিলাম। শেফালীর জন্য নিলাম একটা লাল রঙের শাড়ি আর বড় তিনটা শাপলা ফুল। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতেই চলে গেল অনেকগুলো টাকা। তার পরও এক জোড়া জুতা, একটা শাড়ি আর থুতু-কফ ফেলার জন্য একটা চিলমচি কিনে বাড়ি ফিরে শুনি ছোমেদ কন্ট্রাক্টর ব্যবসার কাজে ঢাকায় গেছে। রাতে খেয়েদেয়ে অফিসের কয়েকটা ফাইল নিয়ে বসেছি, এমন সময় আকাশ ডাক দিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো।

    আমি কাচারিঘরেই থাকি, তবে থাকার সুযোগ-সুবিধা নিজের পয়সায় বাড়িয়ে নিয়েছি। ঘণ্টাখানেক পর দেখলাম আমার মোবাইলে ফোন এসেছে। ধরতে ধরতে ফোনটা কেটে গেল। বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে। হঠাৎ কাছাকাছি একটা বাজ পড়তেই বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি মোবাইল খুঁজতে যাব, তখনই আবার ফোন। শেফালীর ফোন। বাইরে বৃষ্টির শব্দ এত বেশি যে মোবাইলের কথা শুনতে পারব কি না, সন্দেহ। তার পরও ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম শেফালী বলছে, আমার ভীষণ ভয় করছে। তুমি আসো। না হলে আমি মরে যাব। 
    বোকা মেয়েটার অনেক ভয়। সবকিছুতেই ভয় পায়। বাইরে প্রচণ্ড বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু এই রাতে অত সুন্দরী প্রেমিকার ভয় দূর করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না, বুঝতে না বুঝতে আবার ফোন। এটা একটা কৌশল হওয়া স্বাভাবিক। মা ওদের বাড়িতে থাকে। আজ ওর বাবা বাড়িতে থাকবে না, সে জন্য মাকে ডেকে নিলেই তো পারত। যাব বলে সিদ্ধান্ত নিতেই শরীরটা কেমন যেন করে উঠল।



    ঘরের চৌকাঠ পার হওয়ার আগে আরেকবার ভাবলাম। শেষে যা আছে কপালে ভেবে ওর ঘরের দরজায় হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। এরপর আমি যা দেখলাম, তা দেখার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না ঠিকই, তবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দৃশ্য ছিল ওইটি। সারা ঘরে অনেকগুলো মোমবাতি জ্বলছে। খাটে নতুন বিছানার চাদর আর বালিশের কভার। তার ওপরে আজকের কেনা শাড়িটা পরে সেজেগুজে বউয়ের মতো বসে আছে শেফালী। আমি কী বলব বা করব, বুঝে উঠতে পারলাম না। শেফালী এমন করে কেন সেজেছে, আমি বুঝতে পারছি না। ও কি আশা করছে বিয়ে ছাড়া আমরা আজ রাতে বাসর কাটাই? সেটা কি ঠিক হবে? কিন্তু আমার কি শক্তি আছে যার আরাধনা করছি, এই রাতে তার আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়ার? বা দেওয়াটা কি উচিত হবে? আমি আরও কিছু ভাববার আগে শেফালী খাট থেকে নেমে এসে আমাকে নতুন বউয়ের মতো সালাম করল। আমি সত্যিই অবাক হলাম। আমার বোকা প্রেমিকাটা এত দূর বোঝে? রাঙা মুখটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঘোমটা সরিয়ে বললাম, নিজেরা নিজেরা বাসর করলেই কি সব হয়ে যাবে?

    আমি জানি না। আমি তো তোমারেই চাই। হুজুর ডাইকা কালিমা পড়ার কী আছে? তুমি-আমি দুজনেই তো কালিমা জানি।



    নিজেরা কালিমা পড়ে নিজেরাই বিয়ে সেরে স্বামী-স্ত্রীর মতোই বাসর কাটিয়ে আমি ফজরের কিছু আগে গোসল করে নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। মনে হলো আজ নিজেকে আবিষ্কার করতে পেরেছি। মানুষ হয়ে জন্মানোটা খারাপ হয়নি। সামনে অনেক আনন্দময় জীবন রয়েছে আমার। এই বোকা পাগলিকে নিয়েই বাকি জীবন পার করে দিতে চাই আমি। কিন্তু ছোমেদ কন্ট্রাক্টর কি তার মেয়েকে দেবে আমার মতো গৃহহীনের হাতে? হ্যাঁ, এই খোঁচাটাই আমার কলিজায় বরাবর মেরে আসছিল। পরক্ষণেই নিজেকে নিজে বললাম, ভালোবাসলে এত চিন্তার টাইম কই? যা হওয়ার হবে।




    কিন্তু তাই বলে এমনটা হবে ভাবিনি কখনো। তিন মাস পর আমি এক লাখ টাকা দিয়ে চার কাঠা জমি কিনলাম। আমাদের জমিটা থেকে খানিক দূরেই। সে জমি বরং আমাদের দখলকৃত জমির চেয়ে শতগুণ ভালো। চার কাঠা জমি আমাদের মা-ছেলের জন্য যথেষ্ট। আমি সন্ধ্যার দিকে জমি রেজিস্ট্রি করে ফিরে বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছে। মা এ রকম দাঁড়িয়ে থাকে মাঝেমধ্যে। কিন্তু আজ মাকে দেখে মনে হলো মা একটু উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত। মায়ের কি হাঁপানির টান বেড়েছে?

    কী হয়েছে, মা, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
    এখানে দাঁড়িয়ে থাকব না তো কী করব? বাড়িতে কি আর যাওয়ার জো আছে?
    কেন মা, কী হয়েছে?
    কী হবে আবার? আমার কপাল। এই বুড়া বয়সে আমার মরার সময় গাছতলায় শুয়ে মরতে হবে।
    কী বলছ, মা? কী হয়েছে? আমাকে খুলে বলো।
    মা আমাকে তার রুমে ঢুকিয়ে ফিসফিস করে বলল, শেফালীর তো দুই মাস চলে...। 
    আমার মাথায় বাজ পড়েনি ঠিকই, তবে বাজ পড়লে মনে হয় এর চেয়ে ভালো হতো। আমি কী করব, কী বলব, বুঝে উঠতে পারছি না। এসএসসি ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র পরীক্ষার আগের রাতে আব্বা মারা যাওয়ার পরও এতটা অসহায় লাগেনি।
    খালু কিছু শুনছে?
    হেই তো আমারে ডাইকা নিয়া উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া ধুইলো। ঘরে আসার সাথে সাথে তোরে দেহা করতে কইছে।
    এবার মনে হলো সত্যি সত্যি আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল।
    বিশাল সহায়-সম্পত্তির মালিক ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের মেয়েকে আমি বিয়ে না করে মা বানিয়ে দিয়েছি। এর শাস্তি হিসেবে ছোমেদ কন্ট্রাক্টর আমাকে যা খুশি তা-ই করতে পারে। তার ওপর আমি আর আমার মা তার আশ্রিত। আমি পকেটে হাত দিয়ে দলিলটা বের করে মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, মোজাম্মেল চাচার চার কাঠা জমি কিনে নিয়েছি। এই দলিল।
    মা যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। আমি মাকে সান্ত্বÍনা দিয়ে বললাম, চিন্তা কোরো না, মা। এখন আর আমাদের আগের দুরবস্থা নাই। আমি অনেক টাকা বেতন পাই। আইজ জমি রেজিস্ট্রি করলাম। আমি কি শেফালীর পাত্র হিসেবে অযোগ্য?
    আমি তোর মা। আমি তো চাইব আমার ছেলে লুলা-খোঁড়া হলেও সে রাজকন্যা বিয়া করুক। কিন্তু শেফালীর বাবা কী কয়, সেইডা আসল বিষয়।
    কী কয়?
    তুই যা। গিয়া নিজে শোন। যা হবার হইছে। মাথা ঠান্ডা রাখবি। কোনোভাবেই মাথা গরম করবি না, আমারে কথা দে?
    মায়ের মাথায় হাত গিয়ে কথা দিতে হলো আমি রাগ করব না, মাথা গরম করব না।
    আমি মাথা গরম করলেই কি, ঠান্ডা রাখলেই কি। ছোমেদ কন্ট্রাক্টর ৩০০ ডিগ্রি তেতে বসে আছে কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ারে মুখ কাঠ করে। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই বলল, নেমক হারামের বাচ্চা নেমক হারাম, আমার খাইয়া, আমার পাখনার তলায় থাইকা তুই আমার গলায়ই ছুরি চালাইলি? ক্যামনে?
    খালু, আপনি মাথা গরম কইরেন না।
    চোপ খানকির পোলা। কেডা তোর খালু? আমি তোর কোন জন্মের খালু? আমি কি তোর খালারে চুদি, না তোর মায়রে চুদি, শুয়রের বাচ্চা? তুই ক্যামনে আমার বিশ্বাসের ঘরে আগুন দিলি, ওই হারামির বাচ্চা?
    এ রকম আচরণ আমি ছোমেদ কন্ট্রাক্টরকে অনেকের সাথে করতে দেখেছি। আমার সাথে এমনটা হবে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। খারাপ হলে ছোমেদ কন্ট্রাক্টর যে কত খারাপ হতে পারে, তার নমুনা আমি কিছু দেখেছি, কিছু শুনেছি। নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে সে। আমাকে আমার তল্পিতল্পাসহ চিরদিনের জন্য গায়েব করে দেওয়া তার তুড়ির অপেক্ষা মাত্র।
    তোরে আমি আশ্রয় দিছি, লেহাপড়া করাইছি, অহন তোর মায়রে পুষতাছি আর তুই কালসাপ হইয়া আমার বুকে ছোবল মারলি, শুয়রের বাচ্চা।
    আমি শেফালীরে বিয়া করমু।
    এ কথা বলার সাথে সাথে ছোমেদ কন্ট্রাক্টর চেয়ার থেকে উঠে আমার বুক বরাবর একটা লাথি মারল। আমি ছিটকে গিয়ে আলমারির সাথে বাড়ি খেলাম।
    ফহিন্নির বাচ্চার শখ কত, ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের মাইয়ারে বিয়া করবে। হারামির বাচ্চা, তুই কী খাওয়াবি? কই রাখবি মোর মাইয়ারে? আমার গরুর আতালের হোমাইন্যা জমি আছে তোর, ফহিন্নির পুত।
    কোথায় লেগেছে জানি না। টের পেলাম, মাথার পেছনে জ্বালা করছে আর রক্ত চটচট করছে। রাগে ফুঁসছে ছোমেদ কন্ট্রাক্টর।




    বিদেশি এনজিওর দুইটা পয়সা পকেটে ঢুকছে দেইখা নিজেরে রাজা ভাবতাছস, ফহিন্নির পুত? ভুইলা গেছস তোর বাপ হারা জীবন আমার গোলামি করছে। আর তুই গোলামের পুত গোলাম, আমার মাইয়া বিয়া করতে চাস? বলেই ছোমেদ কন্ট্রাক্টর তার পায়ের জুতা খুলে আমার মাথার চুল শরীরের সব শক্তি দিয়ে মুঠি করে ধরে জুতার পিঠে থুতু লাগিয়ে চটাস চটাস বাড়ি মারতে লাগল। আমি প্রতিটা বাড়িতে চোখে লাল-নীল জোনাক দেখতে থাকলাম। আমার নাক ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল।




    কিরে বেশ্যার বাচ্চা, আমার মাইয়ারে বিয়া করবি না, কালসাপের বাচ্চা? তোর মতো কুত্তারে আমার ঘরে আশ্রয় দেওয়াই ভুল হইছে। আমার মনে রাখা উচিত ছিল, কুত্তা যেই পাতে খায়, সেই পাতেই আবার হাগে। তুই আইজ, এই মুহূর্তে আমার বাড়ি ছাইড়া যাবি। তোর মায়রে লইয়া যাইয়া রাস্তায় ঘুমা। তোরে আমি ছোমেদ কন্ট্রাক্টর টুকরা টুকরা কইরা দক্ষিণের ঘেরে মাছেরে খাওয়াইয়া দিতে পারতাম। কিন্তু সামনে নির্বাচন করুম বইলা তুই বাঁইচা গেলি। যা, ভাগ, বেইমানের বাচ্চা বেইমান।




    আমি উঠে বেরিয়ে আসার সময় শেষ আঘাত হিসেবে ছোমেদ কন্ট্রাক্টর আমার পিঠে আরেকটা লাথি মারল সর্বশক্তি দিয়ে। আমি চৌকাঠের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়তে দেখি মুখ রক্তে ভরে গেছে। জিবে ঠেকল সামনের দুটি দাঁত। আমি ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের ঘর থেকে বের হয়ে এসে দেখি মা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সব দেখেছে, সব শুনেছে। আমার মাথা-নাক-মুখ-ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরছে। কিন্তু চোখ দিয়ে একফোঁটা পানিও পড়ছে না। আমি মায়ের হাত থেকে দলিলটা নিয়ে হাত ধরে বললাম, চলো।




    ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের বাড়ির সীমানা পেরোতে না পেরোতেই আকাশ ভেঙে চারদিক থেকে ভীষণ বেগে বৃষ্টি শুরু হলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দলিলটা হাওয়াই মিঠাইর মতো উবে গেল। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মা-ছেলে মিলে হাজির হলাম আমার অফিসের লোকজনের ডাকবাংলোয়। সেখানে আমি আর মা ছাড়া কোনো বাঙালি নেই। নিজের জীবন আর ইজ্জত বাঁচানোর জন্য আমি মিথ্যা এক গল্প ফাঁদলাম।




    ওরা জানে না আমি কোথায় থাকি। বললাম ঘর ভেঙে গেছে একটু আগের ঝড়ে। আমার আহত অবস্থা দেখে আঁতকে উঠল সবাই। কার্ড খেলা আর স্কচ পান রেখে সবাই আমার আর মায়ের সেবায় লেগে গেল। আমি সেই রাতে জানতে পারলাম লিলি আসলে ডাক্তার। ইন্টার্ন শেষ করে ছয় মাসের ছুটিতে চুক্তিভিত্তিক কাজে ঢুকেছে এই এনজিওতে।




    ঝড়ে আমাদের ঘর ভেঙে গেছে শুনে কালকেই আমাদের জন্য ঘর বানাবে, বলল অ্যালেক্স নামের ৫০-৫৫ বছরের আমাদের টিমলিডার। যেহেতু আমি সিডরে আক্রান্ত, সেহেতু আমি অন্য সবার মতোই সহায়তা পেতে পারি।

    আমার মাথায় অনেক চিন্তা খেলা করছে। শেফালী? শেফালীর কী অবস্থা? আমাকে এই পরিমাণ মেরেছে, নিশ্চয়ই শেফালীকেও ছেড়ে দেয়নি। কী হবে শেফালীর পেটের বাচ্চাটির? শেফালীকে কি জোর করে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেবে? আমি কী করতে পারি? ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের বাড়ি থেকে বের হয়ে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ওর মোবাইলে ফোন করেছি, বন্ধ।



    পরের দিন উপজেলা সদরে আমি আর মা একটা তিন রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলাম। দিন দশেক পরই খবর পেলাম, ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিম কন্ট্রাক্টরের ছেলের সাথে শেফালীর বিয়ে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও সে আকাশ সরানোর কোনো উপায় ছিল না। বিধবা মায়ের কথা, আমার সুন্দর ভবিষ্যতের কথা, সবশেষে শেফালীর হাসিটার জন্য আমি বিয়ে নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করলাম না। জনের কাছ থেকে এক বোতল স্কচ নিয়ে নতুন বাসার ছাদে বসে এক প্যাকেট সিগারেটের সাথে শেষ করতে করতে শেফালীর বিয়ের লাইট জ্বলা-নেভা দেখে পার করে দিলাম।




    সেদিনের বৃষ্টিতে ভেজায় মায়ের নিউমোনিয়া হয়ে গেল। আগের হাঁপানি আর নিউমোনিয়ার নতুন আক্রমণে মাকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হলো না। পৃথিবীতে আমার আপন বলতে সত্যিই আর কেউ রইল না। বড্ড একা হয়ে গেলাম। হঠাৎ মনে হলো, আমি এখন কারও নই, কেউ আমার নয়। মিষ্টি ভুলে শেফালীর পেটে আমার যে সন্তান এসেছিল, তা কুকুর-বিড়ালের খাবার হয়েছে নিশ্চয়ই।




    আমার আর তিন কূলে কেউ নেই জেনে আমার বিদেশি কলিগেরা আমার প্রতি আগের চেয়ে সদয় হলো। এমনিতেই ওরা প্রত্যেকেই অনেক ভালো মানুষ। আজ পর্যন্ত ওদের কারও সাথে আমার কোনো প্রকার ঝগড়া, কথা-কাটাকাটি হয়নি। কিন্তু সব হারিয়ে আমি একদম ভেঙে পড়লাম।

    শেফালী এখন দিব্যি তার স্বামীর সাথে সংসার করছে। ইদানীং শেফালীর স্বামী ছোমেদ কন্ট্রাক্টরের সব ব্যবসাপাতি দেখছে। ছোমেদ কন্ট্রাক্টর এখন আর আলাদা করে টেন্ডার দেয় না। 


    আমি আরও মাস ছয়েক এলাকায় থেকে ওই এনজিওর কাজে চলে গেলাম সুদান। চার বছর পর গত পনেরো দিন হলো ফিরেছি।

    আমার ফ্লাইটের তিন দিন আগে আমি ঢাকায় বসে খবর পেলাম কে বা কারা ছোমেদ কন্ট্রাক্টরকে কুপিয়ে খুন করেছে। শেফালীর জন্য আমার মনটা আবার কেঁদে উঠল।
    এত দিন ঢাকার সব কাজবাজ সেরেছি। আজ দীর্ঘ চার বছর পর গ্রামে এলাম মায়ের কবরটা আর শেফালীকে এক নজর দেখার জন্য।



    গ্রামে ঢুকে দেখলাম আমার সম্মান আগের চেয়েও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি দেখলাম আমার সেই চার কাঠা জমিতে মায়ের বাঁধানো কবরটা আগের মতোই আছে, তবে বুক পর্যন্ত ঘাস হয়ে গেছে। একজন লোক ঠিক করলাম ঘাসগুলো পরিষ্কার করানোর জন্য। সব কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে শেফালীর শ্বশুরবাড়িতে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমি যা দেখলাম, যা জানলাম, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। শেফালী তার শ্বশুরবাড়িতে থাকে না। স্বামী-সন্তান নিয়ে বাজারের কাছে একটা টিনশেড বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে। ওই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। তৃতীয়বার কড়া নাড়ার পর ভেতর থেকে যে দরজা খুলে দিল, সে আমার শেফালী নয়। বয়স চল্লিশের মতো দেখতে এক মহিলা, যার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে পুষ্টিহীনতার ছাপ, কপাল থেকে নাক পর্যন্ত একটা কাটা দাগ, যেখানে আনাড়ি সার্জনের হাতের কম করে হলেও দশটা সেলাই। গালভাঙা মহিলা সচরাচর দেখা না গেলেও সেদিন দেখেছিলাম। চোখ দুটো শুধু কোটরগতই নয়, নিচের কালির সমাহার বলে দেয়, নিদ্রাহীনতাও আছে। দরজা খুলে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল মহিলা। একসময় হিক্কা থামিয়ে কোনোমতে বলল, ক্যামন আছেন, স্যার?

    দীর্ঘদিন পর হলেও ডাকটা শুনে বুঝলাম, প্রকৃতির যে খেলার শিকারই হোক না কেন, এই আমার ভালোবাসা। একসময়ের স্বপ্ন, আমার প্রেমিকা, আমার ছাত্রী শেফালী। ও কেমন আছে, জিজ্ঞেস না করে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, তোমার এ অবস্থা কেন? 
    এর জবারে যা শুনলাম, তা ওর বর্তমান চেহারার চেয়েও ভয়ংকর।




    জীবনে অনেক ওলট-পালট হয়েছে শেফালীর। ওর শ্বশুর মারা যাওয়ার পর দুই পরিবারের কন্ট্রাক্টরি ব্যবসা শেফালীর স্বামী একা সামলাতে শুরু করে। বছরখানেক চালাচ্ছিলও বেশ দক্ষতার সাথে। দুইটা অফিস নিয়ে আরও কাজের লোকজন নিয়ে জাঁকিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল সাঈদ। শেফালীর মতে, হঠাৎ এক অজানা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে ওর স্বামী সাঈদ। সারাক্ষণ ওষুধ খেতে হয়। একেকটা ওষুধের দাম আড়াই শ থেকে পাঁচ শ টাকা পর্যন্ত। আবার বাজারে না পাওয়া গেলে দাম নাকি দ্বিগুণ-তিন গুণ বেড়ে যায়। একসময় এই ওষুধের পেছনে খরচ হতে শুরু করে লাখ লাখ টাকা। না খেতে পারলে পাগলামি শুরু হয়ে যায়। হাতের কাছে যা পায়, তা-ই ভাঙে। শেফালীকে মারধর করে। এই ওষুধ খেতে গিয়েই নাকি অনেক কিছু ধীরে ধীরে বেচতে শুরু করে। একসময় কনস্ট্রাকশনের যন্ত্রপাতি, মিকচার মেশিন পর্যন্ত বেচার দরকার হয় ওই ওষুধ কিনতে গিয়ে। টাকা খরচ হয়ে যাওয়ার ফলে অনেক কাজই বন্ধ হয়ে যায়, কেস খায় বেশ কয়েকটি। লোকে যে যা-ই বলুক, শেফালীর বিশ্বাস, তার সুখের সংসার যাদের সহ্য হয়নি, তারাই ওর স্বামীকে তাবিজ করেছে।

    আমি অনেক সময় পর জিজ্ঞেস করলাম, রোগটির নাম কি জানো?
    না।
    কী হয় তোমার জামাইয়ের? মানে কী সমস্যা হয়?
    আগে কানটান ব্যথা করত, শরীল কামড়াইত, পরে তো ওষুধ না খাইতে পেরে পাগলামি শুরু করল।
    এখনো ওষুধ না খেতে পারলে পাগলামি করে?
    করে মানে? মাইরধইর করে, ভাঙচুর করে।
    কোন ডাক্তার দেখাচ্ছ?
    আমি জানি না। তয় দেশ-বিদেশের অনেক ডাক্তারই নাকি দেখাইছে। শুধু ওই ওষুধ খাইলেই সে সুস্থ থাকে।
    ডাক্তারের কোনো কাগজপত্র, প্রেসক্রিপশনÑএসব আছে?
    আমার কাছে তো কিছু থাকে না।
    আমি কোনোভাবেই বুঝতে পারছি না শেফালীর স্বামী সাঈদ কী এমন রোগে আক্রান্ত। শেফালীর অনেক পীড়াপীড়িতে এক কাপ চা আর দুই পিস বেঙ্গল বিস্কুট খেতে হলো। একটু পরই শুনলাম, ভেতরের ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে।
    নাঈমের মনে হয় ঘুম ভাঙছে। বলে শেফালী ভেতরে চলে গেল। অল্প সময় পর তিন-চার বছরে এক হাড়-জিরজিরে শিশু নিয়ে ঘরে ঢুকল। শিশুটির চোখে রাজ্যের বিস্ময়। শেফালী আগের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসতে বসতে শিশুটির প্রতি বলল, সালাম দাও আব্বু, সালাম দাও। এইটা তোমার একটা মামা।
    বলে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আমি বুঝতে পারলাম, এই হাসির অর্থÑ‘এই মামা তোর বাবাও হইতে পারত’। হঠাৎ শেফালী আমাকে জিজ্ঞেস করল, বিয়ে করেন নাই কেন, স্যার?
    কেন মনে হলো বিয়ে করিনি?
    জানি না, তবে মনে হলো আপনি বিয়ে করেননি।
    কেন মনে হলো, শেফালী?
    বললাম তো জানি না।
    যে কারণে তুমি না জেনে ধরে নিয়েছে বিয়ে করিনি, সেই কারণেই বিয়ে করিনি।
    আমরা দুজন বেশ কিছু সময় চুপচাপ বসে রইলাম। ও কী ভাবছে, জানি না। আবার আমি কী ভাবছি, শেফালীও তা জানে না। আবার এমনও হতে পারে, দুজনেই হয়তো একই বিষয় ভাবছি।
    আমি পুরো সময়ের মধ্যে একবারও জিজ্ঞেস করলাম না, তুমি কেমন আছ, শেফালী? কারণ, আমি দেখতে পাচ্ছি ও ভালো নেই। আমি আবার ওর স্বামী সাঈদের প্রসঙ্গ টেনে আনলামÑ
    শোনো শেফালী, তোমার স্বামী কখন কখন ওষুধ খায়?
    সব সময় খায়। ওষুধই তো তাকে এখন বাঁচাইয়া রাখছে।
    আচ্ছা স্যার, আপনে কি আর বিয়ে করবেন না?
    আরে নাহ।
    একটা কথা জিজ্ঞেস করব? খুব জানতে ইচ্ছা করছে, স্যার।
    কী?
    আপনি ওই দিন সন্ধ্যায় আপনার মাকে নিয়ে আমাদের কিছু না বলে চলে গিয়েছিলেন কেন?
    কী বলছ, শেফালী তুমি? তোমার বাবা যে আমাকে মেরে আমার মাকেসহ রাস্তায় বের করে দিয়েছিল, তা তুমি জানো না?
    কী বলেন, স্যার? আপনাকে বাবা মেরেছিল?
    শেফালী যেন আকাশ থেকে পড়ল। চেহারা-সুরতের পরিবর্তন হলেও বুঝতে পারলাম, ওই চোখে কপটতার লেশমাত্র তার নেই। শেফালী ওই সন্ধ্যার কোনো ঘটনাই জানে না। ও তাহলে এত দিন আমাকে ভুল বুঝে ছিল? আমি শেফালীকে ওই দিন রাতের সব ঘটনা খুলে বললাম। সব শুনে শেফালী আবার দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। আমি কী করব বা কী বলব, বুঝে উঠতে পারছি না। ওর বাচ্চাটি আমাদের দুজনার মুখের দিকে তাকাতে লাগল। এরপর শেফালী আমাকে যা শুনাল, তা-ও বেশ নাটকীয় আর কূটচালে ভরা। বুঝতে পারছি যে এই সহজ-সরল মেয়েটির সাথে কী ভয়ংকর প্রতারণা করা হয়েছে। আর শেফালীর সহজ-সরল কালো কাপড়ে ঘিরে থাকা জীবনের বাইরে যে ওকে নিয়ে কে কত খেলা খেলেছে, তা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছি।
    শেফালী ক্লাস ফাইভের পর আর কোনো দিন বোরকা ছাড়া বাইরে বের হয়নি। ও আমাকে প্রায়ই বলত, শাড়ি পরে নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করে লাল মোটরসাইকেলের পেছনে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। রাস্তায় ছুটতে ইচ্ছা করে। আমি খুব ভালো করে জানতাম, শেফালী এই কথাগুলো আমাকে ছাড়া পৃথিবীর অন্য কাউকে কোনো দিনও বলতে পারেনি। আর ওর সে আশা পূরণ হয়েছে বলেও মনে হয় না। আবার হয়েও থাকতে পারে।
    শেফালীর প্রেগন্যান্সির বিষয়টি প্রথম নজরে আসে ওর এক ফুপুর। সে ওই দিন ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। শেফালী আমাকে কিছু জানানোর সুযোগই পায়নি। ওর ফুপু ওর বাবাকে সব ঘটনা জানিয়ে বেড়ানোর কথা বলে দুপুরেই মাইক্রো বাসে করে পার্শ্ববর্তী থানায় তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। সাড়ে আটটা-নয়টার দিকে একজন প্যারামেডিক ডাক্তার এসে ওর অ্যাবরশন করায়। শেফালীর কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে ওকে আটকে রাখা হয় ঘরে। সপ্তাহখানেক পর ছোমেদ কন্ট্রাক্টর চকচকে রামদা নিয়ে বসে থেকে তার চিরশত্রু সেলিম কন্ট্রাক্টরের ছেলে সাঈদের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়।
    আমি তো দেখে এসেছি সেলিম কন্ট্রাক্টর তোমার বাবার চিরশত্রু। একজন আরেকজনের ছায়াটা দেখলেও লাথি মারত। তোমার বাবা দুই-দুইবার সেলিম কন্ট্রাক্টরকে খুন করতে লোক পাঠাল। তার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে হলো কী করে, বলো তো?



    সে তো আরেক গল্প। আর তা শেফালী পরে জেনেছে। যে প্যারামেডিক ডাক্তার শেফালীর অ্যাবরশন করিয়েছে, সে আসলে ছিল সেলিম কন্ট্রাক্টরের খাস লোক। অনেক টাকায় সে তথ্যটি সেলিম কন্ট্রাক্টরের কাছে বিক্রি করেছে। আর এই তথ্যটি নিয়ে ব্যবসা করেছে সেলিম কন্ট্রাক্টর আর তার ছেলে সাঈদ। ছোমেদকে সে নিজে প্রস্তাব দেয় তার ছেলের সাথে বিয়ের। না হলে সকালের আগেই শেফালীর ‘প্যাট ফালানো’র খবর চাউর করে দেওয়ার হুমকি দেয়। এলাকার মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজের কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারির সামনে মান-ইজ্জত-সম্মানের এক বিরাট প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। সামনে ইলেকশন। চোখের সামনে চেয়ারম্যানের গদি। একটু নুন-লবণ ছিটিয়ে ছোমেদ কন্ট্রাক্টর গিলে নেয় টোপটি। সাঈদের সাথে বিয়ে হয় শেফালীর।





    দুপুর হয়ে এসেছে দেখে আমি শেফালীকে জিজ্ঞেস করলাম, সাঈদ কোথায়? বাসায় আসবে কখন?

    জানি না। সব হারাইয়া সে তো এখন পাগলের মতো। কোথায় থাকে, কী করে, জানি না।
    কী বলছ এসব? অসুস্থ একটা মানুষ। তোমার তো উচিত তাকে সব সময় চোখে চোখে রাখা। নিয়মিত ওষুধপথ্য খাওয়ানো।
    আপনি যে রকম ভাবছেন, ও কি আর আমাকে এখন আর সেরকম গুরুত্ব দেয়? তবে ওষুধপথ্য খাওয়া নিয়া কোনো চিন্তা নাই। সে নিয়মিতই ওষুধ খায়। ওষুধ খেতে তার কখনো কোনো হেরফের হয় না।
    ও আচ্ছা।
    ওর পরিচিত লোক আছে, যারা ওষুধ শেষ হয়ে গেলে দিয়ে যায়।
    কেন, ফার্মেসি থেকে কেনো না?
    না স্যার, বলি কি আপনাকে? ওর যে ওষুধ খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়, সে ওষুধ তো বিদেশি।
    বলো কী! তাই নাকি?
    হ্যাঁ। তাই তো এত টাকাপয়সা খরচ হয়, এত দাম।
    ও আচ্ছা।
    আইয়ুব ভাইজানেরে কি মনে আছে আপনার, স্যার? বলে একটু মুচকি হাসল শেফালী। 
    আমি আইয়ুবকে খুব ভালোভাবে চিনি। আমি কেন, শেফালী কি কম চেনে নাকি? আইয়ুব এই এলাকারই একটা ছেলে। সব সময় সে শেফালীর প্রেমে হাবুডুবু খেত। কিন্তু কখনো কোনো ধরনের বিরক্ত করত না। প্রতিদিন আমাকে দিয়েই শেফালীকে একটা করে চিঠি পাঠাত। আইয়ুব তো আর জানত না যে আমি শেফালীকে আর শেফালী আমাকে ভালোবাসে। শেফালীর বিয়ের পর যে কয় দিন আমি এলাকায় ছিলাম, দেখতাম, আইয়ুবের মধ্যে এক বিশাল পরিবর্তন এসেছে। চুল-দাড়ি লম্বা করে চোখে সুরমা, মাথায় সবুজ রঙের পাগড়ি আর লম্বা পাঞ্জাবি পরে নিয়মিত রোজা-নামাজ শুরু করল। এই আইয়ুবও একসময় আমার ছাত্র ছিল। এমনকি আমি ওই এনজিওর প্রজেক্টে ওকে কিছু কাজও দিয়েছিলাম। কিন্তু আইয়ুব আজ পর্যন্ত আমার আর শেফালীর সম্পর্কের কথা জানে না। তবে এ কথাটা ঠিক যে আইয়ুব শেফালীকে খুব ভালোবাসত। চিঠিতে শেফালীকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনত আইয়ুব। আমি আর শেফালী পড়তাম আর হাসতাম। এখন আইয়ুব কোথায় আছে, কেমন আছে, জানি না।
    হ্যাঁ, মনে থাকবে না কেন? কী বলো।
    ওই আইয়ুব ভাই-ই তো এখন তারে বাঁচাইয়া রাখছে।
    তাই নাকি? কীভাবে?
    আইয়ুব ভাই তারে সব সময় ওষুধপাতি আইনা দেয়। যহন যা লাগে, রাত যে কয়টা বাজে, আইয়ুব ভাইকে ফোন দিলে সে মোটরসাইকেলে ওষধ নিয়া হাজির। যেখানে থাকুক, যেভাবে থাকুক, ওষুধের জন্য ওর বাপে ফোন করার দশ মিনিটের মধ্যে হাজির হবে।
    বাহ্, সে তো খুবই ভালো। আইয়ুব কিন্তু আগে থেকেই তোমার শুভাকাক্সক্ষী ছিল। কখনোই তোমার কোনো ক্ষতি চাইত না। তোমার জন্য একসময় কত কী করত, মনে নাই?
    মনে থাকব না কেন? আমারে বোরকার ওপর দিয়া একনজর দেখার জন্য পাগল হইয়া যাইত। আমার খালি হাসি পাইত।
    এখন ওসব আর বলেটলে না?
    এ কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল শেফালী।
    আরে নাহ! কী যে কন স্যার, সে এখন দুই কন্যার বাপ। বিশাল বিজনেস তার।
    বাহ্! কিসের বিজনেস?
    কন্টাকটারি। আমারে বড়গলায় ভাবি ডাকে।
    ও।
    রাতেই আমি ঢাকায় রওনা দেব। এখানকার কাজ সব শেষ। ভেতর থেকে ওঠার তাড়া অনুভব করলাম। শেফালীকে বললাম, আজ আমি যাই।
    দুপুরে চারটা খেয়ে যান, স্যার।
    আজ না, শেফালী। অন্যদিন খাব। সারা জীবন তো তোমার রান্নাই খেয়েছি।
    আপনি আর আসবেন না, স্যার?
    আসব। তুমি কী করো সারা দিন ঘরে বসে? বের হও না কোথাও?
    কোথায় বের হব? কই যাব, স্যার?
    শাড়ি পরে নদীর পাড়ে।
    ওসব এখন আর ভাবি না।
    আচ্ছা, আমি আজ উঠি। তোমার স্বামীকে নিয়ে একবার ঢাকায় আসো। এভাবে এখানে চিকিৎসা করালে কবে সুস্থ হবে কে জানে।
    আমি কত কইছি, স্যার, সে ঢাকা যাবে না।
    আচ্ছা, তোমার স্বামী যে ওষুধ খায়, তা কি এখন তোমার কাছে আছে? আমাকে দেখাতে পারবে?
    জানি না। দেখতে হবে। থাকার তো কথা। আইয়ুব ভাই জানে, একেকবার দিয়া যায়। আমি রাইখা দেই ডিব্বায়। ওর বাবা ওখান থেকে নিয়ে নিয়ে খায়। দাঁড়ান, দেখি দিতে পারি কি না।
    শেফালী ঘরের মধ্যে গেল। আমি সাথে থাকা ব্যাগটা নিয়ে বের হব বলে প্রস্তুত হচ্ছি। এমন সময় শেফালী এসে বলল, পাইছি স্যার, এই বলে তার ডান হাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলির চিমটার মধ্য থেকে আমার হাতের তালুতে যে বস্তুটি ছাড়ল, তা দেখে আমার প্রথমে মনে হলো, কন্টিসেপটিক পিল। দেখতে রানি গোলাপি রঙের, সাইজ ওই জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের মতো। নাকের কাছে গন্ধ নিয়ে দেখলাম স্ট্রবেরির মতো মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে।
    এটা খায় তোমার স্বামী?
    জি স্যার।
    আচ্ছা, আসি তাহলে।
    আবার আসবেন তো, স্যার?
    আসব শেফালী, বেঁচে থাকলে আসব।


    একবার ভাবলাম শেফালীর দেওয়া বড়িটা নিয়ে যাই। পরে দামের কথা মনে পড়ায় আমি মোবাইল বের করে ভালোভাবে দুটো ছবি তুলে নিলাম। নেটে ইমেজ সার্চ দিলে দশ সেকেন্ডেই সমস্ত তথ্য বেরিয়ে আসবে। আমি আমার বাঁ পকেটে হাত দিয়ে দশটা চকচকে এক হাজার টাকার নোট শেফালীর ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে কোনো কথা না বলে হনহন করে হেঁটে চলে এলাম। সদর রাস্তায় এসে পার্ক করা টয়োটা করোলায় উঠে বসলাম। আমি শেফালীকে মিথ্যে আশা দিয়ে এসেছি। আমি আসলে আর কখনোই শেফালীর কাছে ফিরব না। আমি সুইডেনের নাগরিকত্ব পেয়ে গেছি। ওখানে চলে যাব। আর কখনো ফেরার ইচ্ছা নেই। সামনের ক্রিসমাসে আমার আর লিলির বিয়ে। অলরেডি আমাদের দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। লিলির কথা মনে হতে আমি ফোনটা হাতে নিলাম। আমার গাড়ি ছুটে চলেছে ঢাকার উদ্দেশে। ফোনটা হাতে নিয়ে আগেই শেফালীর স্বামীর ওষুধের ছবি দেখলাম। মোবাইলের ডেটা অন করে ছবি দুটো ইমেজে সার্চ দিলাম। 

    নাম এলো  ‘ইয়াবা’।




    সকল ধরণের কপিরাইটঃ সাইফুল বাতেন টিটো
    (গল্পটি প্রথমে মাসিক মৌচাকে ঢিল পত্রিকায় ছাপা হয়, পরে আমার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘ক্লিনিক্যাল লায়ার’-এ প্রকাশিত হয়। বইটি অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ তে ঐতিহ্য প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।)

    Image Credit: Artist -  Prashanta Nayak  


    1 comment: